রবিবার, ৫ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

ইসলামের সংখ্যালঘু নীতি

ইসলাম তার অনুসারীদের অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল হওয়ার তাগিদ দিয়েছে। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মুহাম্মদ (সা.) নিজেও খ্রিস্টান ও ইহুদিদের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সংঅসবর্ণ, উইল প্রমুখ ইউরোপীয় ঐতিহাসিক ইহুদিদের প্রতি নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মুসলমানদের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু যুক্তিতর্ক দ্বারা বিশ্লেষণ করলে ইহুদিদের প্রতি মুহাম্মদ (সা.)-এর গৃহীত ব্যবস্থাবলীকে অন্যায় ও অসঙ্গত বলে গ্রহণ করা যায় না। ইহুদিরা প্রথম হতেই হজরত মুহাম্মদ (সা.) তথা ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক ও বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ আচরণ করে আসছিল। এতদসত্ত্বেও মুহাম্মদ (সা.) তাদের প্রতি সর্বদা মহানুভবতা ও সহনশীলতার পরিচয় দেন। ওয়াট মন্তব্য করেছেন, 'হজরতের মদিনা জীবনের প্রারম্ভেই ইহুদিরা বেদনাদায়ক ঘটনার বীজ রোপণ করেছিল, ফলে বিরাট সম্ভাবনার সুযোগ নষ্ট হয়।'

মদিনা সনদের শর্তাবলী ইহুদিরাই সর্বপ্রথম ভঙ্গ করেছিল এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুরাইশদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। অথচ এ গুরুতর অপরাধের জন্য তাদের শুধু দেশ হতে নির্বাসিত করা হয়েছিল- অন্য কোনো কঠোর দণ্ড দেওয়া হয়নি। ইহুদি নেতা কা'ব ও সাল্লামকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এ কঠোর দণ্ড দেওয়ার কারণ ছিল তাদের রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কার্যাবলী। পরিখার যুদ্ধের পর বানু কুরাইযা নামক ইহুদি গোত্রের কতিপয় লোককে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তারাও রাজদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত ছিল। বিশ্বের সব দেশেই রাজদ্রোহিতা একটি জঘন্য অপরাধ। এ অপরাধী সম্প্রদায়ের বিশ্বাসঘাতকতা যদি সেদিন সফল হতো, তাহলে পৃথিবীর বুকে হয়তো ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম জাতির অস্তিত্ব থাকত না। হজরতের সঙ্গে তারা সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ ছিল। এ সন্ধির শর্তানুসারে তারা মদিনা রক্ষার ব্যাপারে হজরতের সাহায্য করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল। কিন্তু তারা সে ওয়াদা খেলাফ করে মুসলমানদের পরম শত্রু কুরাইশদের সঙ্গে নিলিত হয়ে ইসলামের ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করে। সুতরাং প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ ও দেশদ্রোহিতার অপরাধে তারা দোষী ছিল। অভিযুক্ত সম্প্রদায়ের অভিপ্রায় অনুযায়ী তাদের মনোনীত নেতা সা'দ-বিন-মু'আযকেই বিচারক নিযুক্ত করা যায় না; বরং বলা যায়, মহানবী (সা.) এসব অভিযুক্তের বিচার করলে তারা মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে হয়তো শুধু দেশ হতে বহিষ্কৃত হতো। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, হজরতের প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র করা সত্ত্বেও একমাত্র জয়নব ছাড়া অন্য ইহুদিদের ক্ষমা করা হয়েছিল।

ইহুদিদের শাস্তি দানের পশ্চাতে মুহাম্মদ (সা.)-এর কোনো ধর্মীয় প্রতিহিংসা ছিল না; একমাত্র রাজনৈতিক কারণেই তাদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল। ঐতিহাসিক উইলিয়াম মূর বলেন, 'যে কারণে মুহাম্মদ (সা.) ইহুদিদের শাস্তি দিয়েছিলেন তা ধর্মীয় নয়- রাজনৈতিক।' দেনপুল বলেন, 'নিশ্চয়ই মনে রাখা দরকার যে, নগর অবরোধের সময় এসব ব্যক্তির (ইহুদিদের) অপরাধ ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক।'

রাজনৈতিক কারণে ইহুদি বন্দীরা নির্বাসন ও প্রাণদণ্ডাজ্ঞা পেলেও হজরত মোহাম্মদ জাতি হিসেবে ইহুদিদের ঘৃণা করেননি। তিনি ইহুদি সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে বিশ্ব ইতিহাসে এক মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

ইসলামের প্রথম যুগে খ্রিস্টানদের সঙ্গে মুসলমানদের সুসম্পর্ক ছিল। মক্কার কুরাইশদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে হজরত ওসমানের (রা.) নেতৃত্বে একদল মুসলমান আবিসিনিয়ায় গেলে সেখানকার খ্রিস্টান রাজা নাজ্জাসী তাদের আশ্রয় দেন। নবী করিম (সা.) খ্রিস্টান রাজার এ সহৃদয়তার কথা ভুলেননি। মদিনায় হিজরত করার পর সেখানকার খ্রিস্টানরাও মুসলমানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলত। তাই হজরত মুহাম্মদ (সা.) খ্রিস্টানদের এ বন্ধুসুলভ ব্যবহারের কথা স্মরণ রেখে ষষ্ঠ হিজরিতে সিনাই পর্বতের নিকটবর্তী সেন্ট ক্যাথারিন নামক গির্জার পাদরি ও অন্য খ্রিস্টানদের একটি সনদ প্রদান করেন। এ সনদ খ্রিস্টানদের প্রতি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সহনশীল নীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এর দ্বারা খ্রিস্টানদের নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। কোনো মুসলমান এ সনদের কোনো শর্ত ভঙ্গ বা তার অপব্যহার করলে কঠোর শাস্তি দেওয়ার কথা জারি করা হয়। হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজেই খ্রিস্টানদের জানমাল রক্ষা করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

গ্রন্থনা : শাকিল জাহান

সর্বশেষ খবর