শনিবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ওরে বাবা ভয়! কেমনে পাইবো জয়!

গোলাম মাওলা রনি

ওরে বাবা ভয়! কেমনে পাইবো জয়!

ভয় নিয়ে নশ্বর এই জগতে কত কিছু যে হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। বাঘ-ভালুক, হায়েনা-গরিলা, শিয়াল-কুকুর-ব্যাঙ কিংবা সাপ-বিচ্ছু প্রভৃতিকে মানুষ যেমন যমের মতো ভয় করে তদ্রুপ ওইসব প্রাণীও নাকি মানবকুলকে মারাত্মক ভয় করে। জিন-ভূত-দৈত্য-দানব কিংবা প্রেতাত্মার কথা না হয় বাদই দিলাম- ভরদুপুরে গহিন জঙ্গলের বাঁশঝাড়ের কটকট আওয়াজ কিংবা শকুন-পেঁচার ডাকাডাকিতে  ভয় বেশি, নাকি অমাবস্যার রাতে জঙ্গলের পাশের কবরস্থানে অথবা শ্মশানে একাকী দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যে বেশি ভয়- এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আজ অবধি শেষ হয়নি। আবহমান বাংলার পুরনো সব ভয়ভীতির সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে আরও কতগুলো নতুন উপাদান। রামদা, চাপাতি, গুলি-বোমার পাশাপাশি আইএস, আল-কায়েদা, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, জেএমবি, হুজি যেমন আছে তেমনি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং শ্রেণি শত্রুদের জিন-ভূতের চেয়ে কম ভয় করে বলে আমার মনে হয় না।

সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের মানুষের মনের ভয় সম্পর্কে কিছু বলার আগে বলে নেই ভয় পেলে শরীর মনে কিংবা চলনে-বলনে কি কি সমস্যা দেখা দিতে পারে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, ভয় সব বয়স, সব পদ-পদবি এবং শ্রেণির জন্য কম-বেশি প্রায় একই পরিণতি ডেকে নিয়ে আসে। ভয়ের রাজ্যে ভীরু-কাপুরুষ বা কামহিলারা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি বিপদগ্রস্ত হয় সরলসোজা ভোলাভালা মানুষগুলো। সাহসী মানুষেরা পড়ে নানা অপ্রীতিকর দুর্ভোগের মধ্যে- আর মহাশান্তিতে থাকতে পারে পাগল এবং পাগলিরা। সব মানুষ যখন ভয়ের কবলে পড়ে দিশাহারা হয়ে দিগি¦দিক ছুটতে থাকে তখন পাগলা-পাগলিরা মনের সুখে গান বেঁধে উদোম নৃত্য আরম্ভ করে। মানুষ যখন ভয় পায় তখন তার শরীরের রক্ত চলাচল সমস্যা সৃষ্টি হয়। এর ফলে মস্তিষ্ক তার স্বাভাবিক চিন্তা করার এবং সিদ্ধান্ত প্রদান করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফুসফুস দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। হার্ট তার স্বাভাবিক কাজ সূচারুরূপে করতে পারে না। একই অবস্থা হয় কিডনির। ফলে ভয়ে আক্রান্ত ব্যক্তির ঘন ঘন জলত্যাগের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে পাকস্থলী প্রচুর অম্ল উৎপাদন শুরু করে। অনেকের পেট ফুলে বেলুনের মতো হয়ে যায় এবং অম্লযুক্ত বায়ু গলা দিয়ে চুকা ঢেঁকুর হয়ে বের হতে আরম্ভ করে। যাদের রেচনতন্ত্রে একটু গোলমাল রয়েছে তাদের কাছে দুর্গন্ধে কোনো মানুষ ভিড়তে পারে না। ভয়ে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে বহু রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার বিপরীতমুখী তাপ ও তাপে তাদের মুখমণ্ডল ফ্যাকাসে হয়ে পড়ে। কারও কারও হাত-পায়ে শুরু হয় কম্পন। কেউ কেউ প্রবল ভয়ে পাগলা ঘোড়ার মতো দৌড়াতে আরম্ভ করে। অনেকে কোনো রকম কথাবার্তা না বলে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। কেউবা শুরু করে কান্নাকাটি- আবার অনেকে অট্টহাসি দিয়ে উল্টাপাল্টা কাজকর্ম শুরু করে।

এখন প্রশ্ন হলো- মানুষ কেন ভয় পায়! ভয় পাওয়ার বহুবিধ কারণ রয়েছে। একশ্রেণির মানুষ রয়েছেন যারা সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করেন এবং দেখতে পান যে, পরিস্থিতির কাছে তিনি অসহায়। তার জীবন, সহায়-সম্বল সব কিছুই ধ্বংস হওয়ার উপক্রম দেখে তিনি ভয় পেয়ে যান। এই শ্রেণির ভয় সাধারণত মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট। জুলুমবাজ শাসক, ডাকাত, লুটেরা, ছিনতাইকারী, সংঘবদ্ধ অপরাধী প্রভৃতি গোষ্ঠী যখন কোনো ব্যক্তিকে আক্রমণ করে বসে তখন আক্রান্ত ব্যক্তির ভীতসন্ত্রস্ত না হয়ে কোনো উপায় থাকে না। সমাজে ভয়ের সবচেয়ে বড় কারণ হলো অজ্ঞানতা। বেশির ভাগ মানুষ ভয় পায় না জানার কারণে। অদৃশ্য জিনিসের প্রতি মানুষের ভয় আরও প্রবল। ভূত, প্রেত, দৈত্য, দানব জাতীয় ভয়ঙ্কর সব চরিত্র সৃজন করেছে মানুষের কল্পনা। বাস্তব জীবনে ওসব কেউ চাক্ষুষ দেখেছেন এমন কোনো দলিল পৃথিবীতে নেই। তারপরও মানুষ ভয় পায়। ভয়ের কবলে পড়ে অনেকের মৃত্যু পর্যন্ত হয়, অনেকে পাগল হয়ে যান, আবার কেউ কেউ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। আমাদের গ্রামের হরিবর্মণ সাহার পাগল হওয়ার কাহিনী ছিল বড়ই অদ্ভুত এবং আলোচিত ঘটনা।

হরিবর্মণ সাহা গ্রামের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। মধ্যবয়সী লোকটি তার প্রচণ্ড মোটা শরীর বদরাগী স্বভাব, কৃপণতা এবং অদ্ভুত সব আচরণের জন্য আলোচিত ছিল। সে তার টাকা-পয়সার একটি অংশ গোপনে মাটির নিচে পুঁতে রাখত এবং সেই ঘটনা কাউকে জানাত না। প্রাকৃতিক কার্যাদি সারত বনবাদাড়ে এবং রাতবিরাতে বহু দূরে চলে যেত কাউকে কিছু না জানিয়ে। ঘটনার রাতে হরিবর্মণ প্রাকৃতিক কর্ম সারার জন্য চলে গেল বাড়ির পাশের বিশাল জঙ্গলের কিনারে অবস্থিত একটি তালগাছের তলায়। গরমকালের ভরা অমাবস্যার সন্ধ্যারাত। নীরব-নিস্তব্ধ গ্রাম। চারদিকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক, নিশাচর পাখির পাখা ঝাপটানি আর জোনাক পোকার মিটিমিটি আলো। তালগাছটির মালিকানা হরিবর্মণের। ছোট তালগাছ- সেই বছরই প্রথম রস দিতে শুরু করেছে। গ্রামের দুটো ছেলে তালগাছে উঠে রস চুরি করে যাচ্ছিল। হঠাৎ তারা লক্ষ করল যে হরিবর্মণ গাছের তলায় এসেছে। ভয়ে তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার জোগাড়। ওদিকে হরিবর্মণ ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে বেসুরো গলায় গান ধরল এবং গাইতে গাইতে অম্লযুক্ত শরীর থেকে ভেসে ভেসে শব্দে কিছু একটা নির্গত করল। দুষ্টু ছেলেরা হরিবর্মণের কাণ্ড দেখে ভয় ভুলে গেল। তারা শুরু করল হাসি। হাসির তোড়ে তাদের হাত থেকে তালের রসের হাঁড়ি পড়ে গেল মাটিতে।

ঘটনার আকস্মিকতায় হরিবর্মণ প্রথমেই শুরু করল গগণবিদারী চিৎকার। তারপর দিল ভোঁ দৌড়। গ্রামবাসী যখন তাকে উদ্ধার করল তখন তার সংজ্ঞা নেই। বহু কষ্টে যখন তার জ্ঞান ফিরানো হলো, তখন দেখা গেল হরিবর্মণের স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে এবং অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই লোকটি বদ্ধ উন্মাদে পরিণত হলো। ওদিকে দুষ্টু ছেলেরা সেই রাতের কাহিনী একান-ওকান করতে করতে পুরো গ্রাম চাউর করে দিল। লোকজন শুনল কিন্তু বিশ্বাস করল না। তারা উল্টো তালগাছটিকে নিয়ে নানা কল্পকাহিনী রচনা শুরু করল। তালগাছে কী ধরনের ভূত আছে, ভূতের বাড়ি কোথায় এবং সে আরও কী কী সর্বনাশ ঘটাতে পারে এমনতরো নানা কথাবার্তার কারণে দুর্বল চিত্তের মানুষজন রাতবিরাত তো দূরের কথা, দিবালোকেও তালগাছটির কাছ দিয়ে হাঁটত না।

ভয় পাওয়ার আরেকটি কারণ হলো- কিছু মানুষের অন্যায়, অত্যাচার এবং নির্মমতা, একশ্রেণির মানুষ চায় যে, অন্যরা তাকে ভয় করুক, তাদের কাছে সর্বদা অবনত হয়ে থাকুক এবং নিজেদের সর্বস্ব তাদের পায়ের কাছে সমর্পণ করুক। এ কারণে কিছু লোক তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে বহুমুখী জুলুম, অত্যাচার, অবিচার, খুনখারাবি, নির্মমতা, নৃশংসতা এবং পাষণ্ডতা দেখিয়ে এমন এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যে, সমাজের নিরীহ মানুষজনের তখন ভীতসন্ত্রস্ত না হয়ে কোনো উপায় থাকে না। জালেমের জুলুম এবং অত্যাচারে সাধারণ মানুষের ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার ঘটনা হলো- ভয়ের রাজ্যে উত্থান-পতনের একেবারে প্রাথমিক ধাপ। দ্বিতীয় ধাপে গিয়ে জুলুমবাজরা নিজেরাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা যখন আদিম উল্লাসে তাদের কুকর্ম করতে করতে ক্লান্ত হয়ে একটু বিশ্রাম নিতে বসে ঠিক তখনই লক্ষ করে যে, তাদের কুকর্মের অধিক্ষেত্রটি সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে এবং জুলুম-অত্যাচার চালানোর মতো অবশিষ্ট বলতে তেমন কেউ নেই। তারা আরও লক্ষ করে যে, অত্যাচারের সহযোগীরা এবং অত্যাচারিত সম্প্রদায় কেমন যেন নীরব হয়ে পড়েছে। প্রকৃতির এই লীলাখেলা দেখে তারাও এক সময় ক্ষণিকের তরে চুপ হয়ে যায়। আর তখনই শুরু হয় দ্বিতীয় ধাপের প্রলয়। অত্যাচারীরা ক্রমেই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। অনিদ্রা, বাহুল্যময় কর্মকাণ্ড, বেহুদা কথাবার্তা এবং অযাচিত সন্দেহ তাদের দিনকে দিন দুর্বল থেকে দুর্বলতর প্রাণীতে পরিণত করে তোলে। তারা নিজেরা তাদের দুর্বলতাসমূহ আড়াল করার জন্য নৃত্য-গীত, অপ্রয়োজনীয় অনুষ্ঠানমালা এবং রঙ্গ-তামাশার মাধ্যমে হীরক রাজার দেশের কাহিনীর মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। এমনতর পরিস্থিতিতে মিথ্যাচার, অনাচার, গল্প-গুজব, ভয়ভীতি এবং অনিশ্চয়তার অন্ধকার লোকজনকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলে।

মানুষ যখন প্রচণ্ড ভয়ের মধ্যে থাকে তখন বাস্তবতার পরিবর্তে তারা অদৃষ্টবাদে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। সত্য ঘটনা ফেলে মিথ্যার পেছনে দৌড়ায় এবং গুজবগুলোকে বিশ্বাস করতে থাকে। যুক্তিতর্ক বাদ দিয়ে আকাশ-কুসুম কল্পনার মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে। তাদের মানবিক অনুভূতিসমূহ লোপ পায় এবং কেমন যেন নির্বিকার এবং নির্লিপ্ত একটা ভাব ধরে সর্বনাশের আশায় দিনাতিপাত করতে থাকে। ভয় নামক শব্দটির মতো এমন দ্রুত বর্ধনশীল এবং সংক্রামকভাবে বিস্তার লাভকারী ভাইরাস কিংবা অসুখ-বিসুখ আর দ্বিতীয়টি দুনিয়ার জমিনে নেই। একটি ভয় কয়েক মুহূর্তের মধ্যে একটি জনপদ কিংবা একটি রাষ্ট্রের বিশাল জনগোষ্ঠীকে গ্রাস করতে পারে। সাম্প্রতিককালের কয়েকটি হত্যাকাণ্ড সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। কিছু ভীতু লোকের কাপুরুষোচিত আচরণ এবং কিছু ভয়ার্ত লোকের অযাচিত বাড়াবাড়ির কারণে আজকের এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দেশের ১৬ কোটি মানুষই আজ চাপাতি রোগে আক্রান্ত। এমনকি যারা বৈধ অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করেন কিংবা বহু সংখ্যক সশস্ত্র দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত অবস্থায় থাকেন তারাও চাপাতির নাম শোনোমাত্র শিউরে ওঠেন। বুলেট প্রুফ গাড়ির ধনাঢ্য যাত্রী ব্যস্ত সড়কে চলতে গিয়ে হঠাৎ করে ট্রাফিক সিগন্যালে থেমে যাওয়া মাত্র আতঙ্কের চোখে এদিক-ওদিক তাকানো শুরু করেন। আশপাশে চলাচলরত সাধারণ মানুষের দিকে ভয় ও শঙ্কা নিয়ে তাকান এবং মনে মনে ভাবেন এই বুঝি একটি চাপাতি তার গাড়ির দরজায় আঘাত হানল। তিনি আপন মনে নিজেকে প্রশ্ন করেন- আচ্ছা! বুলেট প্রুফ গাড়ির দরজার কাচ চাপাতির কোপ ফেরাতে পারবে তো? হঠাৎ ২/৩ জন ভিক্ষুক লোকটির গাড়ির দরজায় মৃদু শব্দে টোকা দিতে দিতে বলতে আরম্ভ করে- ‘আব্বাগো কয়ড়া ট্যাহা দ্যান না!’ অন্য সময় হলে তিনি হয়তো দরজার গ্লাস নামিয়ে ভিক্ষে দিতেন- কিন্তু আজ আর সাহস পেলেন না। সন্ত্রস্ত চিত্তে নির্বিকার ভাব দেখিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন।

ভয়ের রাজ্যে কোনটা যে প্রকৃত ঘটনা এবং কোনটা যে নিছক গুজব তা পৃথক করা যায় না।

মানুষ অতিমাত্রায় নিয়তিনির্ভর হয়ে পড়ে। তারা আসমানের তারার গতি প্রকৃতি, পাক-পাখালির ডাকাডাকি কিংবা উড়ে চলার ভঙ্গিমার মধ্যে নিজেদের শুভ-অশুভ লক্ষণ খুঁজে বেড়ায়। প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ অবস্থানে অলস, অকর্মন্য, বদরাগী এবং এক সময় অত্যাচারীতে পরিণত হয়। যারা ভয় প্রদান করার মাধ্যমে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে থাকে সেসব মানুষের পতন না হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতির উন্নতি হয় না। তামাম দুনিয়ার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ভয়ের রাজ্যে তুচ্ছাতি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটে যায় ভয়াবহ বিবর্তন। সেই বিবর্তনে অভ্যুদয় নতুন এক রাজ্যের কিংবা সৃষ্টি হয় যুগান্তকারী ইতিহাসের। সামান্য চায়ের মূল্য বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে শুরু হয়ে যায় আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ। অন্যদিকে দুটি ঈগলের বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে একটি মহাযুদ্ধের ফলাফল নির্ধারিত হয়ে যায়- জন্ম নেয় পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ একটি সাম্রাজ্যের। চমকপ্রদ সেই কাহিনীটি বলে আজকের প্রসঙ্গের ইতি টানব।

খ্রিস্টের জন্মের ৪৪ বছর আগে মহাবীর জুলিয়াস সিজারকে রোমান সিনেটের মধ্যে হত্যা করেন তারই বিশ্বস্ত বন্ধু সেনাপতি ব্রুটাস এবং ক্যাসিয়াস। পরের দুটি বছর ছিল রোমানদের জীবনের চরম বিভীষিকাময় এক অধ্যায়। বহুমুখী অত্যাচার, অবিচার, মিথ্যাচার, গুজব এবং চক্রান্তের কারণে পরাক্রান্ত জাতিটি নৈতিক মনোবল হারিয়ে চরম এক ভীতিকর পরিস্থিতিতে জীবন অতিবাহিত করে। সমগ্র জাতি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। জুলিয়াস সিজারের পক্ষের লোকেরা সেনাপতি মার্ক আন্টনিও এবং সিজারের পালিত পুত্র এবং উত্তরাধিকারী অক্টাভিয়ানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়। অন্যদিকে ব্রুটাস এবং ক্যাসিয়াসের সমর্থক সংখ্যাও কম ছিল না। পরিস্থিতির একপর্যায়ে ব্রুটাস এবং ক্যাসিয়াস রোম নগরী ছেড়ে গ্রিসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।

রোমান সাম্রাজ্যের বিবদমান দুটি পক্ষ ৪২ খ্রি. পূর্বাব্দের অক্টোবর মাসে ফিলিপ্পি নামক যুদ্ধক্ষেত্রে চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য পরস্পরের মুখোমুখি হন। উভয়পক্ষে সৈন্য সংখ্যা ছিল এক লাখের ওপর। তাদের শ্রেষ্ঠত্ব, গুণগতমান এবং যুদ্ধজয়ের ইতিহাসও ছিল প্রায় সমান। মানব ইতিহাসে এত বড় ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ আর দ্বিতীয়টি নেই। যুদ্ধের দিন উভয়পক্ষ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে রণাঙ্গনে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ কোত্থেকে যেন দুটি ঈগল পাখির উদয় হলো। একটি উড়ে এলো সেদিক থেকে যেখানে ব্রুটাস-ক্যাসিয়াসের সৈন্যরা শিবির গেড়েছিল। আর অন্যটি এলো সিজার সমর্থক সৈন্যদের শিবিরের দিক থেকে। দুইপক্ষের দুই লাখ সশস্ত্র সৈন্য মনে করল ঈগল দুটি হলো যুদ্ধজয়ের দেবতা। তারা নিজেরা যুদ্ধ না করে নিজেদের তলোয়ার ও ঢালে আওয়াজ তুলে দুই ঈগলের যুদ্ধে ইন্ধন জোগাতে লাগল। প্রায় সারাটি দিন ধরে ঈগল দুটি পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ করল এবং শেষমেশ সেই ঈগলটির পতন হলো যেটি ব্রুটাসের দিক থেকে উড়ে এসেছিল।

উল্লিখিত ঘটনার পর ব্রুটাস এবং ক্যাসিয়াসের সৈন্যবাহিনী মনোবল হারিয়ে ফেলল এবং পরবর্তী দিনে একটি খুবই সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর একটি প্রবল পরাক্রান্ত বাহিনী তাদেরই সমপর্যায়ের পরাক্রান্ত বাহিনীর কাছে স্বেচ্ছায় পরাজয়বরণ করে নিল। ঐতিহাসিক ফিলিপ্পির যুদ্ধের ফলে রোমে প্রতিষ্ঠিত হলো প্রবল পরাক্রান্ত রোমান সাম্রাজ্যের, যেখানে একটি রাজবংশ প্রায় ৪০০ বছর ধরে দুনিয়া শাসন করল এবং রোমান সাম্রাজ্য নাম নিয়ে পৃথবীর বৃহত্তম ভূখণ্ড শাসন করল প্রায় দেড় হাজার বছর।  ১৪৫৩ সালের ২৯ মে মুসলমানদের দ্বারা কনসটান্টি নোপল বিজয়ের মাধ্যমে রোমান সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল।  আর বিজেতা ছিলেন অটোম্যান সম্রাট দ্বিতীয় মুহাম্মদ যার বিষয়ে ইসলামের নবী (সা.) জীবৎকালে ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন।

 লেখক : কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর