শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

আদিবাসীদের ভূমি অধিকার

রোবায়েত ফেরদৌস

আদিবাসীদের ভূমি অধিকার

‘The LAND is the only thing in the world worth working for, worth fighting for, worth dying for, because it’s the only thing that lasts’ - Margaret Mitchell (Gone With The Wind)

মহামতী লেনিন বলেছিলেন, মানুষ তার পিতৃশোক ভুলতে পারে কিন্তু ভূমি হারানোর শোক কখনই ভুলতে পারে না। অস্ট্রেলিয়ার নর্দান টেরিটরির এক প্রবীণ আদিবাসী নেতার উক্তি : 'ভূমিই আদিবাসীদের অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু। ভূমি আমাদের ঠিকানা, অস্তিত্ব। ভূমি আছে বলে জীবন এত গতিময়। ভূমি জীবনের প্রতীক। এ ভূমি আমাদের, আমরাও ভূমির। ভূমিতে আমরা বিশ্রাম নিই। আমরা ভূমি থেকে আসি, আবার ভূমিতে ফিরে যাই।'

বিশ্বের পাঁচটি মহাদেশের ৯০টি দেশে কমপক্ষে পাঁচ হাজার আদিবাসী জাতির মানুষ বাস করছেন। তাদের জনসংখ্যা বিশ্বের মোট মানুষের প্রায় ৬%- সংখ্যার হিসাবে ৪০ কোটিরও বেশি আদিবাসী পৃথিবীতে বসবাস করেন- যারা কথা বলেন চার হাজারেরও বেশি ভাষায়। আদিবাসীরা সবাই মিলে পৃথিবীর ২০%-এরও বেশি ভূখণ্ডজুড়ে বাস করছেন এবং বিশ্বের ৮০%-এরও বেশি সাংস্কৃতিক এবং জীববৈচিত্র্য প্রতিপালন ও রক্ষা করে চলেছেন। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক যুগ থেকে বিশ্বের ৯০টিরও বেশি দেশে বসবাসকারী আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ওপর চলমান শতাব্দীব্যাপী বৈষম্য ও জাতিগত আগ্রাসন জাতিসংঘ স্বীকার করেছে। বাংলাদেশে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠী ছাড়াও প্রায় ৩০ লাখ জনসংখ্যার ৫০টিরও অধিক আদিবাসী মানুষ স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাস করে আসছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তাদের জীবন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও আশা-আকাঙ্ক্ষা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আদিবাসী জনগণের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। এ জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ লাখ মানুষ দেশের ৩৫টিরও অধিক জেলায় বাস করেন। এর মধ্যে তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ১৪ জাতির মানুষ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে বসবাস করছেন। আয়তনে এ তিন জেলা দেশের প্রায় এক-দশমাংশ এলাকাজুড়ে বিস্তৃত; এর বাইরে সমতলের ৩০টিরও বেশি জেলায় আদিবাসী জাতির মানুষ বসবাস করেন। বাংলাদেশ একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্র, যদিও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে একে ঠিক স্পষ্ট করে গ্রহণ করা হয়নি। বাংলাদেশের সংবিধানেও রাষ্ট্রের এই বহুত্ববাদী চরিত্র অনুপস্থিত। সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা, বসবাসরত সবাইকে বাঙালি বলে চিহ্নিত করে রাষ্ট্রীয় চরিত্রে 'বাঙালি মুসলমান'-এর আধিপত্যকে জোরদার করা হয়েছে; একক জাতীয়তাবাদের প্রাবল্যকে স্বাগত জানানো হয়েছে; রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক চরিত্র তৈরি করা হয়েছে এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য বৈচিত্র্য ও ভিন্নতাকে অস্বীকার করা হয়েছে; শাসকবর্গের এহেন উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক চেতনাজাত মানসিকতা জারি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসী জাতিগুলোর অস্তিত্বকে অস্বীকার করার যে কোনো জো নেই, তা শাসকবর্গও জানেন। বাংলাদেশে আদিবাসী ইস্যুটির প্রকৃতি তাই খুবই জটিল রূপ নিয়েছে; এর সঙ্গে রাজনৈতিক আদর্শ, ধর্মীয় মতাদর্শ ও আঞ্চলিক রাজনীতির বিভিন্ন দিকমাত্রা জড়িত। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে রাজনৈতিক আদর্শ থেকে আদিবাসী ইস্যুটিকে বিবেচনা করে, বিএনপি ঠিক সেভাবে দেখে না; আবার আদিবাসীদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কিংবা সাংবিধানিক অধিকার ও মানবাধিকারের বিষয়টিকে ইসলামী মতাদর্শের রাজনৈতিক দলগুলো যে দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করে বাম মতাদর্শের রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান তার বিপরীতে। আদিবাসী ইস্যুর সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর 'ভারতমুখীনতা' ও 'ভারতবিরোধী' রাজনৈতিক মনোভাবেরও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।

আদিবাসী অধিকার বিষয়ে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সনদ ও ঘোষণাপত্র যা আছে তা হলো- জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র, ২০০৭; নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদ এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সনদ, ১৯৬৬; আইএলও কনভেনশন নম্বর ১০৭ ও ১৬৯; শিশু অধিকার সনদ, ১৯৮৯; জাতিগত, নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের অধিকার ঘোষণাপত্র, ১৯৯২। এসব ছাড়াও সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র, ইউনেস্কোর বিভিন্ন সনদ ও ঘোষণা, ভিয়েনা বিশ্ব সম্মেলন, জীববৈচিত্র্য সনদ এবং আঞ্চলিক বিভিন্ন দলিলে আদিবাসীদের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, ইউএনডিপি, এডিবি, ইফাড, ডানিডা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ অনেকের আদিবাসী বিষয়ে পলিসি আছে। আদিবাসীদের অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রে আদিবাসীদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের কথা বলা আছে। এ ঘোষণাপত্রের ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে- 'আদিবাসীদের আত্দনিয়ন্ত্রণ অধিকার রয়েছে। এ অধিকারের বলে তারা স্বাধীনভাবে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান ও মর্যাদা নির্ণয় করে এবং স্বাধীনভাবে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সাধন করে।' এ ছাড়াও আদিবাসীদের ভূমির অধিকার, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর আদিবাসীদের অধিকার, ভাষা ও সংস্কৃতি এবং আদিবাসী জ্ঞানের ওপর অধিকারের বিষয় ঘোষণাপত্রে যুক্ত আছে। আদিবাসী ঘোষণাপত্রের ৪৬টি ধারার ১০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে- আদিবাসীদের জোর করে তাদের এলাকা বা ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না। ঘোষণাপত্রের ২৬ ধারায় বলা হয়েছে- যেসব ভূমি, এলাকা ও প্রাকৃতিক সম্পদ আদিবাসীরা বংশপরম্পরায় ঐতিহ্যগতভাবে ভোগদখল বা ব্যবহার করে আসছে, তার ওপর আদিবাসীদের অধিকার রয়েছে। আবার বলা হয়েছে- রাষ্ট্র এসব ভূমি, অঞ্চল ও সম্পদের আইনগত স্বীকৃতি প্রদান করবে এবং এ ধরনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে আদিবাসীদের রীতিনীতি, ঐতিহ্য ও ভূমি মালিকানা প্রথাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে। এ ছাড়াও আদিবাসীদের নাগরিকত্ব, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, অধিকারের সমতা, মর্যাদা, আদিবাসী নারী, তরুণ, শিশু ও প্রবীণদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্রে স্থান পেয়েছে। সদস্য ১৪৩টি দেশ এ ঘোষণাপত্রের পক্ষে ভোট দিয়েছে। ভোটদানে বিরত ছিল ১১টি দেশ, যার মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। এশিয়ারও প্রায় সব দেশ ঘোষণার পক্ষে ভোট দিয়েছে। পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ফিলিপাইন থেকে শুরু করে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ, এমনকি পাকিস্তান পর্যন্ত আদিবাসী ঘোষণাপত্রের পক্ষে ভোট দিয়েছে। প্রত্যাশা ছিল শাসকগোষ্ঠী এ সত্য মেনে নেবে যে, বাংলাদেশ একটি বহু ভাষা, বহু জাতি ও বহু সংস্কৃতির এক বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ এবং এর মধ্য দিয়ে সব জাতির পরিচয়, অধিকার ও সংস্কৃতিকে স্থান দেবে; এভাবেই রাষ্ট্র হয়ে উঠবে সবার; কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার যে বহুত্ববাদী নীতি বা বৈচিত্র্যের ভিতরে যে সংহতি তাকে নির্লজ্জভাবে পরিহার করে সংবিধানে ৯ অনুচ্ছেদে যুক্ত করা হয়েছে 'ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট বাঙালি জাতির' মতো অসত্য বাক্য। বাংলাদেশ কোনো একক ভাষা বা একক জাতির রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও আরও জাতির মানুষ বাস করেন এবং তারা বাংলায় নয়, তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় কথা বলেন। সংশোধিত সংবিধান এ দেশে বসবাসরত অন্য ভাষাভাষীর মানুষের মাতৃভাষাকেও পরিত্যাজ্য ঘোষণা করেছে। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও অন্য ধর্মগুলোর অস্তিত্ব স্বীকার করেছে কিন্তু দেশের অন্য জাতিগুলোর ভাষার অস্তিত্বের ব্যাপারে সংবিধান ভয়ঙ্কর শব্দহীন এবং নিশ্চুপ। একুশ আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে। বাংলাদেশে বসবাসরত ৫০টিরও বেশি জাতিগোষ্ঠীর নাগরিকরা প্রায় ৩০টির মতো ভাষায় কথা বলেন; সংবিধানে এর স্বীকৃতি নেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৪-এর ধারা ২২.১ ও ২২.২-এ আদিবাসীদের ভূমি সুরক্ষা, পার্বত্য চুক্তির অবশিষ্টাংশ বাস্তবায়নসহ তাদের জীবন ও জীবিকার উন্নয়নে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু আদতে এসব প্রতিশ্রুতি কর্পূরের মতো উবে যায় সিংহাসনের হাতলে হাত রাখলেই। বলা হয়, যাদের জন্য উন্নয়ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ থাকতে হবে; কিন্তু আদিবাসীদের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। খুব নীরবে জাতিগত নির্মূলীকরণের সব আয়োজন সারা দেশে চলছে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

 

সর্বশেষ খবর