মঙ্গলবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

স্থানীয় সরকার নির্বাচন : দলীয় বনাম দলবাজি

রোবায়েত ফেরদৌস

স্থানীয় সরকার নির্বাচন : দলীয় বনাম দলবাজি

ভালো যে, অবশেষে কোদালকে কোদাল বলা হলো। ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা, জেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশন- স্থানীয় সরকারের পাঁচটি স্তরেই এখন থেকে দলীয় পরিচয় ও প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন হবে। আগে আইনগতভাবে দলীয় পরিচয়ে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন না হলেও কার্যত তা তীব্র দলীয় রূপই পরিগ্রহ করত; স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে হওয়ার কথা থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলো তা মানত না; তারা প্রকাশ্যেই দলীয় মনোনয়ন দিত, প্রচার-প্রচারণা চালাত; আসলে বাংলাদেশের মতো রাজনীতিপ্রিয় জাতির পক্ষে স্থানীয় বা জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সম্পর্ককে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা প্রায় অসম্ভব।  মিডিয়াতেও নির্বাচনের ফলাফল দেওয়া হতো কিছুটা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে অর্থাৎ দলভিত্তিক; যেমন, বলা হতো সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ‘এতটি’ আসন আর বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী ‘এতটি’ আসনে জয় পেয়েছে। শুধু দলীয় প্রতীক ব্যবহারের সুযোগ তখন থাকত না। এখন থেকে দুটোই থাকবে- দলীয় প্রতীক ও দলীয় পরিচয়। এ লক্ষ্যে সরকার ওই পাঁচটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের আইন একযোগে সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি করেছে; জাতীয় সংসদের সামনের সেশনে এ অধ্যাদেশটি তোলা হবে এবং তখন তা আইনে পরিণত হবে। দেশে ইউনিয়ন পরিষদ ৪ হাজার ৫৫৩টি, উপজেলা ৪৮৮টি, পৌরসভা ৩২৩টি, জেলা পরিষদ ৬৪টি এবং সিটি করপোরেশন আছে ১১টি। দলীয় পরিচয় ও দলভিত্তিক প্রতীক নিয়ে দেশের প্রথম স্থানীয় নির্বাচনটি হতে যাচ্ছে আগামী ডিসেম্বরের পৌরসভা নির্বাচনে; এর পরে হবে ইউনিয়ন পরিষদ। সংশোধিত আইনে বলা হয়েছে, মেয়র, চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের দলীয় মনোনয়ন ও দলীয় প্রতীক থাকতে হবে। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও সুযোগ থাকবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার, নির্বাচন কমিশন তাদের জন্য বিধিবিধান ঠিক করবে।

সরকারের যুক্তি ও দুগ্ধপোষ্য শিশু : সরকারের পক্ষ থেকে এই মৌলিক সংশোধনীর পেছনে যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, যেহেতু স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরাই অংশ নিয়ে থাকেন, তাই চলমান স্ববিরোধিতার কোনো প্রয়োজন নেই। বলছি নির্দলীয় কিন্তু করছি দলীয় নির্বাচন, তার চেয়ে বলা ও করা দুই ক্ষেত্রেই দলীয় পরিচয়ে নির্বাচন করাই বাঞ্ছনীয়। সরকারের তরফে আরও বলা হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে সরকার তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতায়ন এবং দেশে রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করবে। কিন্তু আসলেই কি তাই? যেখানে ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনকে দেশে-বিদেশের অধিকাংশ মানুষ অসুষ্ঠু, একতরফা ও পক্ষপাতযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে; যেখানে শাসকবর্গ নামকাওয়াস্তে ‘মহাবিতর্কিত’ ওই নির্বাচন করে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে আছে, সেখানে তারা তৃণমূলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পরিবর্তন এনেছেন, দুগ্ধপোষ্য শিশুটিও সরকারের এহেন সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। সূর্যের চেয়ে বালুর তাপ বেশি- সরকার যা বলে পারিষদ বলে এর শতগুণ। সরকারের বশংবদরা এর পক্ষে হুক্কা-হুয়া করছেন এই বলে যে, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ বড় গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হয় এবং ওই দুটি দেশের উদাহরণ দেওয়ার কারণ, সরকারের স্তাবকরা বলছেন, বাংলাদেশের বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং এর প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামো নাকি ওই দুটি দেশের অনুরূপ। পাঠক বুঝুন, নারকেলের জোড়াও জোড়া আর সুপুরির জোড়াও জোড়া! ওই সব দেশে আমাদের মতো রাজনৈতিক ‘অপচর্চা’ হয় না; প্রশাসন, পুলিশ কিংবা নির্বাচন কমিশন সেখানে পুরোপুরি সরকারি/দলীয় প্রভাবমুক্ত; বিপরীতে বাংলাদেশে নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে দাঁড়ানোই শেখেনি বরং তারা ভীষণ ও তীব্রভাবে ‘সংকীর্ণ দলবাজি’র শিকার। ভারত কিংবা যুক্তরাজ্যে ৫ জানুয়ারি মার্কা নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকা কি আদৌ সম্ভব হতো? পাঠক, আপনারাই বিবেচনা করুন।   

রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটির প্রতিক্রিয়া : বিএনপি তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, স্থানীয় নির্বাচন দলীয়ভাবে করার উদ্যোগ সরকারের একটি অসৎ পরিকল্পনা এবং এটি মোটেও বাস্তবসম্মত নয়। তারা বলেছে, মেয়াদোত্তীর্ণ হলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এটি সরকারের একটি উপরচালাকি, যাতে করে সরকার পছন্দমাফিক দলীয় লোকদের এখানে নির্বিচারে নিয়োগ দিতে পারে। বিএনপি মনে করে, এর ফলে স্থানীয় সরকারে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকার ধারাবাহিকতাও ক্ষুণ হবে এবং বাংলাদেশের মতো বিভাজিত সমাজ ও রাষ্ট্র তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত আরও বাজেভাবে বিভক্তির শিকার হবে। নারীদের পক্ষে দলীয় মনোনয়ন জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়বে, ফলে বর্তমানে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীর স্বতঃপ্রণোদিত অংশগ্রহণও কমে যাবে। সংকীর্ণ দলীয় পরিচয়ের কারণে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নাগরিকদের সম্পত্তির ওয়ারিশ নির্ধারণ, তাদের নাগরিক সনদ ও চারিত্রিক প্রত্যয়নপত্রসহ দৈনন্দিন সাধারণ নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তিতে ভোগান্তি আরও বাড়বে; কারণ নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে অন্য দলের মানুষদের জন্য কাজ করতে চাইবে না। অন্যদিকে ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে; তারা মনে করে, এর ফলে আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে তৃণমূলে অন্যান্য রাজনৈতিক দল সংগঠিত ও শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ পাবে। সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকে সুজন  তার প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছে, এই উদ্যোগ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করবে এবং ক্ষমতাসীন দলই স্থানীয় সরকার গ্রাস করে ফেলবে। এ ছাড়া প্রভাবশালী, বিত্তশালী ও রাজনৈতিক দাপটে থাকা খারাপ লোকের নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ প্রশস্ত হবে (প্রথম আলো, ১৩ অক্টোবর, ২০১৫)। এই সংশোধনীর সবচেয়ে সরাসরি আঘাত যে রাজনৈতিক দলের ওপর আসবে সেটা জামায়াতে ইসলামী। কারণ আইন সংশোধনের পর বর্তমানে নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলই কেবল স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। ২০১২ সালের ১ আগস্ট মহামান্য হাইকোর্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন; এর বিরুদ্ধে জামায়াত আপিল করেছে, যা এখনো বিচারাধীন। তবে এটা তো ঠিক যে, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে সংবিধান বা আইনে কোনো বাধা ছিল না, এটি ছিল একটি প্রথা/ঐতিহ্য। আবার সামরিক শাসনামলের বিরাজনীতিকরণের একটি কৌশলও বটে।

কিছু বিবেচ্য বিষয় : স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে কার্যকর করে তুলতে, আমার প্রতীতি, কিছু বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক। যেমন, নিবন্ধন পদ্ধতি ও নিবন্ধনের নীতিমালা আলাদা সংসদ নির্বাচনের মতো হওয়া বাঞ্ছনীয় হবে না; কারণ স্থানীয় পর্যায়ে যেসব রাজনৈতিক দল থাকে তাদের জন্যও নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ অবারিত থাকতে হবে। যেমন- পার্বত্য চট্টগ্রামে জনসংহতি সমিতি একটি রাজনৈতিক দল; তারাও যাতে অংশ নিতে পারে তার ব্যবস্থা থাকতে হবে। নতুন এ ব্যবস্থাটির যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ দরকার। দলের সঙ্গে দলবাজি, দলীয়করণ আর দলতন্ত্রের পার্থক্য চিহ্নিত করা জরুরি। আমরা রাষ্ট্রকে সরকারে, সরকারকে দলে, দলকে মাস্তানিতে ‘রিডিউসড’ বা ‘সংকুচিত’ করে ফেলি; সরকার, রাজনীতি, প্রশাসনের স্বীকৃত বিভাজনকে গুলিয়ে ফেলি; এ জন্য প্রয়োজন শেকড় থেকে শিখর পর্যন্ত সুষ্ঠু, গঠনমূলক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা করা। দলীয় নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য হওয়ার আশঙ্কা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়; মনোনয়ন বাণিজ্য রোধে তাই ফুলপ্রুফ সিস্টেম তৈরি করতে হবে। সব নির্বাচনে সৎ, যোগ্য ও কমিটেড প্রার্থীদের মনোনয়ন নিশ্চিত করতে হবে- যারা নির্বাচিত হওয়ার পর সিটিজেন চার্টার মেনে চলবেন এবং জনগণের জন্য সেবার মান বাড়াতে কাজ করবেন। নির্বাচিতরা যেন নির্বাচনী ইশতেহার মেনে সার্ভিস ডেলিভারি দিতে নিরলস কাজ করে যাবেন তার গ্যারান্টি ক্লজ থাকতে হবে। স্থানীয় সরকারের কাজে, বাজেট প্রণয়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে; ‘ওপেন বাজেট’ এবং ‘পাবলিক হিয়ারিং’র ব্যবস্থা চালু করতে হবে। যতদিনের জন্য জনগণ তাদের ম্যান্ডেট দিবে, ততদিন তাদের কাজে স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের সময় সব দল যাতে অংশ নেয় তার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমতল ক্ষেত্র ও সমান সুযোগ নির্মাণ করতে হবে। আশঙ্কা যে, সব জায়গায় প্রার্থী হতে বড় দলগুলোর ভিতরে নিজস্ব প্রতিদ্বন্দ্বিতা এত তীব্র হবে যে, তা সামাল দেওয়াই কঠিন হয়ে পড়বে; ঠিকমতো ম্যানেজ করতে না পারলে মনোনয়ন নিয়ে খুনোখুনি, হামলা-মামলা, জ্বালাও-পোড়াও কয়েকগুণ বেড়ে যেতে পারে। বিষয়টিকে এখন থেকেই সিরিয়াসলি নিতে হবে। প্রতিটি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া বা প্রতিনিধিত্বকারী দলসমূহ আনুষ্ঠানিকভাবে যাতে তাদের মনোনীত প্রার্থীদের ভালো-মন্দ কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেন সে ব্যবস্থা করতে হবে। সব থেকে বেশি দরকার, চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা। বছরের পর বছর একজনই দলীয় প্রধান, সব ক্ষমতা তার হাতেই  কেন্দ্রীভূত- এ অবস্থা পাল্টাতে হবে; দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা শুরু করতে হবে।  ভুলে গেলে ভুল হবে যে, তৃণমূল তথা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের চর্চা ও বিকাশ না হলে রাষ্ট্র ও সমাজে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া কখনোই সম্ভব নয়।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

সর্বশেষ খবর