রবিবার, ২ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিশ্ব শ্রমবাজারে উদ্ভাসিত হোক বাংলাদেশের নাম

হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ

বিশ্ব শ্রমবাজারে উদ্ভাসিত হোক বাংলাদেশের নাম

জনশক্তি খাত আমাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। এই খাত থেকে প্রতি বছর যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে আর কোনো খাত থেকে আসে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রথমবারের মতো দেড় হাজার কোটি মার্কিন ডলারের অঙ্ক অতিক্রম করেছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ১ হাজার ৫৩০ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। আগের বছরের তুলনায় এ পরিমাণ ৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেশি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রবাসী আয় ছিল ১ হাজার ৪২৩ কোটি ডলার। সেই হিসাবে বিদায়ী অর্থবছরে ১০৭ কোটি ডলার বেশি এসেছে। আমাদের এ অর্জন আরও বেশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বৈশ্বিক কিছু ঘটনাবলী, মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের অদূরদর্শিতা এবং সমন্বয়হীনতার কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। আর সে কারণেই কখনো কখনো এ খাত ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা সংকট। সেই সংকটময় মুহূর্ত এখনো আমরা পার করতে পারিনি।

গত কয়েক বছরে শ্রমিক প্রেরণের ক্ষেত্রে অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হওয়া, অভিবাসন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া, কিছু দেশ থেকে কমবেশি শ্রমিক ফেরত আসা, কিছু শ্রমবাজারে নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকা ও নানা অব্যবস্থাপনা এবং জটিলতায় বিশ্ব শ্রমবাজারে বাংলাদেশের শ্রমিকদের চাহিদা তৈরি না হওয়ায় জনশক্তি খাত কিছুটা হলেও তার প্রাণচাঞ্চল্যতা হারিয়ে ফেলে। অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশ চেষ্টা করছিল সব বাধা অতিক্রম করে এ খাতে এক ধরনের আস্থার জায়গা তৈরি করা। বিশেষ করে শ্রমবাজার সম্প্রসারণ, অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনা, দেশে-বিদেশে মধ্যস্বত্বভোগীদের দুর্বৃত্তপনা বন্ধ করা, ভিসা ট্রেডিং বন্ধ করা, শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিধান ও কল্যাণ নিশ্চিত করা- এ রকম কিছু অগ্রাধিকার বিষয়কে সামনে রেখে জনশক্তি খাতে এক ধরনের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা তৈরির প্রচেষ্টা ছিল। কিন্তু সেই প্রচেষ্টাতে বড় আঘাত হানে সম্প্রতি সাগর পথে অমানবিক মানব পাচারের ঘটনা। এ ঘটনার করুণকাহিনী গণমাধ্যমে এমনভাবে উঠে আসে যে, মানুষের মাঝে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়। বলতে দ্বিধা নেই সেই আঘাত, সেই ক্ষত এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।

ঠিক এমন সময়ে প্রবাসী কল্যাণ এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন খ্যাতনামা ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, লেখক- সর্বোপরি মননশীল মনের এক মানুষ নুরুল ইসলাম বিএসসি। প্রসঙ্গত বলতে হয় কারও কারও আগমনে মানুষের মাঝে নতুন স্পন্দন তৈরি হয়। মানুষ আশাবাদী হয়ে ওঠে। বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকা এ মানুষটির আগমন জনশক্তি খাতে নতুন আশাবাদ তৈরি করেছে। স্বপ্ন আর আশাবাদের কথা বলেছেন নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীও। প্রথম দিনেই প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী জনশক্তি রপ্তানি খাতের উন্নয়ন, দক্ষ জনশক্তি তৈরি, মানব পাচার বন্ধ এবং মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবের শ্রমবাজার বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। মানব পাচার বন্ধ প্রসঙ্গে বলেছেন, 'মানব পাচার বন্ধই আমার প্রথম চ্যালেঞ্জ। সাগরপথে অবৈধভাবে বিভিন্ন দেশে মানব পাচার বন্ধে কাজ করব।' এ বিষয়ে তিনি সবার সহযোগিতাও কামনা করেছেন। মন্ত্রীর এ অভিব্যক্তি ও উপলব্ধি অবশ্যই প্রশংসনীয়।

এ সময়ের একটি অন্যতম আলোচিত বিষয় মানব পাচার। গত কয়েকবছর ধরে শ্রমবাজার সঙ্কুচিত হওয়ায় অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। সংঘবদ্ধ দালাল চক্র বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে কমখরচে নানা বয়সী লোককে মালয়েশিয়ায় পাচার শুরু করলে বিষয়টি দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের নজরে আসে। গণমাধ্যমের বদৌলতেই সবাই দেখতে পায় কাদেরকে, কীভাবে কী প্রক্রিয়ায় বিদেশে নিয়ে যাওয়ার ফাঁদ পাতা হয়েছে। এটি সত্য এ ঘটনাকে কোনো একটি বা দুটি কারণ নিয়ে ব্যাখ্যা করে সমাপ্তি টানা যাবে না। নানা ধরনের অর্থনৈতিক, সামাজিক কারণ অবশ্যই এখানে অনুসঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে। তবে নতুন মন্ত্রী মহোদয় বিষয়টি নিয়ে যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন সেটা সন্তোষজনক। আসলেই আমরা বিদেশ যাওয়ার নামে আর কোনো নির্মম নির্যাতনের ঘটনা শুনতে চাই না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এ খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হলে অবশ্যই কিছু কিছু বিষয় সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। মন্ত্রী মহোদয়কে সে বিষয়ে অবশ্যই নজর দিতে হবে। তবে আমাদের সবার আগে মনে রাখতে হবে বিদেশের শ্রমবাজারে এখন দক্ষ শ্রমিকেরই চাহিদা রয়েছে। এ কারণে আমাদের দক্ষ শ্রমিক তৈরিতে মনোযোগী হতে হবে। ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন এ বিষয়টি অনেক আগে বুঝলেও আমরা বেশ সময় নষ্ট করে ফেলেছি।

বাংলাদেশের শ্রমবাজার অনেকদিন ধরেই অস্থির, এলোমেলো। মনে হচ্ছিল বিশ্ববাজারে যে প্রতিযোগিতা সেই প্রতিযোগিতায় আমরা পিছিয়ে পড়ছি। তবে এটি ঠিক আন্তর্জাতিক অনেক ঘটনাবলীর শিকারও আমাদের হতে হয়েছে। বিশেষ করে ইরাকে ধারাবাহিক অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ, লিবিয়াতে সৃষ্ট চরম বিশৃঙ্খলা, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়া, সৌদি আরবে নতুন শ্রমিক নেওয়ার পরিমাণ কমে যাওয়া- এ সবকিছুর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে আমাদের শ্রমবাজারে। যার ফলাফলও আমাদের বহন করতে হয়েছে। এর সামাজিক প্রভাবও দেখেছি। এখন সময় এসেছে আমাদের শ্রমবাজারটিকে গুছিয়ে নেওয়ার। এ ক্ষেত্রে মাননীয় মন্ত্রীকে অবশ্যই কয়েকটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যেসব শ্রমবাজার আমাদের জন্য সঙ্কুচিত হয়েছে সেগুলো পুনরায় সম্প্রসারণ করতে সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শুধু শ্রমিক পাঠালেই চলবে না, শ্রমিকদের স্বার্থকেও প্রাধান্য দিতে হবে। মালয়েশিয়াতে সম্প্রতি বিটুবি প্রক্রিয়ায় শ্রমিক যেতে পারবে বলে দুই দেশের মধ্যে সম্মতিসূচক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ৯ আগস্ট মালয়েশিয়া থেকে একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে। কিন্তু মালয়েশিয়াতে আমাদের যে শ্রমিকরা কাজ করতে গিয়েছে তাদের নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার শেষ নেই। চাহিদাপত্রের বাইরে মালয়েশিয়াতে যাওয়া শ্রমিকদের কারণে আমাদের শ্রমবাজারে ভয়াবহ দুর্গতি তৈরি হয়। এ কারণে মালয়েশিয়ার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সব বিষয়ে টেকসই আলোচনা হতে হবে। প্রথমত, শ্রমিকের বেতন যাতে আন্তর্জাতিক কাঠামো অনুযায়ী হয় সে বিষয়ে ভালো বোঝাপড়া করতে হবে। শুধু মালয়েশিয়া নয়, নতুন যে শ্রমবাজার তৈরি হবে অর্থাৎ লেবার রিসিভিং কান্ট্রিগুলোর সঙ্গে এ বার্গেনিংটা অব্যাহত রাখতে হবে।

প্রসঙ্গত বলতে হয়, ২০১১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত 'কলম্বো প্রসেস' এর আলোচনায় এটি অন্যতম এজেন্ডা ছিল। কলম্বো প্রসেসের চতুর্থ মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন বসেছিল ঢাকাতে।

এশিয়ার ১১টি শ্রমিক প্রেরণকারী দেশের মন্ত্রীরা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কলম্বো প্রসেসের মূল উদ্দেশ্য ছিল- ওভারসিস এমপ্লয়মেন্ট ইস্যুতে একে অপরের সঙ্গে মতবিনিময়, বিশ্বের অভিবাসন বাজার সম্পর্কে পর্যালোচনা এবং করণীয় ঠিককরণ, ওভারসিস এমপ্লয়মেন্টদের সমস্যা সমাধানে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ এবং কল্যাণ নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ। আলোচ্যসূচিতে আরও ছিল- সম্মানজনক ও নিরাপদ অভিবাসন, অভিবাসী শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার, নারী অভিবাসন ইত্যাদি। মন্ত্রী পর্যায়ের এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিল বাংলাদেশ, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, আফগানিস্তান এবং ভিয়েতনাম। কলম্বো প্রসেসের সিদ্ধান্তসমূহ অবশ্যই আমাদের মাথায় রাখতে হবে।

এদিকে আমাদের প্রবাসী রেমিট্যান্সের বড় উৎস সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অপরাপর দেশগুলোতে আমাদের জনশক্তি রপ্তানির হার সেভাবে বৃদ্ধি পায়নি। অভ্যন্তরীণ নানা পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসার অপব্যবহার ও প্রবাসীদের একটি ক্ষুদ্র অংশের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে সেখানে জনশক্তি প্রেরণ বছরান্তে বাড়েনি। ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে জনশক্তি প্রেরণ তাই উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসে। সে সময় চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে জনশক্তি প্রেরণ প্রায় থমকে গিয়েছিল। এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দূরদর্শিতার অভাবে দুবাইয়ে অনুষ্ঠেয় 'ওয়ার্ল্ড এঙ্পো ২০২০' কে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। আবার কাতারে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপ-২০২২ উপলক্ষে দেশটিতে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ কাজে লাগাতে জোরালো কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। অথচ এ দুটি দেশেই নিকট ভবিষ্যতে প্রচুর নির্মাণ শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে।

আমি আগেও বলেছি আমাদের জনশক্তি রপ্তানি খাতে ছোট-বড় অনেক ধরনের সমস্যা রয়েছে। অব্যবস্থাপনা, অসম প্রতিযোগিতা, অপ্রতুল জবাবদিহিতার অভাবও রয়েছে। এসব কারণে প্রতিনিয়ত আমাদের থেকে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো। এক শ্রেণির কর্মী প্রেরণকারী প্রতিষ্ঠানের অধিক মুনাফা অর্জনের মনোভাব এবং সরকারের প্রজ্ঞার অভাবেও আমরা জনশক্তি প্রেরণে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছি। যে যত কথাই বলুক আমরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুৎসই নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি করতে পারিনি। যদিও বিগত সময়ে আমরা হাজারো আশাবাদ শুনেছি কিন্তু এখন পর্যন্ত কার্যকর কিছু দৃশ্যমান হয়নি। আমি মনে করি, এ বাধা অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যেতে বেসরকারিভাবে জনশক্তি প্রেরণকারীদের সংগঠন বায়রার সঙ্গেও সরকারের একটা ভালো ঐকমত্য গড়ে তোলা প্রয়োজন। যে ঐক্যমতের মাধ্যমে সরকার বেসরকারি উদ্যেক্তাদের দিক-নির্দেশনা প্রদান করে এ খাতকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। মাননীয় মন্ত্রী সে উদ্যোগ গ্রহণ করে বিদেশে কর্মী প্রেরণের দ্বার আরও সুপ্রশস্ত করবেন বলে সবার আশাবাদ।

সবশেষে বলব, অভিবাসী শ্রমিকদের কারণেই আমাদের অর্থনীতি এক শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে। গায়ের রক্ত পানি করে তারা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। সেই রেমিট্যান্সের সুবিধা ভোগ করছে দেশের জনগণ। তবে অভিবাসনের নামে আমরা সাগর পথে কারও করুণ মৃত্যু চাই না। এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আরও সহযোগিতা, উৎসাহ ও প্রণোদনা দেওয়ার লক্ষ্যে মাননীয় মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি সঠিক কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন এমনটিই আশা করা হচ্ছে। তাহলেই আমাদের জনশক্তি খাতে ফিরিয়ে আসবে নতুন প্রাণচাঞ্চল্য। বাংলাদেশের শ্রমিকদের বিশ্ব শ্রমবাজারে কাজ করার আরও অবারিত সুযোগ তৈরি হবে। তৈরি হবে তাদের আর্থিক নিরাপত্তা। যা আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিসহ জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। তাই বিশ্ব শ্রমবাজারে সততা, দক্ষতা ও মর্যাদায় আরও উদ্ভাসিত হোক আমাদের এই প্রিয় দেশ বাংলাদেশের নাম।

লেখক : চেয়ারম্যান ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি ও অভিবাসন বিশ্লেষক।

[email protected]

 

সর্বশেষ খবর