বুধবার, ২৯ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা
শ্রদ্ধাঞ্জলি

এ পি জে আবদুল কালামের সেই আহ্বান

সুমন পালিত

এ পি জে আবদুল কালামের সেই আহ্বান

মানুষের মতো মানুষ হিসেবে যারা বিশ্ব ইতিহাসে অমরত্ব লাভের দাবিদার তাদেরই একজন ভারতের সদ্যপ্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম। পেশায় যিনি একজন বিজ্ঞানী। পরমাণু ও মহাশূন্য গবেষণায় তার সাফল্য প্রায় আকাশছোঁয়ার মতো। ভারতীয় আণবিক বোমার জনক ভাবা হয় এই বিজ্ঞানীকে। দেশবরেণ্য বিজ্ঞানী ও বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন যিনি- সেই এ পি জে আবদুল কালামের জন্ম দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর এক হতদরিদ্র পরিবারে। বাবা ছিলেন মৎস্যজীবী। নৌকা তৈরির কারিগর হিসেবেও কাজ করতেন তিনি।

আবদুল কালামকে তার বাবা স্কুলে ভর্তি করেন বুকভরা আশা নিয়ে। কিন্তু মাত্র ৮ বছর বয়সেই পড়াশোনার পাশাপাশি জীবনযুদ্ধেও জড়িয়ে পড়েন। পড়াশোনার খরচ মেটানো ও বাবা মাকে সাহায্য করতে হকারির কাজ শুরু করেন তিনি। ভোরে লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পত্রিকা পৌঁছে দিতেন। এহেন আবদুল কালাম তার যোগ্যতাগুণে ভারতের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ও দেশের রাষ্ট্রপতি যখন যে পদ তিনি গ্রহণ করেছেন সে পদকেই মহিমান্বিত করেছেন।

শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রপতি সব পরিচয় ছাপিয়ে এ পি জে আবদুল কালাম ভালো মানুষ হিসেবে নিজের পরিচিত গড়ে তুলেছিলেন সর্বমহলে। অপরকেও ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে উৎসাহিত করতেন তিনি। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি যখন ভারতের রাষ্ট্রপতি তখন স্কুল পর্যায়ে নীতি বিজ্ঞানকে পাঠ্যসূচি করার জন্য বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, যুব সমাজের মানসিক বিকাশ ও তাদের মাঝে দেশপ্রেম এবং ভ্রাতৃত্ববোধ জাগরণে নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। তার অভিমত, মূল্যবোধের শিক্ষা থেকেই কেবল একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব। যে কারণে নৈতিক শিক্ষা বিশ্বব্যাপী অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত। বলা হয়ে থাকে দুর্নীতি এ মুহূর্তে দুনিয়ার প্রায় সব দেশের জন্য এক ভয়াবহ সমস্যা। সুনীতির বিকাশ হলে- আমাদের মননে-মগজে তা স্থিতিলাভ করলে দুর্নীতির কালো ছায়া বিস্তারের সুযোগ পাবে না। সুনীতির প্রতি পক্ষপাতিত্ব দুর্নীতি থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে।

সুনীতির জন্য চাই নৈতিক শিক্ষা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে নৈতিক শিক্ষা লোপ পাচ্ছে। শিক্ষার লক্ষ্য এক সময় ছিল নৈতিক মান অর্জন। আজ তা বৈষয়িক লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগুচ্ছে। শিক্ষার মাধ্যমে অর্থ অর্জনের বিষয়টি ক্রমশ গুরুত্ব পাচ্ছে। জীবনযাপনের বাস্তবতায় অর্থ অর্জন অবশ্যই উপেক্ষণীয় নয়। যে শিক্ষা, কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে সহায়তা করে তার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হলেও নৈতিক শিক্ষার অভাব নানা সংকট সৃষ্টি করছে। ভালো ও মন্দের পার্থক্য নির্ণয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উপলব্ধি সৃষ্টির অভাব থেকেই যাচ্ছে।

ঘুষ, দুর্নীতি, অন্যায় এবং মাদকাসক্তি বিস্তারের পেছনে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দৈনতা এবং সীমাবদ্ধতা যে কম-বেশি দায়ী, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবনে যা শিখছে তার মধ্যে নৈতিক শিক্ষার কমতি থাকায় বিশ্বজুড়েই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। আগে শিক্ষার্থীরা পাঠশালা, স্কুল-কলেজে যেমন নৈতিক শিক্ষা পেত, তেমনি তারা বাবা-মার কাছ থেকেও পেত সুনীতির শিক্ষা। যান্ত্রিক সভ্যতা মানুষকে এতটাই ব্যস্ত করে তুলছে যে, ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় বাবা-মা বা অভিভাবকের পক্ষে শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত সময় দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তাদের মধ্যে সুকুমার বৃত্তির বিকাশ কাঙ্ক্ষিতভাবে ঘটছে না।

নীতিবিদ্যাকে বলা হয় সব বিদ্যার আধার। এ বিদ্যা ছাড়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে ক্ষেত্রেই আমাদের পদচারণা হোক না কেন সমাজ, দেশ, জাতি তথা বৃহত্তর মানব সমাজের জন্য তা কতটা কল্যাণ বয়ে আনবে তা প্রশ্নাতীত নয়। আগেই বলেছি, এক সময় আমাদের শিশুদের পাঠ আরম্ভ হতো নীতিবাক্য অনুশীলনের মাধ্যমে। তারা পড়ত 'সদা সত্য কথা বলিবে, কখনো মিথ্যা বলিবে না, গুরুজনকে শ্রদ্ধা করিবে' ইত্যাদি। সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য তাদের মনে গেঁথে দেওয়া হতো। সৎভাবে জীবনযাপন যে শ্রেয় এ বিষয়টি তারা আত্দস্থ করত অর্জিত শিক্ষার গুণে। ফলে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের প্রতি তাদের পক্ষপাতিত্ব গড়ে উঠত সহজাতভাবে। যা কিছু অসত্য, অসুন্দর ও অকল্যাণকর তা থেকে দূরে থাকার মানসিকতা রপ্ত হতো। কালের বিবর্তনে আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বমানের শিক্ষা প্রাপ্তির সুযোগ স্বদেশেই সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। তারপরও এ শিক্ষা দেশ, জাতি ও সমাজের প্রতি দায়বোধ সৃষ্টি করতে পারছে না।

আমাদের যুবসমাজের একাংশের সন্ত্রাস ও মাদকাসক্তের দিকে ঝুঁকে পড়ার পেছনেও নীতিবোধের ঘাটতি যে জড়িত তা সহজে অনুমেয়। সন্দেহ নেই, এ সংকট আজ বিশ্বজনীন এক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। প্রায় এক দশক আগে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সদ্যপ্রয়াত এ পি জে আবদুল কালাম নৈতিক শিক্ষার যে তাগিদ তুলে ধরেছিলেন, সময়ের বিবর্তনে তা প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। বিশ্বে আজ যে অশান্তি ও আস্থার সংকট দানা বেঁধে উঠেছে তার পেছনেও নৈতিক শিক্ষার অভাব কাজ করছে। এ শিক্ষার অভাবে বিশ্ব ব্যবস্থায় নৈরাজ্য দেখা দিয়েছে। তা থেকে ফিরতেই নৈতিক মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিতে হবে। এ পি জে আবদুল কালামের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার যে তাগিদ তিনি এক দশক আগে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে তুলে ধরেছিলেন তার বাস্তবায়নে উদ্যোগী হতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

সর্বশেষ খবর