সোমবার, ৩ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

রাজনকে পৈশাচিকভাবে হত্যা : মানবতার অপমান

সালমা আলী

রাজনকে পৈশাচিকভাবে হত্যা : মানবতার অপমান

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে শিশু রাজনকে বেঁধে নির্যাতনের দৃশ্য দেখে আমি হতবিহ্বল, মর্মাহত ও লজ্জিত। ভাবতে অবাক লাগে কোমলমতি শিশুটিকে কয়েকজন মানুষ নির্দয়ভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলল। মানুষের নৈতিকতা, মূল্যবোধ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। অপরাধীরা রাজনকে পিটিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, মোবাইলে সেই দৃশ্য ধারণ করে উল্লাসে মেতে ওঠে। এটা কি কোনো সিনেমার দৃশ্য যেটা আমরা অহরহ ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে দেখি ও পৈশাচিক উল্লাসে মেতে আনন্দ পাই। এ ঘটনা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। রাজনকে আমরা তার মায়ের কোলে আর ফিরিয়ে দিতে পারব কি? রাষ্ট্রীয় অনুশাসন, আইনশৃঙ্খলাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শিশু রাজনের প্রতি যে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে তাতে একটি বিষয় পরিষ্কার, তা হলো সমাজে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি আইনকানুনের কোনো তোয়াক্কা করে না। প্রায়শ ভয়ানক অভিজ্ঞতা আমাদের হচ্ছে, কিন্তু তা থেকে কোনো শিক্ষা আমরা নিতে পারছি না, ব্যর্থ হচ্ছি কঠোর হস্তে এমন নির্মম ও নৃশংস কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করতে।

সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে সমাজে বসবাসরত মানুষ একে অন্যের বিপদে-আপদে এগিয়ে আসেন। অথচ রাজনকে নির্যাতনের সময় তাকে উদ্ধারে কেউ এগিয়ে আসেনি। মৃত্যুর আগে এক ফোঁটা পানিও পান করতে পারল না শিশুটি। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে অকালে ঝরে গেল একটি তাজা প্রাণ। এমন ঘটনা আমাদের বাকরুদ্ধ করে ফেলে।

আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে সর্বত্র। অপরাধীরা প্রকাশ্যে এতটা বর্বর আচরণ করার সাহস কীভাবে পেল। বিষয়টি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমরা একটি অস্থির সময় অতিক্রম করছি। একটি নৃশংস ঘটনা ঘটলে তার পরপরই একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটার প্রবণতা ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও বিকৃত মানসিকতার কারণে অপরাধকারীরা নৃশংস ও নির্মম অপরাধের অনুকরণ করে অসুস্থ বিনোদনে মেতে উঠছে। সাম্প্রতিক সময়ে শিশু নির্যাতনের বেশ কিছু ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে, যাতে সমাজে শিশুদের প্রতি নির্দয় ও নিষ্ঠুর আচরণ ফুটে উঠেছে। ৪ জুলাই বরিশালে সমাজসেবা অধিদফতর পরিচালিত সরকারি শিশু সদনে দুই শিশুর ওপর অমানুষিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। আবার ১৬ জুলাই সাতক্ষীরায় দুই শিশুকে গাছের সঙ্গে বেঁধে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করা হয়। এসব ঘটনাই প্রমাণ করে সমাজে মানবিক মূল্যবোধ, শিশুদের প্রতি স্নেহ, মায়া-মমতার অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। যদিও রাজন হত্যার অভিযুক্ত আসামিদের আত্দপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রয়েছে, তথাপি আমার প্রথম প্রতিবাদ ছিল কোনো আইনজীবী যেন তাদের পক্ষে না দাঁড়ায়। এ ছাড়া আমার আর কি-বা করার ছিল। খুশির ঈদের ছুটিতে আমরা বারবার রাজনের কথা, তার বাবা-মার কথা মনে করেছি।

একজন শিশুকে এভাবে নির্মমভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করার পর হত্যাকারীরা কোনোভাবেই রেহাই পেতে পারে না। দেশের প্রচলিত আইনে হত্যাকারীদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৩০২ ধারা অনুযায়ী হত্যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং তদুপরি অর্থদণ্ড। আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতিতেও শিশুদের সুরক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ, ১৯৮৯ অনুযায়ী শিশুদের বেঁচে থাকার অধিকার স্বীকৃত। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিকের জানমাল ও মর্যাদা সুরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাছাড়া কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না। শিশু আইন, ২০১৩-তে আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু, আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশু ও ভুক্তভোগীদের জন্য আইনগত বিধান রয়েছে। অত্র আইনের ৬ ধারা অনুযায়ী একজন প্রবেশন কর্মকর্তা আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুকে থানায় আনা হলে থানায় আনার কারণ অবগত হওয়া থেকে শুরু করে শিশুটির সঙ্গে সাক্ষাৎ করা, তাকে সহযোগিতা প্রদানের বিষয়ে আশ্বস্ত করা, পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় সাধন, শিশুর পিতা-মাতার সন্ধান ও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ, জামিনের সম্ভাব্যতা যাচাইসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এ ছাড়া অত্র আইনে ভুক্তভোগীদের কাউন্সিলিং, পুনঃএকত্রীকরণের কথাও বলা হয়েছে। রাজন হত্যাকাণ্ডের মতো বর্বরোচিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সরকার, মিডিয়া ও সমাজের সচেতন সব শ্রেণি-পেশার লোকজনকে এ ব্যাপারে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। শিশু রাজন হত্যার ঘটনাটি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য চরম অবমাননাকর। রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিশেষ করে জালালাবাদ থানার পুলিশ এ ঘটনাকে সাধারণ চোর পেটানোর ঘটনা হিসেবেই চাপা দিতে চেয়েছিল। পরে বাধ্য হয়ে মামলা নিলেও পুলিশের গাফিলতির খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। অথচ জনগণের নিরাপত্তা ও জানমাল রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশের কাছে অধিক দায়িত্বশীল আচরণই কাম্য। এ ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের যে অঙ্গীকার করেছিলেন তা পালন করে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছেন। ইতিমধ্যে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। আমার দাবি, এর পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে আইনগত প্রক্রিয়ায় কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা ও জনসম্মুখে প্রকাশ করার মাধ্যমে এমন নজির স্থাপন করা হোক যাতে ভবিষ্যতে পুলিশ তার কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হওয়ার সাহস না পায়।

আমরা রাজনের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করি। এ হত্যাকাণ্ডের বিচার যেন দ্রুত হয় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আদালতে প্রতি কার্যদিবসে বিচার অনুষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করা জরুরি। অপরাধীরা প্রভাবশালী হওয়ার সুযোগে যেন কোনোভাবেই রেহাই পেয়ে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আর যেন কোনো শিশুর জীবনে এ ধরনের পৈশাচিক ও নির্মম হত্যাকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। রাজনের মতো বহু শিশু-কিশোর যারা গৃহশ্রমিক, বিড়ি ফ্যাক্টরি বা মোটর গ্যারেজে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে তাদের অনেকেই ঘরে-বাইরে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, যার অনেক সংবাদ আমরা পাই না। রাজনের বাবা-মা কি তাদের ছেলেকে ফিরে পাবে? তাদের সারা জীবনের হাহাকার কেউ কি দূর করতে পারবে? রাজনের জীবনের মূল্যকে কোনো কিছু দিয়েই পূরণ করা যাবে না। তারপরও তার বাবা-মা যেন ক্ষতিপূরণ পায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারছি না। প্রকৃত অপরাধী যত প্রভাবশালীই হোক না কেন, তার সঠিক বিচার করতে হবে। মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত মানুষের পক্ষেই কেবল শিশুদের প্রতি নৃশংস আচরণ করা সম্ভব। বিকৃত মানসিকতা দূর করতে হলে শিশুদের সব ধরনের নির্যাতন থেকে সুরক্ষায় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতার মূলোৎপাটন করতে হলে পরিবার ও কমিউনিটি পর্যায়ে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে মানুষের বিবেকবোধ জাগ্রত করা প্রয়োজন। ঘরে বাবা-মার যেমন দায়িত্ব রয়েছে শিশুর জন্য নারীবান্ধব ও শিশুবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং ছেলেমেয়ে কোথায় যাচ্ছে, কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে কিনা সেদিকে সজাগ থাকা, তেমনি স্কুলের শিক্ষকদেরও দায়িত্ব ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক শিক্ষা বা অপরাধ নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ শিক্ষা দেওয়া। এ ক্ষেত্রে সরকারের সমাজসেবা মন্ত্রণালয়, নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এখনই প্রয়োজন। পাশাপাশি যেসব শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে রয়েছে তারা যেন সম্ভাব্য অপরাধী না হয়ে ওঠে সে জন্য কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে তাদের মধ্যে ইতিবাচক শৃঙ্খলা শিক্ষার দরকার যেটা শিশু আইনে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে মনোবিজ্ঞান ও অপরাধবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ে একযোগে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করার সময় এখনই। আমরা চাই না আর কোনো শিশুর জীবনে মর্মান্তিক ও নির্দয় নির্যাতনের ঘটনা ঘটুক। প্রতিটি শিশু নির্যাতন ও সহিংসতামুক্ত পরিবেশে বেড়ে উঠুক- এটিই আমাদের প্রত্যাশা।

বাস্তবতা হচ্ছে, যুগোপযোগী অনেক আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই বললেই চলে। সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও মনিটরিংয়ের অভাবে এমনটা ঘটছে। নিষ্ঠুরতা ও পৈশাচিকতার মূল কারণগুলো বের করে পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এখনই। সেই সঙ্গে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগই হতে পারে এর সমাধান।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি।

 

 

সর্বশেষ খবর