মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

পথ ছেড়ে দাও, নয় সঙ্গে চল

পথ ছেড়ে দাও, নয় সঙ্গে চল

শারমিনী আব্বাসী

ফেসবুক এখন প্রায় সবারই আছে। বাবা নাম দিয়েছেন চন্দ্রমুখ। সুন্দর মুখচ্ছবি হলে ভালো। না হলে স্ট্যাটাস সম্বল। বিচিত্র জীবন নদীর স্রোতের মতোই বিচিত্র সব স্ট্যাটাস। হালনাগাদ খবর। ঘরের তরুণী পরিচারিকা হিরামণি চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আমার মেয়েকে ভাইবারে  মেসেজ পাঠায়।

‘মেয়েরা এয়ারটেলের মতো

হঠাৎ কাছে আসে

রবির মতো জ্বলে ওঠে

বাংলালিংকের মতো বদলে যায়

অবশেষে গ্রামীণফোনের মতো বহুদূর চলে যায়।’

আমি চমৎকৃত আর মেয়ে হেসেই আকুল। তার বাবার ড্রাইভার বিল্লালকে বিশেষ পছন্দ না, কিন্তু সে ছোকড়া তার ফেসবুক বন্ধু। স্ট্যাটাস আসে- ‘তুমি তেঁতুল আমি আচার, তুমি পাজেরো আমি কার, তুমি ধানক্ষেত আমি সার।’

সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ মানে ভালো দিন। চাষির জন্য তার পরিশ্রমের শস্যের জন্য ন্যায্যমূল্য। শ্রমিকের সঙ্গতিপূর্ণ মজুরি। মধ্যবিত্তের জন্য শহরের পরিকাঠামোর স্বাচ্ছন্দ্য। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, অন্যান্য উপযুক্ত সেবা পেতে গেলে সরকারি কর্মচারীকে ঘুষ দিতে না হয়। সেদিকে দেশ কতটুকু আগাচ্ছে জানি না। তবে যদিও দুঃখ করে বলি, বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।’ যদিও বলি ‘ফিরায়ে দাও সে অরণ্য লও হে নগর।’ কিন্তু জানি সময় শুধু সামনেই এগোয়। বিজ্ঞানের ঢিল আর পাটকেল দুটোই রয়েছে। ফেসবুক মন্দ নয়, যদিও বহুবার ডিঅ্যাক্টিভেট করে দিই। যখন দেখি অনেক কুশল বিনিময়ের প্রবাসী বন্ধু একদিন জানায় তোমাকে সেদিন আড়ং ক্যাফেতে দেখলাম। বিস্মিত আমি বললাম, তুমি ঢাকায় এসেছিলে। ডাকলে না কেন ক্যাফেতে? তার উত্তরটি নিষ্প্রয়োজন। মানুষ যদি মানুষকে গুহার আড়াল থেকে বন্ধুত্বের, সামাজিকতার, সহমর্মিতার, বন্ধন গড়তে পারত তবে সভ্যতা এগোত না। মানুষকে সৃষ্টিকর্তা সৃজন করেছেন যোদ্ধা হিসেবে। সম্মুখ সমর তার বীর পরিচয়। বিচিত্রার খ্যাতিমান সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী তার সহযোদ্ধাদের বলতেন- ‘যদি তিন মিনিটের বেশি ফোনে কথা বলতে হয়, তবে দশ টাকা খরচ করে রিকশা করে দেখা করে আস।’ বরের কাছে শোনা। দীর্ঘ নয় বছর বহুজাতিক মোবাইল ফোন গ্রামীণ আর রবিতে ছিলাম। দেশের উন্নয়নে এসব প্রতিষ্ঠানের ভূমিকায় আমারও বিনম্র অহংকার। কিন্তু কেন জানি সেলফোন জিনিসটিকে ভালোবাসতে পারিনি। আমার কাছে বৃষ্টিবাদলের গন্ধমাখা বাতাস অনেক কিছুর খবর নিয়ে আসে। তাতে দরকার পড়ে না সেল টু সেল কাভারেজ। পয়েন্ট টু পয়েন্ট কানেকশন। সেই বাতাস মন ভরে দেয়, হৃদয়ের ওপর বোলায় আশ্চর্য সবুজ পালক। নিসর্গের নীল টেলিফোনে শুনতে পাই সব খবরাখবর। খবর আসে মগবাজারে আগুন লেগেছে। দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে বাড়ি, টিনের দোকান, বস্তি। পুড়ে যাচ্ছে নিঃস্ব মানুষের নিঃস্বতার সম্বল একটা চোখ উল্টানো তরঙ্গ। সেই ঢেউতোলা টিনের বাক্সের ভিতর পার্ট পার্ট করে রাখা শাড়ি পুড়ছে, পুড়ছে কিছু সযতেœ রাখা টাকার নোট। পুড়ছে বিয়েতে উপহার পাওয়া সঞ্চয়পত্র। ল্যামিনেটেড সার্টিফিকেট কিংবা চিঠি। দমকলের গাড়ি ছোটে শহরে গুজব তুলে। খবরে নড়ে না এমন সব মানুষ গুজবে নেচে ওঠে। কোথায় আগুন? কি পুড়ছে? টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, নাকি মসজিদের মিনার। আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রতিটি মতবাদের লজিক আর অ্যান্টিলজিক তৈরি করার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা দান করেছে আমাদের। বিজ্ঞান চাইলে ক্ষুধাকে জাদুঘরে পাঠাতে পারত। পারত আমাদের উপহার দিতে দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী। কিন্তু সে-ও বন্দী বিশ্ব রাজনীতির নাগপাশে। গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে উৎক্ষেপিত আকাশযান অবলীলায় ঘুরে চলে। তারবিহীন মুঠোফোনে কথা বলে সম্বলহীন মানুষ। তাই আমি বিশ্বাস করি না বিজ্ঞানের এই অপারগতায়।

এসব কিছুর দায় কি শুধু ক্যাপিটালিজমের? বলা যায় বালকের লাল ঘুড়ির মতো সাম্যবাদকে ভোকাট্টা করেছে পুঁজিবাদ। কিন্তু এসব তর্কে আমরা ভুলে যাই মানুষের কথা। মুক্তি কে না চায়? ক্যালিফোর্নিয়ার লাল গোঁফওয়ালা লরিচালক আর হোচিমিন সিটির আইসক্রিমওয়ালির মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। দুজনেই চায় মুক্ত পৃথিবীর অমলিন বাতাস নিতে ফুসফুস ভরে। ভাবতে চায় এ বিশ্বায়নের রথে আমি নিশ্চয়ই যেতে পারি পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। কিন্তু সাধারণ মানুষের সব প্রত্যাশা আটকে গেছে বিশ্বরাজনীতি আর ষড়যন্ত্রের ঘেরাটোপের ফাঁদে। পৃথিবীর মাঝেই অনেক পৃথিবী তৈরি করেছি আমরা। বৈষম্য, শ্রেণি শৃঙ্খলিত, অবহেলায় ভরা, বিচ্ছিন্ন দুর্গগুলো ভাঙার সময় এসেছে। মানুষের মুক্তির মতবাদের যে রঙিন স্বপ্নটি দেখি তা হচ্ছে ক্ষুধাহীন পৃথিবী, বৈষম্যহীন সমাজ সব সংস্কৃতি ও কল্যাণের মিলনের বর্ণচ্ছটা। পেরুর লিমাতে দেখা অষ্টাদশী কিশোরীর বেণীর লাল ফুল বাংলাদেশের জুলেখার হাতের মুঠোফোনের মতোই রক্তিম। বিজ্ঞান যদি ভুলে যায় আÍশক্তিময় চৈতন্যের নির্ভীক নির্মাণই হওয়ার কথা ছিল বিজ্ঞানের স্বাক্ষর। কথা ছিল শুভঙ্করের ফাঁকিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মানবতার সপক্ষে বিশ্বজনীন উচ্চারণে নিজের নামটি লেখা। তবেই শেষ অবধি জানা যাবে সে নাচায় নাকি সে নৃত্যপাগল। সে কি উল্লাস নাকি মহাপ্রলয়ের রাহু গ্রাস? বিজ্ঞান যদি মানবতার কল্যাণের সপক্ষে অসফল হয় তবে বলতেই হবে- ‘যারে তুমি পিছে ফেলো, সে তোমারে টানিছে পশ্চাতে।’ মৃদু মন্থর প্রভাতে তাকিয়ে দেখি, তবু আমরা এগুচ্ছি। সাত সকালে পুরনো বাবুর্চি ইউনুসের আর্তি আসে। সে খুব অসুস্থ, বলল, আপা সাহায্য করেন। উত্তর করি, এস তাহলে। সে বলে আসতে পারব না আপা, ‘বিকাশ’ করে দেন। পদ্ধতিটি ওর জন্যই জেনে নিলাম। এরপর গুলশান ইউথ ক্লাবের মাঠে হাঁটার সময় যেসব ছেলে ফুটবল খেলে অবাক বিস্ময়ে তাদের সুঠাম একহারা ছিপছিপে হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখি। সুখের কথা, এরা কেউ গুলশান বনানীর সন্তান নয়। ভোরে খেলতে এসেছে শাহজাদপুর, বাড্ডা, নর্দ্দার ছেলেরা। এরাই উঠে দাঁড়াবে। হিরামণিরা মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে। বলতে পারছে, তোমার পথের সমান্তরালে আমারও একটি পথ আছে। বিজ্ঞানের, মানবতামুখী রথের জয়যাত্রায় জয়ী হোক সব মানুষের ধুলোর নিঃশ্বাস।

 

 

সর্বশেষ খবর