মঙ্গলবার, ৪ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন

বিভুরঞ্জন সরকার

মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন

আগস্ট মাস শোকের মাস। বেদনার মাস। পনেরোই আগস্ট। জাতীয় শোক দিবস। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা-জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের এই দিনে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে তাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ইতিহাস থেকে তার নাম মুছে ফেলা এবং বাংলাদেশের রাজনীতিকে পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা শুরু হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়া সম্ভব হয়নি। ইতিহাসের যিনি স্রষ্টা, বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিয়ে যিনি এক অসাধারণ ইতিহাসের নির্মাতা হিসেবে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি ও পরিচিতি অর্জন করেছেন, তার নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার মতো রাজনৈতিক মূঢ়তা কোনোভাবেই জয়যুক্ত হতে পারে না, হয়ওনি। হবেও না। বঙ্গবন্ধুর চেয়ে অনেক বড় নেতা তার সময়ে ছিলেন। কিন্তু সবাইকে পেছনে ফেলে বা অতিক্রম করে কেন তিনি অনন্য ও অসাধারণ হয়ে উঠলেন তা নিয়ে লেখালেখি একেবারে কম হয়নি, হচ্ছে না। তার সাহস, বুদ্ধিমত্তা, দৃঢ়তা, দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িক মনোভাব সর্বোপরি তার মানবিক গুণাবলি নিয়ে স্তুতি করার মতো অনেক কিছুই আছে। তিনি আজীবন স্রোতের বিপরীতে চলেছেন, নিজেই সৃষ্টি করেছেন নতুন স্রোতধারা। বিরুদ্ধ পরিবেশকে অনুকূলে আনার জন্য তাকে কী নিরলস পরিশ্রম করতে হয়েছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা দরকার রাজনীতিসচেতন সবারই। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সব স্তরের নেতা-কর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের। আর এটা জানার পথ সুগম হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' প্রকাশ হওয়ায়।

উল্লেখ্য, শেখ মুজিব ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায় বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের অনুরোধে আত্মজীবনী লেখা শুরু করেছিলেন, যা শেষ করতে পারেননি। শৈশব থেকে আরম্ভ করে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক নানা ঘটনা- যার বেশির ভাগের সঙ্গে ছিল তার প্রত্যক্ষ ও নিবিড় সংশ্লিষ্টতা, তুলে ধরেছেন 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে। অর্থাৎ এই বইয়ে বিবৃৃত হয়েছে তার মাত্র ৩৪ বছর বয়সকালের ঘটনাবলি। অথচ ১৯৫৪ সালের পরই বস্তুত শেখ মুজিব ক্রমান্বয়ে এই ভূখণ্ডের রাজনীতির প্রাণপুরুষ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু তিনি যে এ রকমই হবেন, তাকে যে দাবিয়ে রাখা যাবে না- এটা বোঝা যায় ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত নিজের যে জীবন ছবি তিনি এঁকেছেন অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে, তা থেকেই। তিনি উড়ে এসে জুড়ে বসেননি। ইতিহাস দখল করেননি। নিজেই ইতিহাস তৈরি করেছেন। কৈশোর থেকেই তিনি মানুষের সঙ্গে থেকেছেন, মানুষের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, মানুষের স্বার্থরক্ষার জন্য প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ত্যাগের শিক্ষা নিয়েছেন এবং তার জন্যই পর্যায়ক্রমে তার উত্তরণ ঘটেছে, শেখ সাহেব, মুজিব ভাই, লিডার থেকে হয়েছেন বঙ্গবন্ধু, হয়েছেন জাতির জনক। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হতো তার জন্ম না হলে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার হাতে তিনি গ্রেফতার হওয়ায় যারা বলেন যে, জাতিকে অসহায় অবস্থায় ফেলে তিনি আত্মসমর্পণ করেছিলেন, তারা আসলে শেখ মুজিবের সাহস ও দৃঢ়তা সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই সেটা বলেন। জেল-জুলুম-অত্যাচারকে তিনি ভয় পাননি কিশোর বয়স থেকেই। তিনি যা করতে চেয়েছেন তা করা থেকে তাকে বিরত রাখার শক্তি কারও ছিল না। আত্মগোপনের রাজনীতি যে তিনি করেন না সেটাও স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছেন। স্কুলছাত্র থাকতেই পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনি। অন্যরা তার কাজকর্ম খুব পছন্দ না করলেও পিতা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন তার বড় ছেলে প্রিয় 'খোকা'র সব কাজের প্রশ্রয়দাতা। 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে শেখ মুজিব লিখেছেন : '...গোপালগঞ্জ শহরের কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি আমার আব্বাকে বলেছিলেন, আপনার ছেলে যা আরম্ভ করেছে তাতে তার জেল খাটতে হবে। তার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে, তাকে এখনই বাধা দেন। আমার আব্বা যে উত্তর করেছিলেন তা আমি নিজে শুনেছি। তিনি বলেছিলেন, দেশের কাজ করছে, অন্যায় তো করছে না; যদি জেল খাটতে হয়, খাটবে; তাতে আমি দুঃখ পাবো না। জীবনটা নষ্ট না-ও তো হতে পারে, আমি ওর কাজে বাধা দিবো না।' তবে একই সঙ্গে তার প্রতি বাবার পরামর্শ ছিল : 'বাবা, রাজনীতি করো আপত্তি করবো না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছো এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখো। Sincerity of purpose and honesty of purpose থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না।' একথা কোনো দিন আমি ভুলি নাই।

নিজের জন্ম ও পরিবার সম্পর্কে শেখ মুজিব লিখেছেন : 'আমার জন্ম হয় ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তারিখে। আমার আব্বার নাম শেখ লুৎফর রহমান। আমার ছোট দাদা খান সাহেব শেখ আবদুর রশিদ একটা এমই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের অঞ্চলের মধ্যে সেকালে এই একটা মাত্র ইংরেজি স্কুল ছিল, পরে এটা হাইস্কুল হয়, সেটি আজও আছে। আমি তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত এই স্কুলে লেখাপড়ার পর আমার আব্বার কাছে চলে যাই এবং চতুর্থ শ্রেণী গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হই। আমার মায়ের নাম সায়েরা খাতুন। তিনি কোনো দিন আমার আব্বার সঙ্গে শহরে থাকতেন না। তিনি সমস্ত সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন আর বলতেন, আমার বাবা আমাকে সম্পত্তি দিয়ে গেছেন, যাতে তার বাড়িতে আমি থাকি। শহরে চলে গেলে ঘরে আলো জ্বলবে না, বাবা অভিশাপ দেবে।...'

এরপর তিনি লিখছেন : '১৯৩৪ সালে যখন আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি তখন ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। ...১৯৩৭ সালে আবার আমি লেখাপড়া শুরু করলাম। এবার আর পুরনো স্কুলে পড়ব না, কারণ আমার সহপাঠীরা আমাকে পেছনে ফেলে গেছে। আমার আব্বা আমাকে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। ...আমি খেলাধুলাও করতাম। ফুটবল, ভলিবল ও হকি খেলতাম। খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলাম না, তবু স্কুলের টিমের মধ্যে ভালো অবস্থান ছিল। এই সময় আমার রাজনীতির খেয়াল তত ছিল না।...'

তাহলে রাজনীতির প্রতি তার আগ্রহ কবে এবং কীভাবে হলো? ১৯৩৮ সালে বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা একে ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ সফরে এলে তাদের সঙ্গে শেখ মুজিবের আলাপ-পরিচয় হয়। শেখ মুজিবকে পছন্দ হয় সোহরাওয়ার্দীর। শেখ মুজিবও মুগ্ধ হন সোহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিত্বে। শেখ মুজিব লিখেছেন : '১৯৩৯ সালে কলকাতা যাই বেড়াতে। শহীদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করি। ...শহীদ সাহেবকে বললাম, গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করব এবং মুসলিম লীগও গঠন করব। খন্দকার শামসুদ্দীন সাহেব এমএলএ তখন মুসলিম লীগে যোগদান করেছেন। তিনি সভাপতি হলেন ছাত্রলীগের। আমি হলাম সম্পাদক। মুসলিম লীগ গঠন হলো। একজন মোক্তার সাহেব সেক্রেটারি হলেন, অবশ্য আমিই কাজ করতাম। মুসলিম লীগ ডিফেন্স কমিটি একটা গঠন করা হলো। আমাকে তার সেক্রেটারি করা হলো। আমি আস্তে আস্তে রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ করলাম। আব্বা আমাকে বাধা দিতেন না, শুধু বলতেন, লেখাপড়ার দিকে নজর দেবে। লেখাপড়ার আমার একটু আগ্রহও তখন হয়েছে। কারণ কয়েক বছর অসুস্থতার জন্য নষ্ট করছি। স্কুলেও আমি ক্যাপ্টেন ছিলাম।'

পাকিস্তান আন্দোলনের পটভূমি সম্পর্কে শেখ মুজিব লিখেছেন : 'হিন্দু মহাজন ও জমিদারদের অত্যাচারে বাংলার মুসলমানরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। তাই মুসলমানরা ইংরেজদের সঙ্গে অসহযোগ করেছিল। তাদের ভাষা শিখবে না, তাদের চাকরি নেবে না, এসব করেই মুসলমানরা পিছিয়ে পড়েছিল। আর হিন্দুরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে ইংরেজকে তোষামোদ করে অনেকটা উন্নতির দিকে অগ্রসর হয়েছিল। যখন আবার হিন্দুরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল তখন অনেকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলে মরতে দ্বিধা করেনি। জীবনভর কারাজীবন ভোগ করেছে, ইংরেজকে তাড়ানোর জন্য। এ সময় যদি এসব নিঃস্বার্থ স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ত্যাগী পুরুষরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমানদের মিলনের চেষ্টা করতেন এবং মুসলমানদের ওপর যে অত্যাচার ও জুলুম হিন্দু জমিদার ও বেনিয়ারা করেছিল, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন, তাহলে তিক্ততা এত বাড়ত না। হিন্দু নেতাদের মধ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং নেতাজী সুভাষ বসু এ ব্যাপারটা বুঝেছিলেন, তাই তারা অনেক সময় হিন্দুদের হুঁশিয়ার করেছিলেন। কবিগুরুও তার লেখার ভিতর দিয়ে হিন্দুদের সাবধান করেছেন। এ কথাও সত্য, মুসলমান জমিদার ও তালুকদাররা হিন্দু প্রজাদের সঙ্গে একই রকম খারাপ ব্যবহার করত হিন্দু হিসেবে নয়, প্রজা হিসেবে। এ সময় যখনই কোনো মুসলমান নেতা মুসলমানদের ন্যায্য অধিকার দাবি করত, তখনই দেখা যেত হিন্দুদের মধ্যে অনেক শিক্ষিত, এমনকি গুণী সম্প্রদায় চিৎকার করে বাধা দিতেন। মুসলমান নেতারাও 'পাকিস্তান' সম্বন্ধে আলোচনা ও বক্তৃতা শুরু করার আগে হিন্দুদের বিরুদ্ধে গালি দিয়ে শুরু করতেন।...'

এরপর তিনি আরও লিখেছেন : 'অখণ্ড ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না, এটা আমি মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হিন্দু নেতারা ক্ষেপে গেছেন কেন? ভারতবর্ষেও মুসলমান থাকবে এবং পাকিস্তানেও হিন্দুরা থাকবে। সবাই সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের হিন্দুরাও স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাস করবে। ভারতবর্ষের মুসলমানরাও সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের মুসলমানরা যেমন হিন্দুদের ভাই হিসেবে গ্রহণ করবে, ভারতবর্ষের হিন্দুরাও মুসলমানদের ভাই হিসেবে গ্রহণ করবে।...'

নিজের অসাম্প্রদায়িক অবস্থান সম্পর্কে শেখ মুজিব লিখেছেন : 'আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান বলে কিছু নেই। সবাই মানুষ।' শেখ মুজিব ছিলেন একজন অকপট মানুষ। চালাকি ও ফাঁকিবাজি একদম পছন্দ করতেন না। স্পষ্টবাদিতা ছিল তার অন্যতম গুণ। নিজের সম্পর্কে তার নিজের মূল্যায়ন : 'আমি খুব রাগী ও একগুঁয়ে ছিলাম, কিছু বললে কড়া কথা বলে দিতাম। কারও বেশি ধার ধারতাম না। আমাকে যে কাজ দেওয়া হতো, আমি নিষ্ঠার সঙ্গে সে কাজ করতাম। কোনো দিন ফাঁকি দিতাম না। ভীষণভাবে পরিশ্রম করতে পারতাম। সেই জন্যই আমি কড়া কথা বললেও কেউ আমাকে কিছুই বলত না। ছাত্রদের আপদে-বিপদে আমি তাদের পাশে দাঁড়াতাম। কোন ছাত্রের কী অসুবিধা হচ্ছে, কোন ছাত্র হোস্টেলে জায়গা পায় না, কার ফ্রি সিট দরকার, আমাকে বললেই প্রিন্সিপাল ড. জুবেরী সাহেবের কাছে হাজির হতাম। আমি অন্যায় আবদার করতাম না। তাই শিক্ষকরা আমার কথা শুনতেন। ছাত্ররাও আমাকে ভালোবাসতো।'

অন্য প্রসঙ্গে তিনি আরও লিখেছেন : 'আমি মুখে যা বলি তাই বিশ্বাস করি। আমার পেটে আর মুখে এক কথা। আমি কথা চাবাই না। যা বিশ্বাস করি বলি। সে জন্য বিপদেও পড়তে হয়। এটা আমার স্বভাবের দোষও বলতে পারেন, গুণও বলতে পারেন।' এই দোষ-গুণ নিয়েই তো তিনি হয়ে উঠেছিলেন সাধারণ থেকে অসাধারণ। তিনি বিশ্বাস করতেন, 'মানুষকে ব্যবহার, ভালোবাসা, প্রীতি দিয়েই জয় করা যায়। অত্যাচার, জুলুম, ঘৃণা দিয়ে জয় করা যায় না।' এই বিশ্বাস তিনি আমৃত্যু লালন করেছেন।

যে পাকিস্তানের জন্য তিনি সংগ্রাম করেছেন, সেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেখতে পান, রাজনীতিটা সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য হচ্ছে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ছিল শেখ মুজিবের সহজাত প্রবৃত্তি। তাই নব প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্র যখন প্রতিষ্ঠাপূর্ব অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে থাকল, তখন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হলেন তিনি।

তিনি যেমন প্রতিবাদী ছিলেন তেমনি ছিলেন যুক্তিবাদী। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে বলে ঘোষণা দেওয়ার পর এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। জিন্নাহর বক্তব্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে তৎকালীন একজন ছাত্রনেতা বক্তৃতা করেছিলেন। শেখ মুজিব লিখেছেন : 'তার নাম (ঐ ছাত্রনেতা) আমার মনে নেই। তবে সে বলেছিল, জিন্নাহ যা বলবেন তাই আমাদের মানতে হবে। তিনি যখন উর্দুই রাষ্ট্রভাষা বলেছেন তখন উর্দুই হবে। আমি তার প্রতিবাদ করে বক্তৃতা করেছিলাম। আজও আমার এই একটা কথা মনে আছে। আমি বলেছিলাম, কোনো নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে। যেমন হযরত ওমরকে (রা.) সাধারণ নাগরিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি বড় জামা পরেছিলেন বলে। বাংলা ভাষা শতকরা ৫৬ জন লোকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংখ্যাগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। তাতে যাই হোক না কেন, আমরা প্রস্তুত আছি'। এই যে সাহস করে সত্য বলা, নেতা অন্যায় করলে প্রতিবাদ করা এটা কি আমাদের দেশের আজকের রাজনীতিতে একটুও দেখা যাচ্ছে? এমনকি শেখ মুজিবের হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগেও কি নেতার সামনে সত্য উচ্চারণের সৎ সাহস দেখা যাচ্ছে?

শেখ মুজিব ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একনিষ্ঠ ভক্ত ও সমর্থক। আজীবন তিনি তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি নিজেই লিখেছেন : 'তার (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী) স্নেহ থেকে কেউই আমাকে বঞ্চিত করতে পারে নাই'। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গেও একদিন কথা কাটাকাটিতে শেখ মুজিব দ্বিধা করেননি। কারণ নিজের অবস্থানের ন্যায্যতা নিয়ে তার মনে কোনো সংশয় ছিল না। তিনি লিখছেন : 'শহীদ সাহেব আমাকে হঠাৎ বলে বসলেন, Who are you? You are nobody. আমি বললাম, If I am nobody, then why you have invited me? You have no right to insult me. I will prove that I am somebody. Thank you sir.’ শেখ সাহেব কিছুটা রাগের মাথায় তার নেতার কাছে নিজের সম্পর্কে যা বলেছিলেন সেটা পরবর্তী সময়ে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি সত্যিই somebody হয়েছিলেন।

'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে শেখ মুজিব লিখেছেন : 'যে কোনো মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়, তারা জীবনে কোনো ভালো কাজ করতে পারে নাই- আমার বিশ্বাস।' এই বিশ্বাস থেকে তিনি কোনো দিন চুল পরিমাণ বিচ্যুত হননি, এই বিশ্বাসকে বুকে ধারণ করেই দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ- নিজের জীবন দিয়ে গেছেন। তার ত্যাগ ও সাধনার ফসল বাংলাদেশ। এই দেশে যারা এখনো ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করছে, স্বার্থের জন্য যারা অন্ধ হয়ে পড়ছে, তাদের বিরুদ্ধে একাগ্রতা ও সততার সঙ্গে লড়াই করে যাওয়া মুজিব আদর্শে বিশ্বাসী সবারই ব্রত হওয়া উচিত। জয়তু মুজিব। মুজিব চিরঞ্জীব।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

ই-মেইল: [email protected]  

 

সর্বশেষ খবর