শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

মুমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য

মুফতি আমজাদ হোসাইন

মুমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য

আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন- ওই কিতাবটি প্রকৃত কিতাব, এতে কোনো সন্দেহ নেই। যা মুত্তাকীদের জন্য পথ-প্রদর্শক। যারা অদৃশ্য বিষয়ের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে, যথাযথভাবে নামাজ প্রতিষ্ঠা রাখে, আমি তাদের যে রিজিক দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে, যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে এ কিতাবকে যা আপনার ওপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং সেই কিতাবসমূহের ওপর যা আপনার পূর্বে অবতীর্ণ হয়েছে এবং তারা আখেরাতের ওপর নিশ্চিত বিশ্বাস রাখে। তারাই স্বীয় প্রতিপালকের পক্ষ থেকে হেদায়েতের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তারাই সফলকাম। (সূরা : বাকারা, আয়াত-২, ৩, ৪, ৫) আলোচ্য আয়াতসমূহে প্রকৃত মুমিনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় এবং মুমিনের দায়িত্ব, কর্তব্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে বলে দেওয়া হয়েছে। মুমিন বলতে বুঝায় যিনি এক আল্লাহর ওপর নিশ্চিত বিশ্বাসী। আমার বলতে কিছু নেই সব কিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ এই ইয়াকীন ও বিশ্বাস লালন করে। আল্লাহর দেওয়া বিধান ও রসুল (সা.)-এর প্রদর্শিত পথে নিজেকে পরিচালিত করে। সরল প্রকৃতির হয়। কাউকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয় না। শান্তির বাণী শোনায় ও শান্তির পথে চলে। অশান্তির পথ থেকে নিজেকে, নিজের সমাজকে বিরত রাখে এবং অপরকে বিরত রাখার চেষ্টা করে। জুলুম নির‌্যাতনের পথ পরিহার করে। কাউকে ধোঁকা দেয় না। মিথ্যা কথা বলে না ও মিথ্যা পথে চলে না। নিজের সুন্দর চরিত্র দ্বারা সবাইকে মুগ্ধ করে। তার হাত ও যজবান থেকে সবাই নিরাপদ থাকে। হাদিসে পাকে ইরশাদ হয়েছে, প্রকৃত মুমিন সেই ব্যক্তি, যার হাত ও জবান থেকে অপর ভাই সম্পূর্ণ নিরাপদ। অর্থাৎ সে হাত দ্বারা কাউকে কষ্ট দেয় না এবং তার জবান দ্বারাও কেউ কষ্ট পায় না। এক কথায় মুমিন মানে খাওফে ইলাহীর তাড়নায় প্রকম্পিত এক বান্দা। আল্লাহর সব বিধানাবলির ওপর খালেছ দিলে বিশ্বাস, তার ওপর অবিচল আস্থা এবং আল্লাহর হুকুমের সামনে নিজের সব কিছু উজাড় করে দেওয়ার এক ব্যক্তির নাম ‘মুমিন’। হাজারও প্রশংসিত গুণে গুণান্বিত ব্যক্তিকে এক শব্দে ‘মুমিন’ বলে অভিহিত করা যায়। আরও দশটি ব্যক্তি থেকে পৃথক করে সঠিক পন্থায় দীনি আলোয় যখন কোনো ব্যক্তি উদ্ভাসিত হবে, আপনি নিশ্চিত হতে পারেন তিনিই ‘মুমিন’। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের অনেক স্থানে মুমিনের গুণাবলির কথা উল্লেখ করেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়া ও আখেরাতে তার প্রতিদানের কথাও ঘোষণা দিয়েছেন। যেমন আল্লাহতায়ালা উক্ত আয়াতসমূহে মুমিন মুত্তাকীদের পাঁচটি গুণাবলি উল্লেখ করেছেন। এক. মুমিনের প্রথম গুণ হলো তারা ‘ইমান বিল গায়েব’ তথা অদৃশ্য বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে। যেমন কবরের আজাব, হাশর-নশর, জান্নাত, জাহান্নাম এবং হিসাব-নিকাশ ইত্যাদি। অর্থাৎ রসুল (সা.) যেসব অদৃশ্য বিষয়ের সংবাদ দিয়েছেন তার ওপর এবং মানুষ আল্লাহর যেসব বিষয়ে স্বীয় বুদ্ধিবল ও ইন্দ্রিয় গ্রাহ্যের মাধ্যমে জ্ঞান লাভ করতে অক্ষম, সেসব বিষয়ে পূর্ণ আস্থাশীল হয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে। দুই. মুমিনের দ্বিতীয় গুণ হলো তারা যথাযথভাবে নামাজ কায়েম রাখে। কোনো অবস্থাতেই নামাজ ছাড়ে না। কখনো কোনো কারণে নামাজ কাজা হলে তার হৃদয় ক্ষরণ শুরু হয়ে যায়, অর্থাৎ সে নামাজের সব ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত ও মুস্তাহাব স্বযতেœ ওয়াক্ত মতো আদায় করে। নামাজ ছাড়ার জন্য অহেতুক ওজর আপত্তি দাঁড় করায় না। বিপদ আপদে নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য কামনা করে এবং নিজের তামাম প্রয়োজন নামাজ ও দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে পেশ করে। নামাজকে জান্নাতে যাওয়ার চাবিস্বরূপ মনে করে। জীবনের সব ক্ষেত্রে সুন্নতে নববীর অনুসরণ ও অনুকরণ করে।

তিন. মুমিনের তৃতীয় গুণ হলো, তারা সামর্থ্য অনুযায়ী আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে। তারা কৃপণ কিংবা লোভী নয়। হিংসুক বা পরশ্রীকাতর নয়। অপররের গিবত-শেকায়েতে নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করে না। আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করার খাতসমূহ নিæে দেওয়া হলো। (১) সম্পদের জাকাত আদায় করা, (২) সদকায়ে ফিতর আদায় করা, (৩) ফকিরদের দান করা, (৪) অভাবীকে ঋণ প্রদান করা, (৫) ওয়াক্ফ তথা মসজিদ, মাদ্রাসা, মুসাফিরখানা, মেহমানখানা তৈরিসহ বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা, (৬) হজের সফরে ব্যয় করা, (৭) আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা (৮) আর্থিক সংকটে জর্জরিত আত্নীয়-স্বজনদের জন্য ব্যয় করা, (৯) মাতা-পিতার জন্য ব্যয় করা, স্ত্রী, সন্তান-সন্ততির ভরণ পোষণের জন্য ব্যয় করা, (১০) মেহমানকে আপ্যায়ন করা। (মাআরেফুল কোরআন) চতুর্থ. মুমিনের চতুর্থ গুণ হলো, তারা কোরআনের প্রতি ইমান আনার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবসমূহের প্রতিও ইমান আনে। অর্থাৎ আসমানি সব কিতাব আল্লাহর কালাম, হক ও সত্য এ কথার ওপর ইমান এনে, পূর্ববর্তী কিতাবসমূহ রহিত হয়ে যাওয়ায় এখন শুধু সর্বশেষ কিতাব তথা আল-কোরআনের বিধানের ওপর আমল করে। আল কোরআনকে বোঝার জন্য রসুল (সা.) এর অসংখ্য হাদিস চর্চা করে, আর আমলের পদ্ধতিগত দিকগুলোর ব্যাপারে মাজাহেবে আরবাআ’ (চার মাজহাব) এর ইমামদের এজতেহাদ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করে। মৌলিকভাবে মুমিন ব্যক্তি মনে করে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন, তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার অবকাশ নেই। এবং মুমিন ব্যক্তি এমনও মনে করে, ইসলাম হলো আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ও শ্রেষ্ঠ ধর্ম, যার মধ্যে কোনোরূপ বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি করা যাবে না। তাই তো আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, তোমাদের জন্য রসুল (সা.) যা নিয়ে এসেছেন তা মজবুত করে ধর এবং যার থেকে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাক। (সূরা হাশর, আয়াত-৬)। পঞ্চম. মুমিনের পঞ্চম গুণ হলো, তারা পরকালের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করে, বস্তুত পরকালের প্রতি বিশ্বাস থেকেই সৃষ্টি হয় নেক আমলের অনুপ্রেরণা এবং গুনাহের অনুসূচনা। উপরে উলি­খিত গুণের অধিকারী মুমিন মুত্তাকীদের জন্য আলোচ্য আয়াতে দুটি পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।

এক. ওইসব লোকই তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে হেদায়েতপ্রাপ্ত এবং তারা হেদায়েতের ওপর থাকবে অটল- অবিচল। দুই. ওইসব লোকের জন্যই ইহকাল ও পরকালের সফলতা রয়েছে।  রয়েছে জান্নাতের হাজারও নেয়ামত। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে প্রকৃত মুমিন হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব, বারিধারা, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর