বুধবার, ৮ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা

স্টকহোম সিটি কাউন্সিল ও ঢাকা সিটি করপোরেশনে পার্থক্য কোথায়?

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু

স্টকহোম সিটি কাউন্সিল ও ঢাকা সিটি করপোরেশনে পার্থক্য কোথায়?

বেশ কিছু দিন আগে ঢাকা ও চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল মেয়র নির্বাচন। রাজধানী ঢাকায় এই প্রথমবার একের পরিবর্তে দুজন মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। ঢাকাকে বিভক্ত করার কারণেই এখন থেকে ঢাকার ভালো-মন্দ দেখবেন দুজন মেয়র। ঢাকার এই বিভক্তিকরণ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেকেই মতামত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে অটল থেকে ঢাকাকে বিভক্ত করে শেষ পর্যন্ত সফলভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। নির্বাচিত মেয়র ইতিমধ্যে তাদের দায়িত্ব গ্রহণও করেছেন।

ইউরোপের অনেক দেশে রাজধানীর পরিসীমা আকারে অনেক বড় হওয়া সত্ত্বেও রাজধানীকে ঢাকার মতো করে বিভক্ত করা হয়নি। এসব দেশে মূল সিটি কাউন্সিলের ঐতিহ্যকে ধরে রাখা হয়েছে। ঢাকাকে বিভক্ত না করে ইউরোপীয় দেশগুলোর অনুকরণে পরিবর্তন আনার পক্ষে ওই সময় অনেকেই মতামত দিয়েছিলেন। তারপরও সরকার ঢাকাকে বিভক্ত করেছে। ইউরোপীয় দেশগুলোতে মূল শহরকে কেন্দ্র করে সিটি কাউন্সিলের অবস্থানকে ধরে রেখে অন্যান্য এলাকাকে বিভিন্ন ইউনিয়ন কাউন্সিলে বিভক্ত করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকা শহরের অভ্যন্তরেও ঠিক এমনিভাবে ইউনিয়ন কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করে সিটি কাউন্সিলের ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ করা যেত। কিন্তু সরকার তা না করে বৃহত্তর ঢাকাকে বিভক্তির মাধ্যমে সিটি করপোরেশনে দুটি মেয়র পদের সৃষ্টি করেছে। এখানে আমি সিটি করপোরেশন সংক্রান্ত বিষয়ে বিশ্বের উন্নত দেশ সুইডেনের উদাহরণ টেনে আনার চেষ্টা করছি।

সুইডেনে দেশের সব ইউনিয়ন কাউন্সিলগুলোর নির্বাচন একই দিন একই সময়ে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, জাতীয় নির্বাচনের মতোই প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা সরাসরি ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে থাকেন। অর্থাৎ ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচন হবে রাজনৈতিক দলীয় নির্বাচন। বাংলাদেশের মতো পেছন থেকে রাজনৈতিক দলের সমর্থন নিয়ে নয়। প্রতিটি ইউনিয়ন কাউন্সিলের নিজ নিজ এলাকার উন্নয়নের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পৃথক পৃথক স্বাধীনতা রয়েছে। ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচিত কাউন্সিলররা সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। কাউন্সিল টেক্স ও এলাকার স্কুল-কলেজসহ সব কিছুর দেখাশোনা করার দায়িত্ব কাউন্সিলের ওপর। প্রয়োজনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইউনিয়ন কাউন্সিল সরকারের কাছে আর্থিক সহযোগিতা চাইতে পারে।

বর্তমানে স্টকহোম সিটি কাউন্সিলে মোট নয়টি ভাইস মেয়র পদ রয়েছে। নির্বাচিত কাউন্সিলরের সংখ্যা ১০১। তবে এই ৯ জন ভাইস মেয়র ছাড়া একজন পূর্ণ মেয়র রয়েছেন। তিনি হলেন সবচেয়ে ক্ষমতাশালী, যিনি কাউন্সিলের অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন। মূলত তাকেই বলা হয় থাকে সিটি মেয়র। সুইডেনে সরাসরি জনগণের ভোটে কোনো মেয়র নির্বাচিত হওয়ার নিয়ম নেই। নির্বাচিত কাউন্সিলরদের ভোটে মেয়র ও ভাইস মেয়র নির্বাচিত হয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে যে রাজনৈতিক জোট সংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে তারাই ভাগাভাগি করে ভাইস মেয়র পদগুলো নিয়ে থাকে। তবে বিরোধী জোটও তাদের পক্ষ থেকে প্রতিটি ভাইস মেয়র পদে বিরোধী ভাইস মেয়র নির্বাচিত করে। আট বছর পর গত সেপ্টেম্বর ২০১৪ নির্বাচনে বামপন্থী জোট জয়লাভ করে স্টকহোম সিটি কাউন্সিলে ক্ষমতাসীন হয়েছে। নির্বাচন ফলাফল অনুসারে বামপন্থী জোটে সোশ্যাল ডেমোক্রেট ২৪, গ্রিন পার্টি ১৬, লেফট পার্টি ১০ ও ফেমিনিস্ট ইনসেটিভ ৩ মোট ৫৩ আসন। অন্যদিকে ডানপন্থি জোটে মডারেট ২৮, লিবারেল পার্টি ৯, ক্রিস্টডেমোক্রেট ২ ও সেন্টার ৩ মোট ৪২ আসন। জোটের বাহিরে বর্ণ বৈষম্যবাদী রাজনৈতিক দল সুইডিশ ডেমোক্রেট পেয়েছে ৬ আসন।

রাজধানী স্টকহোমে বর্তমানে মোট ২৬ ইউনিয়ন কাউন্সিল রয়েছে। এই ২৬ ইউনিয়ন কাউন্সিলের মধ্যে একটি কাউন্সিল হলো স্টকহোম সিটি কাউন্সিল। মেয়র পদটি রয়েছে শুধু স্টকহোম সিটি কাউন্সিলের মধ্যে। স্টকহোম সিটির মূল এলাকাকে সামনে রেখে ও তার আশপাশের এলাকাকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে স্টকহোম সিটি কাউন্সিল। স্টকহোমের বাকি ২৫ ইউনিয়ন কাউন্সিলে কোনো মেয়র পদ নেই। এখানে কাউন্সিল প্রধানকে বলা হয়ে থাকে ইউনিয়ন কাউন্সিল চেয়ারম্যান। তাছাড়া বিভিন্ন কাউন্সিলে কাউন্সিলর সংখ্যার ক্ষেত্রেও তারতম্য রয়েছে। তবে প্রতিটি কাউন্সিলের স্বাস্থ্য ও ট্রাফিকসেবা দেওয়ার দায়িত্ব রয়েছে গ্রেটার স্টকহোম কাউন্সিলের ওপর। যার আরেক নাম কাউন্টি কাউন্সিল। ইউনিয়ন কাউন্সিলের মতোই কাউন্টি কাউন্সিলের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে একই দিন একই সময়ে। এখানেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে থাকেন। স্টকহোম কাউন্টি কাউন্সিলে মোট ১৪৯ জন নির্বাচিত কাউন্সিলর ২৬ কাউন্সিলের ট্রাফিক ও স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের দায়িত্ব পালন করেন। এ জন্য কাউন্টি কাউন্সিলে ঠিক সিটি কাউন্সিল ও পার্লামেন্টের মতোই কাউন্সিলরদের নিয়ে বিভিন্ন সাব কমিটি রয়েছে। স্টকহোম কাউন্টি কাউন্সিলের অধীনে স্টকহোমের অভ্যন্তরীণ ট্রাফিক দেখাশোনার জন্য স্টকহোম লোকাল ট্রাফিক নামের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যার সংক্ষিপ্ত নাম এস এল। এই প্রতিষ্ঠানটি স্টকহোম ট্রাফিক দেখাশোনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব পালন করে। শুরু থেকে এস এল সরাসরি স্টকহোম ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করলেও নব্বই দশকের শেষ দিকে আন্ডারগ্রাউন্ড ও ট্রেন যাতায়াতের কার্যভার ব্যক্তিগত মালিকানায় ছেড়ে দেওয়া হয়। ফলে বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানি এক এক সময় আন্ডারগ্রাউন্ড ও বাস সার্ভিসের দায়িত্ব গ্রহণ করে আসছে। বর্তমানে স্টকহোম আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন ব্যবস্থার দায়িত্ব পালন করছে এমটিআর নামের একটি হংকং কোম্পানি। স্টকহোম কাউন্টি কাউন্সিলের সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চুক্তি মোতাবেক কোম্পানিগুলো তাদের এই দায়িত্ব লাভ করে থাকে। তবে আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যবস্থা এমটিআর একেকভাবে পেয়ে থাকলেও রাজধানীর বাস পরিচালনার ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। এখানে স্টকহোম লোকাল ট্রাফিক বিভিন্ন বাস কোম্পানিকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চুক্তিভিত্তিক দায়িত্ব দিয়ে থাকে। এই সময় বাস কোম্পানি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হলে চুক্তি বাতিল করার অধিকার রয়েছে।

স্টকহোম কাউন্টি কাউন্সিলে মোট ১৪৯ আসন রয়েছে। ২০১৪ নির্বাচনী ফলাফল অনুসারে আসনগুলোর মধ্যে ডানপন্থি জোটে মডারেট ৪৩, লিবারেল পার্টি ১৩, ক্রিস্টডেমোক্রেট ৯ ও সেন্টার ৭ মোট ৭২ আসন। অন্যদিকে বামপন্থি জোট সোস্যাল ডেমোক্রেট ৪১, গ্রিন পার্টি ১৫, লেফট পার্টি ১২ সর্বমোট আসন সংখ্যা ৬৮। দুই জোটের মধ্যে ব্যবধান মাত্র চারটি আসন। এক্ষেত্রে বর্ণ বৈষম্যবাদী রাজনৈতিক দল সুইডিশ ডেমোক্রেট তাদের ৯ আসন ডানপন্থি জোটের পক্ষে সমর্থন দেওয়ার কারণে তারা পুনরায় ক্ষমতায় থাকার সুযোগ লাভ করে। অন্যদিকে দুই জোটের মাঝখানে সুইডিশ ডেমোক্রেট ৯ আসন লাভ করাতে দলটি তাদের ভোটের মাধ্যমে যে কোনো সিদ্ধান্তে জোট দুটির পক্ষে-বিপক্ষে পরিবর্তন আনার সুযোগ পেয়েছে। সম্প্রতি এ ধরনের একটি সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে সুইডিশ ডেমোক্রেট। সম্প্রতি কাউন্টি কাউন্সিলে স্টকহোমে বাস ও ট্রেন যাতায়াতের জন্য যাত্রীদের মাসিক কার্ডের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে ক্ষমতাসীন ডানপন্থি জোট। বর্তমান মূল্য ৭৯০ ক্রোনার থেকে বৃদ্ধি করে ৮৯০ ক্রোনার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি সুইডিশ লেফট পার্টিসহ বামপন্থী জোট দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে। সুইডিশ লেফট পার্টি এ ব্যাপারে বিভিন্ন সভা ও প্রচারপত্র বিলির মাধ্যমে প্রতিবাদও জানায়। অন্যদিকে ডানপন্থি জোট বাজেটের ঘাটতি ৭০০ মিলিয়ন ক্রোনার পূরণের জন্য মূল্য বৃদ্ধির কারণ উত্থাপন করে। কাউন্সিলে নিজেদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় ক্ষমতাসীন জোট মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব পাস করতে ব্যর্থ হয়। এই মূল্য বৃদ্ধির পক্ষে সুইডিশ ডেমোক্রেট সমর্থন না দেওয়ার কারণে ডানপন্থি জোট হেরে যেতে বাধ্য হয়। স্টকহোমে বসবাসরত জনগণ মাসিক কার্ডের মূল্য বৃদ্ধি না হওয়ায় আনন্দ প্রকাশ করে। ট্রাফিক সার্ভিসের মতো হেলথ সার্ভিসের বিষয়গুলোও দেখে থাকে কাউন্টি কাউন্সিল। সুইডেনে প্রতি চার বছর অন্তর একই দিন একই সময়ে পার্লামেন্ট, কাউন্টি কাউন্সিল ও ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। নির্বাচিত প্রার্থীরা টানা চার বছর তাদের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ থেকে পার্লামেন্ট, স্টকহোম কাউন্টি কাউন্সিল ও সিটি কাউন্সিলে টানা দুই টার্ম সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় ছিল ডানপন্থি জোট। ২০১৪ নির্বাচনে ডানপন্থি জোট তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় মাত্র পাঁচ আসনের কারণে স্টকহোম সিটি কাউন্সিলে ক্ষমতা হারায়।

ঢাকা সিটি কাউন্সিলের জনসংখ্যা ও সীমানা বৃদ্ধির কারণে ঢাকার অভ্যন্তরে বিভিন্ন পৌরসভা সৃষ্টি করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ করা যেতে পারে। অন্যদিকে ঢাকার মূল কেন্দ্রের একটি নির্দিষ্ট এলাকাকে সিটি কাউন্সিলের আওতায় নিয়ে এসে সুইডেনসহ ইউরোপীয় দেশের অনুকরণে ঢাকা সিটি কাউন্সিলের ঐতিহ্য ধরে রাখলে নিশ্চয়ই মন্দ হতো না। এ ছাড়া সরকার ইউরোপীয় মডেলে বৃহত্তর ঢাকার জন্য প্রয়োজনে গ্রেটার ঢাকা এসেম্বলি অর্থাৎ কাউন্টি কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এতে রাজধানীর উন্নয়নের গতিধারাকে আরও দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। শুধু তাই নয়, জাতীয় নির্বাচনের মতো পৌরসভা ও সিটি কাউন্সিলের নির্বাচনগুলো সরাসরি রাজনৈতিক দলের প্রার্থী দ্বারা করার কথাও সরকার চিন্তাভাবনা করতে পারে। আজকের মতো পেছন থেকে রাজনৈতিক দলীয় সমর্থনের তখন আর প্রয়োজন থাকবে না। পারবে কি সরকার আগামী নির্বাচনের আগে এ ধরনের একটা পরিবর্তন নিয়ে আসতে?

লেখক : সাবেক কাউন্সিলর স্টকহোম সিটি কাউন্সিল ও স্টকহোম কাউন্টি কাউন্সিল।

 

সর্বশেষ খবর