মঙ্গলবার, ৭ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা
আইন-আদালত

ন্যায়বিচার সমুন্নত রাখার ভাবনা

অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম সরকার

ন্যায়বিচার সমুন্নত রাখার ভাবনা

প্রায় ৭০০ বছর আগে এদেশে যখন সুসংগঠিত বিচার ব্যবস্থা ছিল না তখন সমাজে যারা প্রতিষ্ঠিত ছিলেন তাদের কথাই ছিল আইন। স্বাভাবিকভাবে দুর্বল জনগোষ্ঠী আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতেন। এই আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় যেন কোনো রকমের বৈষম্য না হয় সে জন্য সৃষ্টি করা হয় বিচার বিভাগ। সাধারণভাবে ন্যায়বিচার বলতে আমরা বুঝি অভিযুক্তকে আদালতের মুখোমুখি করা, তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দণ্ডপ্রদানের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত বিচার প্রার্থীকে আশ্বস্ত করা। কিন্তু 'বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে'- এমন কথা বাংলাদেশে বহুকাল ধরেই জনশ্রুতির মতো চলে আসছে। বহুল ব্যবহৃত এ বাক্যটি আমরা সবাই জানি। প্রায়শই বিত্তবানদের পক্ষে বিচারের রায় যাওয়ার অভিযোগ ওঠে এবং বিচার বঞ্চিত হয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন মামলার রায় কেনা বেচার। এ রকম একটি উদ্বেগজনক বাস্তবতায় প্রশ্নটি অবান্তর নয় যে, ন্যায়বিচার কি?

হ্যাঁ সত্যি বলছি, ন্যায়বিচার কি? শুধুমাত্র একটি ন্যায্য সিদ্ধান্তে পৌঁছানো, যত কল্পান্তরই কেটে যাক না কেন? নাকি ন্যায়বিচার মানে অপরাধের যথাসম্ভব দ্রুত নিষ্পত্তি? বিশেষত যেখানে এ বিলম্বের মূল্য বহন করতে হয় ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকেই। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্নটি অপ্রাসঙ্গিক নয় যে, বিলম্বিত বিচার কি শেষ পর্যন্ত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে? যে সমাজে অন্যায়ের শিকার নাগরিকের অভিযোগের স্বপক্ষে সব ধরনের প্রমাণ মজুদ থাকা সত্ত্ব্বেও যে কোনো অজুহাতেই বিচারের কাজটি দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলে থাকে, যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের অধিকার নিশ্চিতভাবে হুমকির মুখে পতিত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ক্ষতির বোঝা তাকেই বহন করতে হয়। সেই যুক্তিতে বিলম্বিত বিচার কখনোই ন্যায়বিচার হতে পারে না। একই যুক্তিতে, বিচারক ন্যায় সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন বলেই বিচার ব্যবস্থাকে ভালো কিংবা দক্ষ বলা যায় না। অকারণে কতটা সময় অযথাই খরচ হলো, হিসাব করে দেখলেই বোঝা যাবে। অনাকাঙ্ক্ষিত এ বিলম্ব বাংলাদেশ বিচার ব্যবস্থায় নতুন নয়। একটি মামলায় সাক্ষীর নিরাপত্তার অভাবেও মামলার গতি শ্লথ হয়ে যায় এবং ন্যায়বিচার মুখ থুবড়ে পড়ে। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রভাবশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অভিযুক্ত হলে সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ ও পেশ করা কত দুরূহ, সে বিষয়ে বাংলাদেশ অবশ্যই দৃষ্টান্তযোগ্য। তবে এসব দৃষ্টান্ত কোনো রাষ্ট্রের জন্য ইতিবাচক বার্তা বহন করে না। কিন্তু উপরের এ সব কিছুই পদ্ধতিগত সংকট। শেষ পর্যন্ত বিচার ভালো হলো না মন্দ এ সংকটগুলো তার একটি চমৎকার ব্যাখ্যা হতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই মাপকাঠি নয়। যে বিচারক এসব সংকট জয় করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আইন মেনে ন্যায় সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন, একমাত্র তাকেই ন্যায়বিচারের প্রশ্নে অভিনন্দন জানানো যায়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ন্যায়বিচার নিয়ে প্রায়শই নানা ধরনের তর্ক শোনা যায়। বিশেষ করে কিছু রাজনৈতিক নেতা ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা দিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তবে বিতর্ক যাই থাকুক না কেন ন্যায়বিচার কোনো মামুলি বিষয় নয়। ন্যায়বিচার হচ্ছে এমন একটি নৈতিক আদর্শ যা প্রচলিত রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে ব্যক্তির অধিকারের সুরক্ষা ও অপরাধীদের অন্যায়ের শাস্তিকে সমুন্নত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা। একমাত্র আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, আইনশৃঙ্খলার গতিকে বেগবান করার মাধ্যমে নাগরিকদের ব্যক্তিগত অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। সাধারণ জনসাধারণের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সব মানুষকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আইনকে হতে হবে যৌক্তিক। বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আইনকে অবশ্যই হতে হবে স্বচ্ছ ও কার্যকরভাবে গ্রহণযোগ্য। অন্তত একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সেটাই প্রত্যাশিত। কেননা জনবান্ধব আইন সাধারণ মানুষের আস্থাকে বাড়িয়ে দেয়। একটি সাধারণ অথচ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে আর তা হলো ন্যায়বিচার ও আইন সমার্থক নয়। ক্ষেত্রবিশেষে আইন অন্যায্য হতেও পারে তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আইন যদি ন্যায্য না হয় তবে ন্যায়বিচার সুদূরপরাহত। বাংলাদেশে ন্যায়বিচার, ন্যায়পরতা ও সুবিবেচক শব্দসমূহের অর্থ কার্যত ইংল্যান্ডের আইনের মামলাসমূহ ও বিধানাবলী যা বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং সমাজে প্রযোজ্য বলে বিবেচিত।

বাংলাদেশে বিচার প্রক্রিয়ায় ন্যায়বিচার অনুসারে একটি মামলা নিষ্পত্তি বলতে সাধারণত অনুরূপ পরিস্থিতি সম্পর্কে ইংল্যান্ডের বিধান মোতাবেক নিষ্পত্তি করা বোঝায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় ব্যক্তি নিরাপত্তা কাঙ্ক্ষিত মানের ন্যায়বিচার নিশ্চিতের চেয়েও বহুগুণ নিচে। একটি সমাজে প্রতিনিয়ত অপরাধমূলক ঘটনার জন্ম থেকে খুব সহজে অনুমান করা যায় যে, সে সমাজে ন্যায়বিচারের অভাব রয়েছে। আমরা যদি আমাদের আচরণগত সমস্যা দূর করে দীর্ঘদিনের অচল অবস্থাকে কাটিয়ে উঠতে চাই তবে অবশ্যই আমাদের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক আইনের চোখে সবাই সমান। তথাপিও দেশটিতে ক্ষেত্রবিশেষে আইনের ওপর ব্যক্তির প্রধান্য দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। আমরা ১৯৭১ সালের পর থেকে আজ অবধি এমন কোনো দৃষ্টান্ত দেখিনি যে, আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কোনো নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির দায়ে মামলা হয়। আর যদিও বিরোধী দলে যাওয়ার পর নেতাদের কেউ কেউ দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হন তবে সে নেতা পুনরায় ক্ষমতায় গেলে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আইনের গণ্ডির বাইরে থাকে। কখনো কখনো ব্যক্তির অবস্থান ভেদে আইনের প্রয়োগ হতেও আমরা দেখেছি। এ রকম দৃষ্টান্ত কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্যই সুখকর নয়।

লেখক : আইনজীবী এবং আইনবিষয়ক ছোট কাগজ 'পঞ্চায়েত'-এর সম্পাদক।

 

সর্বশেষ খবর