শনিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

হৃদয়-ধর্মের দেয়ালটা মরামত করুন

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

হৃদয়-ধর্মের দেয়ালটা মরামত করুন

বন-জঙ্গল আর গুহায় থাকা মানুষের জন্য ধর্মের প্রবর্তন ছিল পরম আশ্রয়, পরম নির্ভরতা। এভাবেই ক্রমে ক্রমে আনাচে-কানাচে জাতি-গোষ্ঠীতে ধর্ম প্রবর্তকের সূচনা হয়। গুহায় থাকা মানুষ নিজেকে নতুন ছাঁচে তৈরি করল ধর্মের আবহে। তারা শিখল শিষ্টাচার। তারা শিখল একের খাদ্য অন্যকে খাওয়াতে। গড়ে উঠল ধর্মমানব সমাজ। প্রেম-প্রীতিতে আর হৃদয় বন্ধনের সমাজ এগোতে থাকল সভ্যতার দিকে। পৃথিবীতে আজ যখন সভ্যতার চরম বিকাশমানতা বিরাজ করছে, এ সময় কারা যেন ফাটল সৃষ্টি করে দিয়েছে হৃদয়-ধর্মের দেয়ালে। লা-ইলাহার সুই ফুটিয়ে ধর্ম দেয়ালের এ ফুটো সারাতে হবে আমাদেরই। তবেই আবার শান্তি ফিরবে গোটা পৃথিবীতে। হৃদয়-ধর্মের দেয়ালটা মেরামত করতে হবে আজই। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘সময় নিকটবর্তী হতে থাকবে, আর আমল কমতে থাকবে। কার্পণ্য ছড়িয়ে দেওয়া হবে এবং ‘ফিতনা’র বিকাশ ঘটবে। ‘হারজ’ ব্যাপকতর হবে। সাহাবিরা (রা.) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হারজ’ কী? রসুল (সা.) বললেন, হারজ মানে ‘হত্যা!’ (বুখারি)

সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী মানুষ হত্যা মহামারী আকার ধারণ করেছে। ব্যক্তিগত আক্রোশের বশবর্তী হয়ে পিতা-মাতা সন্তানকে, সন্তান পিতা-মাতাকে, স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে হত্যা করছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো- তুচ্ছ কারণে একে অপরকে হত্যা করছে। মানুষের জীবনের নিরপত্তা নেই। চরম অনিরাপত্তায় দিন যাপন করছে খোদ নিরাপত্তাকর্মীরাই। দিনদুপুরে কমান্ডো স্টাইলে বাসায় কিংবা অফিসে ঢুকে ব্যক্তিগত বা আদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে প্রকাশ্য হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠছে মানুষরূপী হায়েনার দল। কে বা কারা কোন স্বার্থে মমতাময়ী মায়ের বুক খালি করছে, স্নেহময়ী সন্তানকে এতিম করছে, তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। যাদের কাছে দেশ-বিদেশের বিভেদ ছাপিয়ে আপনজনরা পর্যন্ত অনিরাপদ, তারা আর যাই হোক মানুষ নয়। কোরআনের ভাষায় ‘তারা হলো চতুষ্পদ জন্তু, বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট।’ (সূরা আ’রাফ, ৭:১৭৯; সূরা ফোরকান, ২৫:৪৪।)

মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে ধর্ম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নরহত্যা কিংবা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করা ছাড়া অন্য কোনো কারণে যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করল, সে যেন পৃথিবীর সব মানুষকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কারও জীবন রক্ষা করল সে যেন পৃথিবীর সব মানুষের জীবন রক্ষা করল।’ (সূরা মায়িদাহ, ৫:৩২।) হামজা বিন আবদুল মুত্তালিব (রা.) রসুল (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ‘আমাকে এমন পথ বলে দিন যা আমার জীবনকে সুখময় করবে।’ তিনি (সা.) বললেন, ‘মানুষের জীবন রক্ষা এবং ধ্বংস করা- এ দুটির মধ্যে আপনি কোনটি পছন্দ করেন?’ হামজা (রা.) বললেন, ‘মানুষের জীবন রক্ষা করা।’ রসুল (সা.) বললেন, ‘আপনি এ কাজই করতে থাকুন।’ (মুসনাদে আহমাদ)

অন্যায়ভাবে কোনো মুসলমানকে হত্যার পরিণাম নিশ্চিত জাহান্নাম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি জেনে-বুঝে কোনো মুমিনকে হত্যা করে, তার শাস্তি হচ্ছে জাহান্নাম। সেখানে সে চিরকাল থাকবে। তার ওপর আল্লাহর ক্রোধ ও অভিসম্পাত বর্ষিত হতে থাকবে। আল্লাহ তার জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন।’ (সূরা নিসা, ৪:৯৩।) এ আয়াতের শানে নুজুল সম্পর্কে মুফাসসিররা বলেন, ‘জলিলে কদর সাহাবি হজরত আবু দারদা (রা.) এক কাফেরকে হত্যার উদ্দেশ্যে তরবারি উঠালে সে কালেমা পাঠ করে মুসলমান হয়ে যায়। কিন্তু আবু দারদা (রা.) তাকে ছেড়ে না দিয়ে হত্যা করে ফেলে। রসুল (সা.) এ ঘটনা শুনে অত্যন্ত রেগে যান এবং আবু দারদাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করেন। আবু দারদা (রা.) বললেন, ‘সে প্রাণ বাঁচানোর জন্য কালেমা পড়েছিল।’ রসুল (সা.) তার এ অজুহাত গ্রহণ না করে বললেন, ‘তুমি কি তার অন্তর ফেড়ে দেখেছিলে?’ (ইবনে কাসির।)

বিদেশি নাগরিক, ধর্মীয় নেতা, ধর্মীয় উপাসনালয়-উৎসব এবং সাধারণ মানুষকে হত্যা করা ধর্ম সমর্থন করে না। হত্যা, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা রোধে সরকারের পাশাপাশি আলেমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। ওয়াজ-মাহফিল, জুমার খুতবা-বক্তৃতা ও লেখনীর মাধ্যমে ধর্মের সৌন্দর্য ও মমত্ববোধ মানুষের সামনে ফুটিয়ে তুলতে হবে। ‘সৃষ্টিকে ভালো না বেসে স্রষ্টার সান্নিধ্য পাওয়া সম্ভব নয়’- মানুষকে এ কথা বোঝাতে হবে। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের ওপর দয়া করে না, আল্লাহ তার ওপর দয়া করেন না।’ (মুসলিম) তিনি (সা.) আরও বলেছেন, ‘তোমরা পৃথিবীবাসীর প্রতি দয়া কর, আরশের অধিপতি আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’ (তিরমিজি)

জ্ঞানীরা বলেন, ধর্ম হলো জ্ঞান এবং ভালোবাসার সম্মিলিত রূপ। জ্ঞানহীন ধার্মিক আর ধর্মহীন জ্ঞানী দুটিই মানবসভ্যতার জন্য চরম অভিশাপ। জ্ঞানহীন ধার্মিকরা ধর্মকে ভুলভাবে উপলব্ধি করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে, আর ধর্মহীন জ্ঞানীরা তাদের জ্ঞানকে মানুষের অকল্যাণে পরিচালিত করে। মানুষের মাঝে শান্তি এবং সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে ধর্ম এবং জ্ঞানের সমন্বয়ের বিকল্প নেই। সমাজের প্রত্যেককেই কোরআনের জ্ঞানে জ্ঞানী এবং ধার্মিক হতে হবে। তবেই সমাজের মানুষ নিরাপদ আশ্রয় পাবে।  মহান আল্লাহ সবাইকে কোরআনের জ্ঞানে জ্ঞানী এবং ধর্ম-কর্মের মানুষ বানিয়ে দিন।

-লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

সর্বশেষ খবর