বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

লিউনার্দো দ্য ভিঞ্চি ও এক জোড়া কালো জুতো

লিউনার্দো দ্য ভিঞ্চি ও এক জোড়া কালো জুতো

সাইফুর রহমান

স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ কাঁচের শার্সি ভেদ করে জুতো জোড়ার সৌন্দর্য যেন ঠিকরে বেরুচ্ছিল। জুতো জোড়া শো-কেসটির ভেতর লম্বালম্বি ও তীর্যকভাবে এমন করে সাজিয়ে রাখা যেন এর সৌন্দর্য, সৌকর্য ও রূপ কিছুতেই শৌখিন খদ্দেরের চোখ এড়িয়ে না যায়। অতি সহজেই পণ্যটি অবলোকিত হয়। অনিবার্যভাবেই জুতো জোড়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, এর সৌন্দর্যে তো আকৃষ্ট হলাম সেটা দ্বিধাহীনভাবেই বলা যায়, তবে তার চেয়ে বেশি অবাক হলাম জুতো জোড়ার ভিতরের সুখতলায় যে লেখাটি রয়েছে সেটা দেখে। সেখানে শৈল্পিকভাবে লেখা রয়েছে ‘দ্য ভিঞ্চি’ অর্থাৎ জুতো জোড়ার ব্রান্ড হচ্ছে- দ্য ভিঞ্চি। নির্ণিমেষ তাকিয়ে জুতো জোড়া দেখছিলাম আর ভাবছিলাম এর ব্রান্ড দ্য ভিঞ্চি হওয়ার কী কারণ হতে পারে। আমি জানি মধ্যযুগে বলতে গেলে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির হাত ধরেই ইউরোপে রেনেসাঁ যুগের সূচনা শুরু হয়েছিল। ‘মোনালিসা’ ‘দ্য লাস্ট সাপার’ সেই সঙ্গে আরও বেশ কিছু বিখ্যাত সব পেন্টিংস ছাড়াও কম-বেশি ২০০ জিনিস আবিষ্কার করেছিলেন দ্য ভিঞ্চি। তার মধ্যে আধুনিক কামান, হেলিকপ্টার, মেশিনগান, প্যারাসুট, সমুদ্রের নিচে ঘুরে বেড়ানোর জন্য আমরা যে ড্রাইভিং স্যুট পরি সেটাও আবিষ্কার করেছিলেন ভিঞ্চি। ভাবতেই অবাক লাগে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে দ্য ভিঞ্চি কী করে এতসব আধুনিক জিনিসপত্রের ডিজাইন করেছিলেন। সে জন্য অনেকেরই ধারণা তিনি না কী এসেছিলেন ভিন গ্রহ থেকে অর্থাৎ তিনি ছিলেন একজন এলিয়েন। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ওপর কম করে হলেও অর্ধডজন বই আমার সংগ্রহশালায় আছে। ভিঞ্চিকে নিয়ে সার্জ ব্রোমলে ও কিং রশের বই দু’টি অনবদ্য।

এছাড়া বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত মোবাশ্বের আলীর বইটিও বেশ চলনসই। কিন্তু কোথাও দ্য ভিঞ্চির জুতো আবিষ্কারের কথা কিছু লেখা নেই। মানব সভ্যতায় জুতো পরার প্রচলন হয় যীশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় সাত থেকে আট হাজার বছর আগে। তারপর সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচি ও মর্জিমাফিক পরিবর্তিত হয়েছে জুতোর ধরন ও আকার আকৃতি। মনের মধ্যে একরকম খটকা কিন্তু থেকেই গেলো ভিঞ্চির সঙ্গে জুতোর কী সম্পর্ক। সে যাই হোক এক মনে জুতো জোড়া দেখছিলাম বলে দক্ষ বিক্রেতার মতো দোকানি এসে শো-কেসের ভেতর থেকে জুতো জোড়া বের করে আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল- “ব্রাজিল থেকে আমদানি করা এই জুতো জোড়া অতি উৎকৃষ্ট এবং আরামদায়ক।” নকশা কাটা দ্য ভিঞ্চি লেখাটির নিচে ছোট ছোট করে লেখা- একদম খাঁটি চামড়ার এবং শতভাগ হাতে তৈরি। সেই সঙ্গে কবেকার মডেল সন তারিখ সব উল্লেখ করা। জীবনে ঢেড় দামি দামি জুতো দেখার এবং কখনো সখনো পরারও সুযোগ ঘটেছে কিন্তু এক জোড়া জুতোর ভেতর যে এত কিছু লেখা থাকতে পারে তা আগে কখনো খেয়াল করিনি। জুতো জোড়ার দাম হাঁকা হলো ছ’হাজার রুপি, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাড়ে সাত হাজার টাকা। আমরা তিনজন মিলে কলকাতায় বেড়াতে এসেছি কয়েক দিন। আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু ব্যারিস্টার মীর হেলাল, বন্ধুপ্রতিম অনুজ লেখক ও কলামিস্ট ওমর আব্দুল্লাহ সাইফ ও আমি, সঙ্গে এখানে এসে জুটেছে আমাদের এক ভারতীয় বন্ধু বিপ্লব দাস। আমার আসার কারণ মূলত দুটি- কলকাতায় রবীন্দ্র সদনে চলছে বাংলাদেশি প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত বই নিয়ে বইমেলা। সেখানে অংশ নেয়া এবং দ্বিতীয়টি দীর্ঘদিন ধরে কিছু দুষ্প্রাপ্য বইয়ের একটি অর্ধশত তালিকা প্রস্তুত করেছিলাম সেই বইগুলো কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া থেকে খুঁজে খুঁজে কেনা। তালিকা ধরে পঞ্চাশ ষাটটি বই কিনতে গিয়ে পকেট থেকে বেরিয়ে গেল প্রায় হাজার পনের রুপি। পকেট একেবারে হালকা। অতএব বেনিয়ার জাতের যথার্থ উত্তরসূরী দোকানি বেচারা যতই ঘুরিয়ে বাড়িয়ে জুতো জোড়া দেখাক না কেন এ মুহূর্তে আমার সেটা কেনার সামর্থ্য নেই। কলকাতা আসা হতোই না প্রায় বলা যায়। এসেছি মীর হেলালের পৃষ্ঠপোষকতায়। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির যেমন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ইতালির বিখ্যাত ধনী মেডেচি পরিবার। এ জন্যই বোধকরি এতসব জগৎ বিখ্যাত ছবি ও নানা কিছু আবিষ্কার করা ভিঞ্চির পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। অন্যদিকে আমার পৃষ্ঠপোষক ভবিষ্যতে ভালো কিছু লিখব এ ভেবে পৃষ্ঠপোষকতা করতে রাজি হয়েছে বলে আমার ধারণা। ওঁর বদান্যতায় গ্রান্ড অবেরয়ের মতো পাঁচতারকা হোটেলে আছি। নিত্যদিন কলকাতার নামিদামি সব ভোজনালয়ে আহার্য সম্পাদন করছি, দিনগুলো মন্দ কাটছে না, বলা যায়।

দোকানি এবার জুতো জোড়া নিজেই দেখাতে শুরু করল। আমি বললাম, আরে করছেন কী? আমাকে জুতোর পদতল অর্থাৎ সোল দেখাচ্ছেন ভালো কথা কিন্তু খবরদার কোনো আরবকে কিন্তু এ কাজ কখনো করতে যাবেন না। দোকানি বিস্ময়াভিভূত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। আমি বললাম আরব সংস্কৃতিতে কিন্তু জুতোর সোল অর্থাৎ পদতল দেখানো বেশ ভালোরকমের মর্যাদা হানিকর ও অসম্মানজনক কর্ম। এ জন্যই মুসলিম দেশগুলোতে বিশেষ করে আমাদের দেশেও কাউকে হেয় করতে বেশিরভাগ সময়ই জুতো ব্যবহার করা হয়। প্রাশ্চাত্য দেশগুলোতে কিন্তু ঠিক এর উল্টো। আমি যখন বিলেতে পড়ালেখা করতাম তখন দেখেছি আমার বিদেশি বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই ব্রিটিশ পতাকা আঁকা সেন্ডেল পায়ে নির্বিকারচিত্তে সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ তাকে কখনো কারও দ্বারা তিরস্কৃত হতে দেখিনি। পবিত্র বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী কোনো বস্তুর তুচ্ছতা কিংবা মূল্যহীন বোঝাতে জুতো ব্যবহৃত হয়। আবার সেই একই বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট অনুযায়ী যদি কারও পা থেকে জুতো খুলে নেওয়া হয় তবে বুঝতে হবে যে, যার পা থেকে জুতো খুলে নেওয়া হলো সে মূলত ওই ব্যক্তির দাস হিসেবে গণ্য হলো। প্রাচীন যুগে ইহুদি ধর্মে বিচারকার্য পরিচালনার সময় যদি বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে থেকে কেউ তার  পায়ের জুতো খুলে ফেলত তবে বিচারকরা ধরে নিতেন যে ওই ব্যক্তি তার আইনগত অধিকার থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। গ্রিক সংস্কৃতিতে খালি জুতো মৃত্যুর প্রতীক। বাড়ির বাইরের দেয়ালে একজোড়া জুতো হেলান দিয়ে রাখা মানে হচ্ছে সেই বাড়ির কোনো ছেলে যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিহত হয়েছে। আমেরিকায় নাইন-ইলেভেনের দশম বার্ষিকীতে টুইন টাওয়ারে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য ও সমবেদনা জানাতে সেখানে তিন হাজার জোড়া খালি জুতো রাখা হয়েছিল। হেলাল ও সাইফের পুনঃপুনঃ উপরোধ সত্ত্বেও জুতো জোড়া না কিনেই বের হয়ে এলাম কলকাতার নামকরা জুতোর দোকান মেট্রো সু স্টোর থেকে। বেলা তখন প্রায় মধ্যাহ্ন। বাইরে ভাদ্রের ঝামাঘষা রোদ। রোদের তপ্ত আলোয় সব কিছু যেন পুড়ে যাচ্ছে।

আমরা তিনজন রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম বটে কিন্তু আমার চোখ জোড়া রাস্তায় প্রবাহমান জনস্রোতের মানুষগুলোর পায়ে জুতোর ওপর আটকে যাচ্ছিল বারবার। কত ধরনের মানুষ তার চেয়ে অবাক করা বিষয়, তাদের পায়ে কত রঙের এবং কত রকমের জুতো- পাম্পসু, অক্সফোর্ড সুজ, স্যান্ডেল ট্রেইনার, চটি, চপ্পল, লোফারস, স্লিপারস বুটজুতো আরও কত বাহারের জুতো যে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

বিভিন্ন ধরনের জুতোর নাম নিয়েও আমাদের মধ্যে রয়েছে বিস্তর বিভ্রান্তি। যেমন আমরা সাধারণত  দু-ফিতেওয়ালা রাবারের স্পঞ্জকে বলি স্যান্ডেল কিংবা স্লিপার আসলে স্যান্ডেল বলতে বুঝায় চামড়ার তৈরি পিছনে ফিতে ছাড়া কিংবা ফিতেওয়ালা যে কোনো জুতো। অন্যদিকে স্পঞ্জ যদিও ইংরেজি শব্দ কিন্তু এর আধুনিক ইংরেজি সংস্করণ হলো ‘ফ্লিপফল্প’ হাঁটার সময় মেঝেতে চপর চপর এরকম শব্দ থেকেই এই নামের উৎপত্তি। এই স্পঞ্জ কিংবা চপ্পলের জন্ম প্রাচীন মিশরে খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ১৫০০ বছর আগে। পরবর্তীতে এর ব্যাপক প্রচলন শুরু হয় জাপানে। তবে এটা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। আমেরিকান সৈন্যরা জাপান থেকে যখন আমেরিকা ফিরে আসেন। প্রায় প্রত্যেকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন এক জোড়া করে এই দু-ফিতেওয়ালা ফ্লিপফল্প। এরপর ষাটের দশক থেকে  উত্তরোত্তর এর জনপ্রিয়তা বাড়তেই থাকে। এমনকি এখন হোয়াইট হাউস ঘুরে দেখতে গেলেও নিজের দামি জুতো জোড়া খুলে ফেলে পায়ে গলিয়ে নিতে হয় সস্তা দামের এই ‘ফ্লিপফল্প’। আবার আমরা দৌড়ানোর জন্য যে ট্রেইনার পরি সেটাকে বলি কেড্স, আসলে কেডস হচ্ছে একটা জুতো কোম্পানি অনেকটা বাটার মতো। কেডস নামক এই জুতো কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠিত হয় আমেরিকার মিশিগানে ১৯১৬ সালে। রবি ঠাকুরের শেষের কবিতা যেমন কবিতার বই নয় এটি একটি উপন্যাস ঠিক তেমনি অক্সফোর্ড জুতোও প্রথমে অক্সফোর্ডে তৈরি হয়নি। এটার জন্ম স্কটল্যান্ডে। পরে আমেরিকানরা এটাকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে তোলার জন্য বেশ ভালো রকমের খাটাখাটুনি করেছে।

মাথার ভিতর একটা জিনিস গেঁথে গেলে ওটা আর মাথা থেকে সহজে বের হতে চায় না। ঘুরেফিরে একই চিন্তা মাথায় চলে আসে- জুতোর সঙ্গে ভিঞ্চির কী সম্পর্ক। আমার অন্য অনেক জিনিসপত্রের মতো নানা রকমের জুতো সংগ্রহেরও বাতিক আছে, তবে সেগুলোর সিংহভাগই সস্তা দামের জুতো-স্যান্ডেল, চটি ও নাগরা জাতীয় জুতো। পাঞ্জাবি-পাজামার সঙ্গে নাগরা আমার বেশ পছন্দ। আমার স্ত্রী প্রায়ই রাগ করে বলেন- জুতো কিনে কিনে তো বাড়ি ভরে ফেললে। আমি তাকে আশ্বস্ত করি- জানো তো বিলেতে একটা কথা বেশ প্রচলিত-

A Barrister is known by his shoes. অর্থাৎ একজন ব্যারিস্টারের কতটা প্রসার সেটা টের পাওয়া যায় তার পায়ের জুতো দেখে। যেহেতু ল’প্র্যাকটিসে লবডঙ্গা সেহেতু জুতোর উপরই আমার শেষ ভরসা।

আর যে পেশায় সারা জীবন শুধু প্র্যাক্টিসই করে যেতে হয় তার আর ভবিষ্যৎ কী। যা হোক অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নানা পাঠাগারে ঘুরেফিরে অবশেষে এর রহস্য উন্মোচিত করা গেল- সেটা ছিল ১৫৩৩ সাল। ইতালির বিখ্যাত মেডেচি পরিবারের কন্যা ক্যাথেরিন দ্য মেডেচির বিয়ে হতে যাচ্ছে ফ্রান্সের যুবরাজ ডিউক অব অরলিয়েন্স, হেনরির সঙ্গে। যিনি কিনা অচিরেই হতে চলেছেন ফ্রান্সের রাজা। কিন্তু সমস্যা হলো ক্যাথেরিনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে হেনরির প্রিয় এক মিসট্রেস অর্থাৎ উপপতিœ ডায়ানের সঙ্গে। ডায়ান মোটেও সুন্দরী নন এবং উচ্চতায় পাঁচ ফিটের চেয়েও কম। তারপরও ডায়ান যে কেন হেনরির এত প্রিয় প্রেয়সী সেটা একটা রহস্যই বটে। আগেই বলেছি, ইতালির এই বিখ্যাত ধনী মেডেচি পরিবার ভিঞ্চিকে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। এবার ভিঞ্চির সেটা শোধ দেবার পালা। ভিঞ্চিকে দায়িত্ব দেওয়া হলো কী করে ক্যাথেরিনকে ডায়ানের চেয়ে আরও বেশি দীর্ঘাঙ্গী করে তোলা যায়। ভিঞ্চি বললেন এটা তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়। দ্য ভিঞ্চি প্রায় চার ইঞ্চি হিল সম্বলিত এক জোড়া সুন্দর জুতো তৈরি করে দিলেন ক্যাথেরিনের জন্য । যদিও খ্রিস্টের জন্মের ৩৫০০ বছর আগে থেকেই মানুষ হিল জুড়ো পরতো সেটা অবশ্য ফ্যাশনের জন্য নয়, ঘোড়দৌড়ের সময় রেকাব থেকে পা যেন ফসকে না যায় সে জন্য। কিন্তু ভিঞ্চিই প্রথম ব্যক্তি যিনি মেয়েদের জন্য আধুনিক ও ফ্যাশনেবল হিল জুতোর গোড়াপত্তন করলেন। হিল জুতোর আবিষ্কার যে শুধু ঘোড়ায় চড়ার জন্য সেটি কিন্তু নয়। রাস্তার কর্দমাক্ততা এড়িয়ে চলতেও প্রাচীন যুগের মানুষেরা হিল জুতো ব্যবহার করতেন। প্রাচীন রোমে বারবনিতারা সম্ভবত মেয়েদের মধ্যে প্রথম যারা হিল জুতো পরা শুরু করে। এমন একটি মিথ চালু আছে যে, জুলিয়াস সিজারের ভাগ্নে অগাস্টাস সিজার যিনি ছিলেন তখনকার সময়ের অর্ধেক পৃথিবীর অধিশ্বর তিনি নাকি ছিলেন বেশ খর্বকায়, মাত্র পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। নিজেকে দীর্ঘকায় করে তোলার জন্য তিনি হিল জুতো পরা শুরু করেন। কিন্তু যেহেতু সে সময় হিল জুতো পরতো শুধু বারঙ্গনারা, সেহেতু নিজের অপমানিত্ব ঘুচাতে বেশ্যাদের হিল জুতো পরা আইন করে বন্ধ করে দিলেন। আমাদের একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, প্রাচীনকালের হিল জুতো কিন্তু তৈরি হতো কাঠ দিয়ে এবং নানন্দিকতার দিক দিয়েও সেগুলো এতটা উন্নতমানের ছিল না। টার্কিস টাওয়ালের জনক ছিল যেমন তুরস্ক ঠিক তেমনি আধুনিক হিল জুতোর জনক হিসেবেও প্রথম নাম লিখিয়েছিল তুর্কিরাই। ১৪০০ সালের দিকে তারা ‘প্লাটফর্ম’ নামে কাঠের হিল জুতো তৈরি করে মেয়েদের জন্য। তবে এ ধরনের হিল জুতো তৈরি করার পেছনের কারণটি হলো- এই হিল জুতো এত উঁচু হতো যে, হেরেমে রক্ষিতা রমণীরা যাতে করে সহজে পালিয়ে যেতে না পারে। ১৭০০ সালের দিকে ফ্রান্সেও হিল জুতো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। নর-নারী নির্বিশেষে হিলজুতো পরত। যার যত আভিজাত্য সে তত উঁচু হিল জুতো পরত। ফরাসি রাজা অষ্টাদশ লুই আইন করেছিলেন যে, তার মতো উঁচু হিল জুতো আর কেউ পরতে পারবে না। অন্যান্য রাজআমত্যদের হিল জুতো হবে তাঁর হিল জুতোর চেয়ে কম উঁচু। অন্যদিকে রাজা অষ্টাদশ লুইয়ের স্ত্রী মেরি  আঁতোয়ানেত পাঁচ ইঞ্চি উঁচু হিল পরতেন। লম্বায় অনেকটা খর্বকায় হলেও নেপোলিয়ান বোনাপার্ট ছিলেন হিল জুতোর ঘোরবিরোধী। ফরাসি বিপ্লবের পর নেপোলিয়ন যখন ফ্রান্সের হর্তাকর্তা হলেন তখন তিনি আইন করে হিল জুতো পরা বন্ধ করে দিলেন। হিল জুতোর প্রতি মেরি আঁতোয়ানেতের এতোটাই মোহ ছিল যে রাজবন্দী অবস্থায়ও  লুকিয়ে চুকিয়ে হিল জুতো পরতেন। এ জন্য নেপোলিয়ন তাকে শাস্তি পর্যন্ত দিয়েছিলেন। নেপোলিয়নের হিল জুতোর বিরুদ্ধে এমন কঠোর অবস্থানের কারণে হিল জুতো পরার প্রচলন প্রায় উঠেই যায়। কিন্তু উনিশ শতকের দিকে সেটা ধীরে ধীরে আবার ফিরে আসে মহাসমারোহে। আজকের সমাজে হিল জুতো ছাড়া কোনো নারীকে কল্পনা করা সত্যিই একেবারে অসম্ভব।

কলকাতা ভ্রমণ শেষ করে ফিরে এলাম স্বগৃহে। এর কিছুদিন পর হেলালকে কি যেন একটা কাজে পুনরায় যেতে হলো কলকাতায়। ফিরে এসে আমাকে ফোন করে বলল- চটজলদি আমার বাসায় একটু আসুন তো একটা মজার জিনিস দেখাব আপনাকে। মজার জিনিস বলে কথা। দ্রুত ছুটে গেলাম ওর বাসায়। হেলাল আমার হাতে কাগজে মোড়া একটা বস্তু ধরিয়ে দিয়ে বলল, দেখুন তো এটা, চিনতে পারেন কিনা। সুদৃশ্য কাগজের মোড়কটি খুলতেই বেরিয়ে এলো কালো রঙের সেই জুতো জোড়া। আমি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। বলতে বাধা নেই সত্যি এক অভাবনীয় উপহার। আজ যেন মনে হলো জুতো জোড়া আরও বেশি সুন্দর ও আকর্ষণীয়।

 লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী।

ই-মেইল :  [email protected]

সর্বশেষ খবর