মঙ্গলবার, ৭ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা

সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর

তুষার কণা খোন্দকার

সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের কবি ভারত চন্দ্র বলে গেছেন, 'সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর'। অর্থাৎ অতিভাষণ মানে আংশিক সত্য কিংবা শুধুই মিথ্যা। ইদানীং সরকারের ভিতরে-বাইরে কিছু মানুষের বিস্তর কথা শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত বোধ করছি। আমরা সাধারণ মানুষ বিরক্তি প্রকাশ করার আগে সরকারের উঁচু পর্যায়ের নেতারা অতিভাষী মন্ত্রী এবং দলের নেতাদের থামতে বলছেন। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, দুয়েকজন মন্ত্রী এবং আগের আমলের মন্ত্রিসভার সদস্য যারা মন্ত্রিত্ব থেকে ছিটকে পড়েছেন তাদের কেউ কেউ কথা বলার ব্যাপারে অদম্য, অপ্রতিরোধ্য। এরা কিছুতেই বুঝতে নারাজ যে, মানুষ সরকারের কাছে ভালো কাজের নিদর্শন চায় কথার ফুলঝুরি শুনে সময়ের অপচয় করতে চায় না। তার চেয়ে বড় কথা, যাদের কথার প্রভাবে রাজনৈতিক অঙ্গনে অকারণ শত্রুতা সৃষ্টি হয়, যাদের দায়িত্বহীন শব্দচয়ন দেশে বিবাদ ডেকে এনে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ছেদ টেনে দেওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করে তারা কথা না বললে সরকারও স্বস্তিতে থাকবে, আমরা সাধারণ মানুষও রুটি-রুজির জন্য স্বচ্ছন্দে কাজ করতে পারব।

আমরা সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক কোন্দলকে ভয় পাই। রাজনৈতিক কোন্দল রাজনীতিকদের জন্য কী সুখ বয়ে আনে আমরা জানি না, তবে সাধারণ মানুষের রুটি-রুজির জন্য রাজনৈতিক কোন্দল একটা সর্বনাশা আঘাত। দেশের সাধারণ মানুষ নিজেরা কাজ করে নিজেদের দারিদ্র্য ঘুচাচ্ছে, সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য বয়ে আনছে বলেই বিদেশিরা আমাদের নিম্নমধ্য আয়ের দেশ বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে। এই স্বীকৃতি সাধারণ মানুষের অবিরাম শ্রম ঘামের ফসল। এই সাফল্যের কৃতিত্ব একা একটি সরকার কিংবা নির্দিষ্ট একটি আমলের বিষয় নয়। '৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে একটু স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখার জন্য কৃষক, কৃষিবিদ এবং অন্যান্য সেক্টরের মানুষ বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছে- এই সত্য রাজনীতিবিদরা বুঝতে পারেন না বলে তারা সরকারের আমল ভাগ করে ক্রমাগত আমলনামা রচনার কাজে ব্যস্ত থাকেন। '৭১ সালের পরে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে যারা গদিতে ছিলেন সেসব সরকারের কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে তাদের সবাইকে উন্নয়নবান্ধব বলা যাবে না। আবার অনেক সরকারের সময়কালে দেশে উন্নয়ন সহায়ক কর্মসূচি অগ্রাধিকার পেয়েছে, যা দেশের উন্নয়নের পথ মসৃণ করেছে। নীতিনির্ধারণ এবং কর্মসূচি প্রণয়নের দক্ষতা-অদক্ষতা বিচার করে দেশের কোন সরকার উন্নয়নবিমুখ অথবা কোন সরকার উন্নয়নমুখী। দেশের সাধারণ মানুষ রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক বিভাজনের মুখাপেক্ষী নয়। মানুষ তাদের নিজ নিজ পরিসরে অবিরাম উন্নতির চেষ্টা চালিয়ে গেছে। তাদের সেই চেষ্টা বর্তমানেও অব্যাহত আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এটি একটি ছেদহীন অবিরাম প্রয়াস। কখনো কখনো দেশে উন্নয়নবিমুখ সরকার ক্ষমতায় ছিল বলে সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জনগণ উৎপাদন এবং বিপণনের প্রক্রিয়া থেকে সরে যায়নি। কোনো কোনো সরকারের পারফরম্যান্স মন্দ বলে সেই অভিযোগে জনগণ উপোস পেটে হাত-পা কোলে ঘরে বসে থাকেনি। তার প্রমাণ, বিএনপি সরকার যখন কৃষককে সার দিতে ব্যর্থ হয়েছে তখন সারের দাবিতে কৃষক জান দিয়েছে কিন্তু চাষবাস শিকায় তুলে রিলিফের আশায় দিন গোনেনি।

এখন দেশের সব মানুষ দুই বেলা দুমুঠো ভাত-মাছ খেতে পারছে এই সত্য এখন দৃশ্যমান। দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারা সরকারের একটি বড় সাফল্য। এই সত্য বিবেচনায় নিয়ে বিএনপি আমলের মন্ত্রী মঈন খান কয়েক দিন আগে বললেন, 'দেশের মানুষ ভাত চায় না, তারা স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার চায়।' মঈন খানের এমন কল্পিত কথা নিঃসন্দেহে বাস্তবতা বর্জিত। আমার বিশ্বাস, তিনি নিজে কোনো দিন ক্ষিধের কষ্ট ভোগ করেননি বলে এমন আজগুবি থিওরি দিয়ে অভাবী মানুষের সঙ্গে মশকরা করার সাহস পেয়েছেন। মঈন খানের অবাস্তব উক্তি আমলে না নিয়ে আমরা বরং বলতে পারি, শুধু রাস্তাঘাট কিংবা খাদ্য উৎপাদনের উন্নয়নই শেষ কথা নয়। গণতন্ত্র, সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সামাজিক নিরাপত্তা, মান-সম্মান নিয়ে শান্তিতে বসবাস করার অনুকূল পরিস্থিতি উন্নয়নের অনুষঙ্গ। শুধু আর্থিক উন্নয়ন নিয়ে মানুষ সর্বাঙ্গীণ তৃপ্তি লাভ করতে পারে না বলে তেমন উন্নয়ন টেকসই না হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ার চ্যালেঞ্জের মুখে থাকে। মানুষ যদি আর্থিক উন্নয়ন নিয়ে সর্বাঙ্গীণ সুখ পেত তাহলে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধত না। আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের জন্য মূর্তিমান জালেম শোষক হলেও সে পশ্চিম পাকিস্তানে আক্ষরিক অর্থে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিয়েছিল। আইয়ুব খানের আমলে পশ্চিম পাকিস্তান শিল্পসমৃদ্ধ হয়েছিল এবং সেখানে ধনী তেইশ পরিবারের জন্ম হয়েছিল। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানে সাধারণ মানুষের জীবন মানেরও যথেষ্ট উন্নতি হয়েছিল। কিন্তু তাতে শেষ রক্ষা হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানে ছয় দফা, এগার দফার আন্দোলন দানা বাঁধার পাশাপাশি পাকিস্তানে সাধারণ মানুষ গণতন্ত্রের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল বলে '৬৯ সালে আইয়ুব খানের পরাজয় ত্বরান্বিত হয়েছিল। দেশের আর্থিক উন্নয়নের পাশাপাশি গণতন্ত্র, সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে মানুষের কাছে উন্নয়নের গল্প পানসে হয়ে যায়। জনগণ জানে, একটি দেশের আর্থিক উন্নয়ন দেশের আপামর জনগণের অর্জন। সরকারের দায়িত্ব জনগণের জানমাল রক্ষা করা এবং দেশের মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে খরচ করা। আমরা বাংলাদেশের মানুষ কি উন্নয়নের সামাজিক অনুষঙ্গগুলো অর্জন করতে পেরেছি বলে দাবি করতে পারছি?

আমরা যখন দেশের উন্নতির জন্য প্রাণপাত খেটে মরছি তখন সরকারের আমলনামার ঝুলিতে একটার পর একটা মন্দ উদাহরণ জড়ো হচ্ছে। জনজীবনে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশের অপরাধ অপকর্মের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। খুন, ধর্ষণ, মাদক পাচারের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধের সঙ্গে পুলিশ অবলীলায় জড়িয়ে পড়ছে। ফলে সুশাসন প্রাপ্তির স্বপ্ন মানুষের মন থেকে দ্রুত হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। আরেক দিকে দেখুন, র্যাবের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের মতো আইনবিরুদ্ধ কাজের অভিযোগ উঠলেও দেশের মানুষ র্যাবের ওপর এক ধরনের আস্থা পোষণ করত। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধ করার পর একটি নিয়মিত বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা হোঁচট খেয়েছে। মানুষ বিশ্বাস করে, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের আসামি র্যাব সদস্যদের কোনো শাস্তি হবে না কারণ খুনে বাহিনীর যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে তিনি একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর জামাই। প্রভাবশালী মন্ত্রী নিজেও দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি। মন্ত্রী জামাইয়ের গুরুতর অপরাধের দায় না হয় নাই নিলেন, তারপরও তার নিজের দুর্নীতির দায় তো তিনি নিজে নেবেন। অথচ মন্ত্রীর নির্বিকার ভাব দেখে মনে হচ্ছে নিন্দার কোনো কাঁটাই তার গায়ে বিঁধছে না। সরকারও তার ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে এত দ্বিধান্বিত কেন সেটা আমার বুঝের মধ্যে আসে না। আরেকদিকে, খাদ্যমন্ত্রী ব্রাজিল থেকে খাবারের অনুপযোগী গম নিয়ে এসে পুলিশকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। নিম্নমানের গম খাওয়ার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে পুলিশ সরকারকে ইতিমধ্যে চিঠি দিয়েছে, যে তথ্য পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। খাদ্যমন্ত্রী জনগণের টাকার অপচয় করে কেন খারাপ মানের গম কিনে আনলেন সে জবাব তাকে দেশের করদাতাদের কাছে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে আমরা বুঝব দেশে গণতন্ত্রের অনুষঙ্গ জবাবদিহিতা চালু আছে। তাহলে ভবিষ্যতে জনগণের টাকা নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেলতে ভয় পাবে। খাদ্যমন্ত্রী এখনো একটুও ভয় পাননি। তার প্রমাণ তিনি ল্যাবরেটরির গম পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে যত না কথা বলছেন তারচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করছেন খালেদা জিয়াকে গালাগালি করার কাজে।

পত্র-পত্রিকার পাতা খুললেই আমরা দেখি মানব পাচারের নিষ্ঠুর নির্মম কাহিনী। উপকূলের সংসদ সদস্য মাদক সম্রাট, মানব পাচারকারী দলের হোতা আইন-আদালতকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আমাদের দুই আঙ্গুলে ভি চিহ্ন দেখাচ্ছেন। রাস্তায় জ্যামের কারণে বিরক্ত হয়ে এমপিপুত্র গুলি করে দুই নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিলেন। পুলিশের ঘুষবাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। ডিজিটালাইজড ভর্তি জটিলতায় লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীর প্রাণ ওষ্ঠাগত। টেন্ডারবাজিতে সরকারদলীয় লোকজনের খুনাখুনির খবর এখন গা সওয়া ঘটনা। কী এক অলৌকিক কারণে টেন্ডার ফ্লোট করার ডিজিটালাইজড পদ্ধতি চালু করার উদ্যোগ না নিয়ে সরকার ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি ডিজিটালাইজড করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। খুন, অপহরণ, নারী নির্যাতনের মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। কিন্তু সরকারের মন্ত্রীরা এসব কোনো তথ্যই জানতে পারছেন না। তারা সবাই সমবেতভাবে একদল তোতাপাখির মতো অবিরাম বিএনপি, খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ইত্যাদি নাম জপ করে চলেছেন। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি তারা বেমালুম ভুলে গেছেন। বরং মন্ত্রী-এমপিদের কথা শুনে মনে হয়, বিএনপি এবং খালেদা জিয়াকে অনর্গল গালাগালি করাকে তারা দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার উপায় বলে মেনে নিয়েছেন।

মন্ত্রীদের আমি বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করব, মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে গালাগালির মহড়া না দিয়ে আপনারা আপনাদের দেওয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করুন। গত সাড়ে ছয় বছর ক্ষমতায় থেকে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার কী উদ্যোগ নিয়েছেন সেটি আমাদের জানা খুব জরুরি। কারণ দেশে সুশাসন কায়েম না হলে দেশকে নিম্নমধ্য আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে এগিয়ে নিতে আমাদের কষ্ট হবে। আপনারা কোন্দল থামিয়ে আমাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়ালে কাজটা আমরা স্বচ্ছন্দে করে ফেলতে পারব।

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

 

সর্বশেষ খবর