শনিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

সংগীত সম্পর্কে গোলটেবিল

হোসনে আরা শাহেদ

এ মাসের ১৭ তারিখে ‘সংগীতে সংকট : উত্তরণের পথ’ নামের একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার খবর আজ (১৮ অক্টোবর) ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ পত্রিকায় পেলাম। অনুষ্ঠানটির আয়োজক ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’। প্রথমেই আমি বলব, এমন একটি বিষয়ে এমন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ প্রতিদিন আমাদের অকুণ্ঠ ধন্যবাদ প্রাপ্য হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি সংগীত জগতের কেউ নই। সংগীত সম্পর্কে আমি পুরোপুরি অজ্ঞ। তবে কেন জানি না ছেলেবেলা থেকে আমি সংগীতের ভক্ত। আমার উৎসাহ দেখে আমার বাবা আমার জন্য ডবল স্প্রিংয়ের হিজ মাস্টার্স ভয়েস গ্রামোফোন ক্রয় করেছিলেন। এ বস্তুটি ছিল আমাদের কাছে কলের গান। কলের গানের কল্যাণে আঙ্গুরবালা, কাননদেবী, সায়গল, শচীন দেব বর্মণ, রবীন মজুমদার, আব্বাসউদ্দীন থেকে শুরু করে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, আরতি মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, ভূপেন হাজারিকা, লতা মঙ্গেশকর, মোহাম্মদ রফি, তালাত মাহমুদ, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়- এমন সব গুণী শিল্পীর গান শুনেছি। আরও শুনেছি দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, কণিকা মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের রবীন্দ্র সংগীত। সেই কলের গানটি এখনো আমার কাছে আছে; যত্ন করে রেখেছি- প্রায় প্রায়ই খুলে দেখি, স্পর্শ করি; মসৃণ কাপড়ে ধুলো ঝাড়ি। কিঞ্চিৎ বর্ণহারা হলেও বাইরে ঠিক আছে। ভিতরেও কোনো ছাপ পড়েনি। পিন নেই। থাকলে রেকর্ড বাজানো যেত। এখনো সচল আছে। তবে অনিবার্যভাবেই ভিতরে ওটা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।

কলের গান আমার ছোট্টকাল থেকেই যে সংগীতকে আমার কাছে এনে দিয়েছে, তার মূল্য আমার কাছে অপরিসীম। সংগীত সম্পর্কে আমার নিজের যে অজ্ঞতা, তা আমার ভাগ্যের অবদান। ভাগ্যের বিপরীতে যাওয়ার সাধ্য কারও নেই- এ আমার বিশ্বাস যদিও জীবনভর ছাত্রীদের বলেছি এর বিপরীতটা। এখন সত্য হলো, সংগীতবঞ্চিত এবং সংগীতে অজ্ঞ আমি সংগীতকে ভালোবাসি। এ ভালোবাসা সত্যি বলছি, আর সব কিছুর চেয়ে বেশ বেশি।

যে গান ভালোবাসে না, তার মন যে নিষ্ঠুরতায় ভরা, তা গুণীজনরা বলে গেছেন। সত্য বলেই গেছেন। গান মন প্রশান্ত করে। বিশুষ্কতা কাটিয়ে মনপ্রাণ সজল করে তুলতে পারে। দুঃখ-গ্লানি, বেদনা লাঘব করতে পারে গান। গান মানুষকে কোমল হতে শেখায়। ভালোবাসতে শেখায়। এ মনকে পরিশীলিত করে। এ সবই সবার জানা। তবু কেন এখন আমার এমন করে বলার অবতারণা? আসলে এ আমার বলা নয়- এ আমার দীর্ঘশ্বাস। এ আমার হতাশা। আজ আমি কোথাও সংগীতকে খুঁজে পাই না। মনে হয়, আজকের সংগীত যন্ত্রসর্বস্ব। এতে যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ, যন্ত্রের প্রাধান্য। এমনকি যন্ত্রের সাহায্যে কণ্ঠের ক্ষতিপূরণ। ভাবতে কষ্ট হয়। ওই জগতে নবাগতদের ডামাডোলে প্রতিষ্ঠিতরা এখন কোথায়?

আলোচ্য গোলটেবিলে বিজ্ঞ ব্যক্তিদের বক্তব্য থেকে অনেক তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বেরিয়ে এসেছে সাম্প্রতিককালে এ শিল্পের অসারতার কথা। সাধনা বলতে কিছু আজ আর তেমন জোরদার নাকি নয়- সবই সংক্ষিপ্ত, সবই শর্টকার্ট। যন্ত্র এখন সর্বত্র প্রধান। সংগীতবিষয়ক সব বিভাগে সমন্বয়ের দারুণ অভাব। অধ্যবসায় ছাড়াই সিদ্ধি লাভের স্পৃহা। দ্রুত চূড়ায় ওঠার আকাক্সক্ষা, সব বিভাগে সমন্বয় আর সমঝোতার সংকট- এমন সব নানা কারণে সংগীতের জগতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। যেহেতু এ জগৎটি একের সঙ্গে এক নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত, সেহেতু এর এই অস্থিরতাও নানা ধরনের। এই সংকট ক্রমেই বিকট হচ্ছে। পথ মসৃণ বলে নৈরাজ্য, দুরবস্থা আর হতাশা মাত্রা ছাড়াতে চলেছে।

সংগীত জগৎ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা অবশ্যই সবাই রাখেন। এ আমার নিছক অনুমান নয়। ঘরোয়া মজলিশে, টেবিল-টকে, আনন্দ-আড্ডায় বা সাধারণ চায়ের দোকানে কথাবার্তায় সংগীত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা যে জাগে না, তা নয়? কার্য কারণও আলোচনায় আসে, খোলামেলা কথাই হয়। ব্যস্, এ পর্যন্তই। সময় সুযোগ আর ইচ্ছার অভাবে সব ওই পর্যন্তই থেমে থাকে। অবশ্য এর কারণও আছে।

জীবনযাপনের জটিলতায় মানুষ ধুঁকছে। এর মধ্যে কে কার কথা বলবে? সংগীত জগতের যে জটিলতা, তা কম-বেশি সর্বত্র- সব বিভাগে। অধৈর্য, অস্থিরতা, দ্রুত মাত করার মানসিকতা। টেক্কা দেওয়ার প্রবণতা, অসহিষ্ণুতা, সমন্বয়হীনতা, সাধনাবিহীন সফলতা, কোথায় কোন বিভাগে নেই? বরং বলা যায়, জোর দিয়েই বলা যায়, আমরা আজ একই পথের পথিক সবাই। আমরা প্রশ্ন ফাঁস করি, পরীক্ষায় নকল করি, নথিপত্র চুরি করি, খাবারে ভেজাল দিই। আমরা কিলিয়ে কাঁঠাল পাকাই, ইনজেকশন দিয়ে কোরবানির পশু মোটা বানাই। খাবারে ওষুধ মিশিয়ে ফার্মের মুরগি দ্রুত বড় করি। ফ্রুট জুসে আমরা ফ্রুট ছাড়া অন্য জিনিস মিশাই। বাড়িঘর তৈরির উপাদান, জমির মাপজোখ, রোগীর ওষুধ, রেস্তোরাঁর উপদেয় খাবার, কাঁচাবাজারের মাছ-মাংস কোথায় আমাদের হাতসাফাই নেই? আমরা সুবিধাভোগী দল করি। আমরা চাটুকার, আমরা কাজে ফাঁকি দিই, আমরা অন্যায় সমর্থন দিতে পারি। মোটকথা, সততা এ দেশ থেকে পলাতক? সাধনা এমন নির্দিষ্ট। এখানে কেউ কাউকে ঠোকার নেই। কাউকে কিছু বলার জো নেই? এক অতি আশ্চর্য সমাজব্যবস্থায় আমরা সবাই আক্রান্ত। বিবেক এখন আচ্ছন্ন। এমন পরিবেশ পরিস্থিতিতে সংগীত জগতের সংকটকেও দেখতে হবে। মানে দেখা উচিত হবে। আমরা কি মনে করতে পারি- সংগীতের মানুষেরা বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপের বাসিন্দা? না তারাও তো আমরাই! অর্থাৎ এই সমাজের ফসল তারাও। তাদের যে সংকট, তা আশ্চর্য কিছু নয়। তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

তবে হ্যাঁ, দুঃখবোধ আছে। আর সেই দুঃখের সীমা নেই। এর সুস্পষ্ট কারণ আছে। তা হচ্ছে, তারা আমরা হলেও তারা স্বতন্ত্র। তাদের স্বাতন্ত্র্য তাদের মননশীলতায়, তাদের সাংস্কৃতিক সুষমায়, তাদের শৈল্পিক চেতনায়। শিল্পী হওয়া কঠিন বিষয়? এর জন্য শুধু মন, শ্রম, সাধনাই যথেষ্ট নয়- আরও কিছু চাই। সেই কিছু যা আমাদের সাধারণের নেই। আমরা মানে যারা ফুঁ দিলেই বাঁশি বাজে না। আমরা মানে যারা গলা ছাড়লেই সুর সৃষ্টি হয় না। আমরা মানে যারা আঙ্গুল ছোঁয়ালেই সেতার ঝঙ্কৃত হয় না। আমরা মানে যারা তবলায় হাতের তালু দিলেই তা-ধিন্ বেজে ওঠে না।

এমন বিশেষত্ব যাদের তারা কেন বিশেষ ধরনের হবে না- এমন ক্ষোভ মনে জাগতে পারে। জাগবেই। আমাদের মতো সাধারণ ধরনের হলে কী বিশেষত্ব তাদের অসাধারণত্বের? চির সুন্দর জগতের বাসিন্দা হয়ে অসুন্দরের পূজারী হবে কেন? আমাদের হিংসা, দ্বেষ, কপটতা, নীচতা, শঠতাকে কেন তারা তাদের মধ্যে প্রশ্রয় দেবে? এই হচ্ছে আমাদের জিজ্ঞাসা। এমন জিজ্ঞাসা তো প্রত্যাশারই নামান্তর। আমরা কলুষমুক্ত সংগীত জগৎ চাই- যে জগতে থাকবে আনন্দ, সাধনা, তিতিক্ষা আর সুন্দরের ঝরনাধারা। পূর্বসূরিদের মতোই আজকের এরাও হবেন নির্মল পৃথিবীর বাসিন্দা- এটাই আমাদের চাওয়া। এ কারণে সংগীত মহলের অনভিপ্রেত ও অনাকাক্সিক্ষত কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হওয়া দরকার। তাহলেই সতর্কতা আসবে সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে- বিভ্রান্তি-অশান্তি দূরীভূত হওয়া সহজ হবে।

ঠিক এ কারণে ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এর সংগীত নিয়ে এমন বৈঠকের আয়োজন অত্যন্ত সময়োপযোগী ও দূরদর্শিতার কাজ হয়েছে বলে আমরা মনে করি। বৈঠকের আলোচনায় সংগীত জগতের ব্যক্তিত্বদের প্রাধান্য অত্যন্ত প্রশংসার হয়েছে। ভবিষ্যতেও তাই যেন হয়, এমন অনুরোধ রাখছি। তাহলে ব্যাপারটি হবে আত্মসমালোচনার মতো। এর ফলও হতে পারবে সুদূরপ্রসারী।

বৃহত্তর অর্থে আমরা সবাই সংগীত জগতের- এ স্বীকারে অবশ্য দ্বিধা থাকার কথা নয়? শ্রোতা হিসেবে আমাদের অংশই বিশাল, সন্দেহ নেই। এ কারণেই সংগীত ও সংগীত জগৎ নিয়ে আমাদেরও দায় আছে। সংগীত ছাড়া জীবন অকল্পনীয়, অচল। প্রকৃতি সংগীতময়। সুরের মূর্ছনায় বিষাদ ভোলা যায়। সুরের জগতে অবোধ শিশুও কান্না থামায়। সুর মানুষকে এক অতীন্দ্রিয় জগতে নিয়ে যায়। এই সংগীত নিয়ে বিকৃতি কারও কাম্য নয়। অন্তত এ ব্যাপারে আমরা আপসহীন থাকতে চাই।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর