শনিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাও

হাসানুল হক ইনু

সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাও

আজ ৩১ অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ ৪৩ বছর পূর্ণ করে ৪৪ বছরে পা দিচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে জাসদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এ সিদ্ধান্তটা যথোপযুক্ত ও সঠিক ছিল। জাসদ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের জন্য ঔপনিবেশিক শাসনের রেশগুলোর অবসান করে আধুনিক গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের কর্মসূচি গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিদের রেখে যাওয়া ঔপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন করে গণতান্ত্রিক গণমুখী প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে জাসদ। এককথায় ঔপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিলোপ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজতান্ত্রিক অভিমুখী একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য জাসদ তার সংগ্রাম শুরু করে।

কিন্তু জাসদের এই সংগ্রাম হোঁচট খায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড ও সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারা, গণতান্ত্রিক ধারা, সমাজতন্ত্রের সংগ্রামের ধারা, অসাম্প্রদায়িক ধারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সামরিক শাসকরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক, স্বৈরতান্ত্রিক লুটপাটের ধারায় বাংলাদেশকে ঠেলে দেয়।

জাসদ এরকম পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সামরিক শাসনবিরোধী বলিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণ করে। অবৈধ ক্ষমতা দখল-সামরিক শাসন-বাংলাদেশবিরোধী ধারাকে প্রতিরোধ করতে ঐক্যের পতাকা হাতে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু করে। মোশতাক-জিয়া-এরশাদের সামরিক শাসন ও সাম্প্রদায়িক ধারা থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করার ধারাবাহিক লড়াইয়ের একপর্যায়ে ’৯০-এ এরশাদ সামরিক শাসনের পরাজয় ঘটে। কিন্তু ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার সরকার মোশতাক-জিয়া-এরশাদের মতোই দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফেরত আনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বেগম খালেদা জিয়া দেশবিরোধী রাজনীতির পক্ষে অবস্থান নেয়। জাসদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে উদ্ধার করে আনার জন্য যেমন সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিল, ঠিক তেমনি ঐক্যের ঝাণ্ডা হাতেই বিএনপি-জামায়াত ও সাম্প্রদায়িক চক্রের বিরুদ্ধে আরও দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। বাংলাদেশকে উদ্ধারের এই পর্বে জাসদ এবং দেশবাসী বহু সময় বিজয়ের মুখ দেখেছে, আবার বহু সময় বিজয় হাতছাড়া হতে দেখেছে। বিজয় হাতছাড়া হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ২০০২ সালে জাসদ আন্দোলনের ঐক্য, নির্বাচনের ঐক্য, সরকার পরিচালনার ঐক্য- এই তিন ধরনের ঐক্যের প্রস্তাবনার ভিত্তিতে ১৪-দলীয় জোট ও মহাজোটের ঐক্য এবং সরকার গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

২০০৮ সালে নির্বাচনে পরাজিত বেগম খালেদা জিয়া, বিএনপি ও জামায়াত চক্র সাংবিধানিক ধারা, গণতান্ত্রিক ধারা, নির্বাচনী ধারা বানচাল করার জন্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ বহুবিধ চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে এবং একটি অস্বাভাবিক সরকার গঠনেরও চক্রান্তে লিপ্ত আছে।

বাংলাদেশকে উদ্ধার করার যে পর্ব, সেই পর্বটা এখনো অব্যাহত আছে। বিপদ কাটেনি, বাংলাদেশ এখনো নিরাপদ হয়নি। বাংলাদেশকে নিরাপদ করতে, সাম্প্রদায়িক-জঙ্গিবাদী চক্রকে সম্পূর্ণ পরাজিত, ধ্বংস এবং আত্মসমর্পণে বাধ্য করার পরই কেবল বাংলাদেশ নিরাপদ হবে। একই সঙ্গে সামরিক শাসন ও সাম্প্রদায়িকতার যত রকম ছাপ ও চিহ্ন সংবিধান থেকে শুরু করে সমাজের সব স্তরে রয়েছে, তা একটার পর একটা অপসারণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বাংলাদেশের পথে তথা অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক পথে, বৈষম্যহীন সমৃদ্ধ অর্থনীতির পথে এগিয়ে নিতে হবে।

সে জন্য জাসদ মনে করে, বাংলাদেশকে উদ্ধার পর্বের যে সংগ্রাম চলছে সেই সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্বে বিজয় নিশ্চিত করতে মহাঐক্যের যে নীতি তা অব্যাহত রাখা দরকার। তবেই কেবল সাম্প্রদায়িক, যুদ্ধাপরাধী, জঙ্গিবাদী, আগুন-সন্ত্রাসী, বাংলাদেশবিরোধী বাংলাদেশের শত্রুদের পরাজিত করা সম্ভব।

জাসদ এবং দেশবাসী অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক দেশের স্বপ্ন দেখেছিল। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সামরিক শাসক এবং জঙ্গিবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। সুতরাং বাংলাদেশের শত্রুদের পরাজিত করার যে আন্দোলন, সে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে  অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক-সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্নের রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে।

তবেই কেবল একদিকে যেমন অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজ নিরাপদ হবে, সমৃদ্ধিও আসবে, বৈষম্যও অবসান হবে। একটি বৈষম্যহীন এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন কেবল তখনই সফল হবে যদি সমাজতন্ত্রের দর্শনটাকে আমরা আঁকড়ে ধরতে পারি। সমাজতন্ত্রের দর্শনের ভিত্তিতেই কেবল একটি বৈষম্যহীন দারিদ্র্যমুক্ত এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া সম্ভব।

 

 

চলমান অসম বিশ্বায়নের মধ্যে বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশগুলোর দরকষাকষির অবস্থান শক্তিশালী করা, আঞ্চলিকায়নে সমতা আনা, জলবায়ুর পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করা, তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবের মাধ্যমে গ্রাম-শহর ও ধনী-গরিব  বৈষম্য দূর করে সবার জন্য ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা, নারীর মর্যাদা ও  ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা, শিশুর অধিকার রক্ষা করা, শ্রমিকের মর্যাদা ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা, পেশাজীবীদের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা, তথা শ্রমিক গরিব, নারী, কৃষক, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, পেশাজীবীদের ন্যায্য মর্যাদা নিশ্চিত করা, দেশ পরিচালনায় ও নীতি নির্ধারণে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে সমাজতন্ত্র ছাড়া বিকল্প নেই। কেবল সমাজতন্ত্রের দর্শনের ভিত্তিতেই এই বৈষম্য, এই অসমতা, এই অনাচার দূর করে সমতার সমাজ, একটা মর্যাদার সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

এ মুহূর্তে ১. খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণকারী মাঝারি ক্ষুদ্র চাষি কৃষককুল, ২. এক কোটির মতো প্রবাসী, যারা অনেক কষ্ট করে শ্রম বিক্রি করে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বা রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে- যাদের আমি বলি স্বর্ণ প্রবাসী ৩. এক কোটির বেশি ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতা নারীকুল ৪. পোশাকশিল্পের সঙ্গে জড়িত ৩০ লাখ নারী শ্রমিক ৫. চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদসহ কয়েক লাখ পেশাজীবী জনগোষ্ঠী ৬. অঋণ খেলাপি সৎ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা ৭. অঋণ খেলাপি সৎ বৃহৎ শিল্প উদ্যোক্তা এবং ৮. কয়েক লাখ শিক্ষিত এনজিও কর্মী, যারা গ্রামে-গঞ্জে মানুষকে সচেতন রাখছে- এই ৮টি গোষ্ঠী অর্থনীতির চালিকা শক্তি। এই ৮টি জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের ৪৩ বছরে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে অনেক সংগ্রাম করে উৎপাদনের চাকা অব্যাহত রেখে বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এই ৮টি গোষ্ঠীর কাঁধে ভর করে বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পথে এগোচ্ছে। এই ৮ গোষ্ঠীর যে অবদান তা স্বীকার করে দেশ পরিচালনায়, নীতিনির্ধারণে তাদের মর্যাদাপূর্ণ অংশগ্রহণই কেবল একটি সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু এই ৮ জনগোষ্ঠীর সংসদে বা স্থানীয় পর্যায়ে বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তাদের কোনো অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। এরা সব ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। এ বৈষম্য দূর না করা পর্যন্ত দেশে সমৃদ্ধ এলেও বৈষম্য ও দারিদ্র্য উৎপাদনের কারখানা থেকে যাবে। বাংলাদেশকে বৈষম্য ও দারিদ্র্য উৎপাদন এবং পুনরুৎপাদনের কারখানা থেকে উদ্ধার করতে হলে সমাজতন্ত্র ছাড়া বিকল্প নেই। সমাজতন্ত্রের দর্শনই দারিদ্র্য ও বৈষম্য উৎপাদন এবং পুনরুৎপাদনের এই মারাত্মক চক্রটাকে ধ্বংস করে একটি সমতার সমাজ নির্মাণের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। তাই সমাজতন্ত্রের দর্শনের ভিত্তিতেই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হলে এ মুহূর্তে অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের যে ভূমিকা তা ক্ষেত্রবিশেষে জোরদার করলেই হবে না, সমাজের চাহিদাটাকে স্বীকৃতি দিয়ে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সাধন করতে হবে।

মুক্তবাজার অর্থনীতির কাছে বাংলাদেশকে ইজারা দেওয়ার যে ভ্রান্তনীতি ’৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসক ও সাম্প্রদায়িক চক্র এবং তাদের অনুসারীরা অনুসরণ করেছিল তা বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী পথ ছিল, যা বাংলাদেশকে সমৃদ্ধিও দিতে পারেনি। বৈষম্য ও দারিদ্র্য দূর করতে পারেনি। সুতরাং সমাজতান্ত্রিক দর্শনের ভিত্তিতে বাজার শক্তির সঙ্গে এবং উদ্যোক্তা শ্রেণির সঙ্গে সমাজের চাহিদা এবং রাষ্ট্রের ভূমিকার বাস্তবসম্মত কার্যকরী সমন্বয় সাধনের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যাভিমুখী অর্থনীতি তথা সামাজিক অর্থনীতির একটা পথ-নকশা তৈরি করা দরকার।

একই সঙ্গে ঔপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ও গণতন্ত্রায়ন এবং স্তরে স্তরে জনগণের ও শ্রেণিপেশার মানুষের নীতি নির্ধারণে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে প্রচলিত গণতন্ত্রকে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রে প্রসারিত করতে হবে এবং তার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি সব স্থানীয় সরকারগুলোকে মন্ত্রী-এমপি ও আমলাতন্ত্রের হস্তক্ষেপমুক্ত স্বাধীন নির্বাচিত স্থানীয় সরকারে রূপান্তর করতে হবে। সংসদে শ্রেণিপেশা, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি সমন্বয়ে উচ্চকক্ষ গঠন করতে হবে। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব চালু করতে হবে। সংবিধানের ৭০ ধারার সংশোধন  করে সংসদ সদস্যদের আইন তৈরিতে আরও স্বাধীনতা প্রদানসহ শাসন-প্রশাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের পথে এগোতে হবে।

সরকার অতীতের অর্থনৈতিক নৈরাজ্য বা বিশৃঙ্খলা, লুটপাট, বৈষম্যের ধারা থেকে উদ্ধার করে একটা দিক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। রাষ্ট্রের ভূমিকা পুনঃআবিষ্কার করার মধ্য দিয়ে এবং সমাজের চাহিদাকে স্বীকার করার মধ্য দিয়ে পুনঃস্থাপিত এ দিক পরিবর্তন কিছুটা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্র পুনঃস্থাপিত হয়েছে। এ পরিবর্তনকে এগিয়ে নিতে হলে এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাদুকরী উন্নয়নের যে ধারা চলছে তার সুফল শ্রমিক, গরিব, নারীদের ঘরে ঘরে পৌঁছাতে হলে সমাজতন্ত্রের বিকল্প নেই।

জাসদের ৪৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জাসদের আহ্বান, বাংলাদেশে যে পরিবর্তনের ধারা শুরু হয়েছে, সাম্প্রদায়িকতা, সামরিক শাসন থেকে যে উদ্ধার পর্ব চলছে, বাংলাদেশকে বাংলাদেশের পথে চালিত করতে যে প্রচেষ্টা চলছে, জাদুকরী উন্নয়নের যে ধারা চলছে তার সুফল শ্রমিক, গরিব, নারীদের ঘরে ঘরে পৌঁছাতে হলে এ মুহূর্তে একটাই আওয়াজ তুলতে হবে- বাংলাদেশের শত্রুদের পরাজিত কর এবং সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে এগিয়ে যাও।

লেখক : সভাপতি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ ও তথ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

সর্বশেষ খবর