সোমবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

শারদীয় দুর্গোৎসব : সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নের উৎসব

তপন কুমার ঘোষ

শারদীয় দুর্গোৎসব : সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নের উৎসব

এসে গেল পূজার মৌসুম। ১৯ অক্টোবর শুরু হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। শেষ হবে ২২ অক্টোবর দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনের মধ্যদিয়ে।  এর কদিন পর অনুষ্ঠিত হবে লক্ষীপূজা। এর পর অপেক্ষা শ্যামাপূজার যা কালীপূজা নামেই বেশি পরিচিত। এরপর উদযাপিত হবে দীপাবলী উৎসব। এরপর ভ্রাতৃদ্বিতীয়া অর্থাৎ ভাইফোঁটা অনুষ্ঠান। কার্তিক মাসজুড়ে একের পর এক এসব উৎসব পালিত হবে। প্রসঙ্গত, দুর্গাপূজা শুধু বাঙালি হিন্দুদের উৎসব। অবাঙালিদের মাঝে এ পূজার প্রচলন নেই। এখন চলছে উৎসব উদযাপনের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। মৃৎশিল্পীদের দম ফেলার সময় নেই। পূজার কেনাটাকার স্বার্থে ব্যস্ত সবাই। আমাদের দেশে উৎসব পালনের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, তা দুর্গোৎসব হোক বা ঈদ উৎসব হোক। আমাদের ছোটবেলা থেকেই এটা দেখে আসছি, সব ধর্মের মানুষ মিলেমিশে উৎসব-আয়োজনে আনন্দ উপভোগ করেন। মসজিদে যখন আজান দেওয়া হয়, ঢাকের বাজনা তখন থেমে যায়। আমাদের সমাজে এই ধর্মীয় সহিষ্ণুতা চলে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। এটাই আমাদের ঐতিহ্য। ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’।

দুর্গাপূজা বিশেষ সম্প্রদায়ের। কিন্তু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা বাদে বাকি সব আয়োজনে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই শামিল হন। দুর্গোৎসবের দিনগুলোতে বড় শহরগুলো আনন্দের নগরীতে পরিণত হয়। মণ্ডপগুলোর দর্শনার্থীদের একটা উলে­খযোগ্য অংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের। একইভাবে ঈদ উৎসবেও অন্য ধর্মাবলম্বীদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয়। ঘনিষ্ঠজনদের কাছে ঈদ কার্ড পাঠানো হয়। মুঠোফোন ও ফেসবুকে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা হয়। বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীদের বাড়িতে ঈদের দাওয়াতে তারা অংশ নেন। ৫০ বছর আগে আমার ছেলেবেলায় দেখেছি প্রতিবেশী মুসলিমরা আগ্রহ নিয়ে আরতি অনুষ্ঠান দেখতে আসতেন। পূজামণ্ডপের সামনে ভিড়ের মধ্যে তারা মিশে যেতেন। রাতে হ্যাজাক লাইটের আলোয় হতো আরতি অনুষ্ঠান। গভীর রাত অবধি চলত এই অনুষ্ঠান।

তখনকার দিনে কলের গানের খুব প্রচলন ছিল। পূজামণ্ডপে গ্রামোফোন রেকর্ডে বাজানো হতো জনপ্রিয় সব বাংলা গান। এটাকে বলা হতো কলের গান। পূজা উপলক্ষে যাত্রাদলের বায়না করা হতো। গভীর রাতে স্থানীয় হাইস্কুল-সিঙ্গাসোলপুর কে.পি. ইনস্টিটিউশনের মাঠে যাত্রার আসর বসত। হিন্দু-মুসলিম মিলেমিশে সহপাঠীরা দলবেঁধে যাত্রাপালা দেখতে যেতাম। ছেলেবেলার সেই মঞ্জুরুল, হাবিব, জাহিদরা আজও স্মৃতিতে উজ্জ্বল। নাড়– খাওয়ার জন্য আমাদের বাড়িতে বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানাতাম। খুবই খুশি হতো তারা। মুসলিম বন্ধুদের মুখে কাকা-কাকীমা ডাক ভারি মিষ্টি  শোনাত। দাস বাড়ির মণ্ডপ চত্বরে রাতে থিয়েটার হতো। শখ করে পাড়ার ছেলেরা থিয়েটারে অভিনয় করতেন। অভিনয় করার জন্য তখনকার দিনে মহিলা শিল্পী পাওয়া যেত না। তাই ছেলেরাই মেয়ে সাজতেন। মহালয়ার দিন প্রত্যুষে আকাশবাণী থেকে প্রচার করা হতো চণ্ডীপাঠের অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুর বধ’। এই অনুষ্ঠান শোনার জন্য সাতসকালে আমাদের ঘুম থেকে ডেকে তোলা হতো। তখন সব বাড়িতে রেডিও ছিল না। যে বাড়িতে রেডিও ছিল, ওই বাড়ির আঙ্গিনায় পাড়ার সবাই একত্রে বসে আগ্রহ বাড়িয়ে শুনতেন এই অনুষ্ঠান। ওইসব বাড়ি থেকে ভেসে আসত বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের সুরেলা কণ্ঠের চণ্ডীপাঠ। খুবই জনপ্রিয় ছিল এ অনুষ্ঠান। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠের আকর্ষণ আজও এতটুকু কমেনি।

বিজয়া দশমীতে চিত্রা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হতো প্রতিমা। এটাকে বলা হতো ‘ভাসান’। এদিন স্থানীয় সিঙ্গাসোলপুর বাজারে বিরাট মেলা বসত। আশপাশের গ্রামের সব ধর্মের, সব বয়সী মানুষ জড়ো হতো মেলায়। খোলা আকাশের নিচে শামিয়ানা টানিয়ে সারিবদ্ধভাবে বসত অসংখ্য অস্থায়ী দোকান। প্রকৃত অর্থেই এটা ছিল মানুষের মিলনমেলা।

দুর্গোৎসব হচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নের উৎসব। দুর্গাপূজা উপলক্ষে কত পরিচিত-অপরিচিত মানুষের সমাগম হয় মন্দির প্রাঙ্গণে। অনেক অদেখা আত্নীয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। পরিচিতজনদের সঙ্গে কুশল বিনিময় হয়।  দেখা-সাক্ষাৎ ও আলাপচারিতার ফলে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়।

বিজয়া দশমীতে সবরকম বিবাদ-বিসংবাদ ভুলে যেতে হয়। সম্পর্ক ভালো করার দিন এটি। বিসর্জনের পর বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় করা হয়। বড়রা একে অপরের সঙ্গে আলিঙ্গন করে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। তবে ছোটরা বড়দের প্রণাম করে আশীর্বাদ চায়। দিন বদলে গেছে। জীবনটা বড্ড বেশি যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে। প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবীটা ছোট হয়ে হাতের মুঠোর মধ্যে চলে এসেছে। স্মার্টফোন নিয়ে সময় কাটে নতুন প্রজম্নের তরুণ-তরুণীদের। দেখা হয় ফেসবুকে। কথাও হয় ফেসবুকে। এটাই এখন স্বাভাবিক জীবনধারা। সামাজিক অনুষ্ঠানে তাই এখনকার তরুণ-তরুণীদের অংশগ্রহণে অনাগ্রহ। নতুন পৃথিবী। নিঃসঙ্গতার পৃথিবী। সমাজে থেকেও আজকের ছেলেমেয়েরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। উৎসব আনন্দের। সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমেই তা অর্থবহ হয়ে ওঠে।  নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্ব থেকে মুক্তি পেতে নতুন প্রজম্নের তরুণ-তরুণীদের আনন্দ উৎসব ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।  খেলার মাঠে হাজারো দর্শকের সারিতে বসে বিশ্বকাপ উপভোগ করার যে আনন্দ তার ছিটেফোঁটাও উপভোগ করা যায় না গৃহকোণে টেলিভিশনের পর্দায়। সবাইকে শারদীয় শুভেচ্ছা।

লেখক : ব্যাংকার।

ই-মেইল : [email protected]

 

 

 

 

সর্বশেষ খবর