শনিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

দরজায় কিসের আওয়াজ!

গোলাম মাওলা রনি

দরজায় কিসের আওয়াজ!

আজকের নিবন্ধটি সরকারের সেই সব কর্তাব্যক্তির জন্য যারা সত্যিকার অর্থেই দেশকে ভালোবাসেন এবং যে কোনো মূল্যে দেশের কল্যাণ সাধন করতে চান। তারা প্রকাশ্যে না হলেও মনে মনে স্বীকার করেন যে, বিগত সাতটি বছরে ঘটে যাওয়া ছোটখাটো সমস্যাগুলো সমাধান না করায় আজ অনেকগুলো মারাত্মক সমস্যা জাতির সামনে চলে এসেছে এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কোনো জারিজুরিই আর কাজে আসছে না। রাখাল বালকের ন্যায় মিথ্যা গল্প এবং অহেতুক মশকরা অথবা সাদ্দাম হোসেনের মতো ছলচাতুরী করে পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং বন্ধু হওয়ার চেষ্টার ভয়ানক ফলাফল থেকে এই জাতিকে উদ্ধারের জন্য যারা চিন্তাভাবনা করেন আজকের নিবন্ধটি হয়তো তাদের কোনো কাজে লাগলেও লাগতে পারে। আজ থেকে বছরখানেক আগে আমার মনে হতো সরকার যদি দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়ে দেয় তাহলে হয়তো দেশ অনেক কিছু থেকে রক্ষা পাবে। তারও এক বছর আগে আমার বারবার মনে হয়েছিল, ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচনের আয়োজন করে সরকার নিজেদের এবং পুরো জাতিকে এমন একটি স্থানে নিয়ে যাবে সেখান থেকে ইচ্ছে করলেও তারা ফিরে আসতে পারবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান রহিত করে সংবিধান সংশোধনের পর আমি বহুবার বলেছি এবং লিখেছি যে, কাজটির ফলাফল ভালো হবে না। এরপরের ঘটনা সবারই জানা। গণতন্ত্রের পক্ষে, নির্বাচনের পক্ষে এবং সরকারের দুর্বলতা নিয়ে কথা বলার জন্য দেশের বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক এবং পশ্চিমা দুনিয়ার সব রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক শক্তিকে সরকার বিদেয় করার চেষ্টা করেছে। ফলে সরকারের অজান্তে শুরু হয়ে গেছে এক অস্বাভাবিক এবং দুঃসহ পরিস্থিতির।

আপাতদৃষ্টিতে অনেকেই মনে করবেন, দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক হানাহানি, সরকারের একগুঁয়েমি, নির্যাতন, বিরোধী দলের অপরিপক্বতা এবং নিষ্ক্রিয়তা, বিনিয়োগে মন্দা, সরকারি ব্যয় বেড়ে যাওয়া— বিপরীতে আয়-রোজগার কমে যাওয়া, ব্যাংকে তারল্য বৃদ্ধি, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, বহু আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকি, শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি, অর্থনীতিতে কালো টাকার সীমাহীন আধিপত্য, দুর্নীতি, দলীয় ক্যাডারদের আধিপত্য, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ইত্যাদি হলো প্রকৃত সমস্যা। আর এসব সমস্যার উদ্ভব হয়েছে ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে। কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়ে গেলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যারা বাংলাদেশের রাজনীতির উল্লিখিত সহজ সমীকরণে বিশ্বাস করেন আমি তাদের সঙ্গে অতীব সম্মানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। আমার মতে, সরকার যদি আগামীকাল পদত্যাগ করে এবং একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে দেয় সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বর্তমানের চেয়েও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। কারণ গত দুই-তিন বছরে সরকার জ্বর, সর্দি-কাশি এবং হালকা পেট ব্যথার মতো সাধারণ রোগ-বালাই নিরাময় করতে গিয়ে এমন সব উচ্চমাত্রার ওষুধ প্রয়োগ করেছে যাতে রোগীর শরীরে মরণব্যাধি ক্যান্সার সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে।

আজকের দিনে আমাদের অর্থনীতির অবস্থা ঠিক তদ্রূপ যেমনটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পূর্বমুহূর্তে। সরকারি দলের সাংগঠনিক অবস্থা হয়েছে সেসব কাপড়ের মতো যেগুলো আপাতদৃষ্টিতে ভালো মনে হয় কিন্তু সামান্য টান দিলেই ফ্যাত করে ছিঁড়ে যায় এবং সেই কাপড়ের পরিধানকারীকে বিব্রত অবস্থায় ফেলে। দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল এখন বিছানায় শোয়া রোগীতে পরিণত হয়েছে— অনেকের আবার কুড়িকুষ্টি পর্যন্ত হয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে অরাজনৈতিক আচরণ করে করে এমন একটি অবস্থায় পৌঁছানো হয়েছে— যে অবস্থান থেকে কেউ কোনো দিন ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ১৯৫৭ সালের তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর যেমন অবস্থা হয়েছিল— বর্তমানের পরিস্থিতি তার চেয়েও মন্দ।

সাম্প্রতিককালে সরকারের প্রধান সমস্যা পশ্চিমা বিশ্ব। এই সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। কারণ পশ্চিমারা কোনো দিন ক্ষমা করে না— সমঝোতা করে না কিংবা ছাড় দেয় না। তারা হয় পরাজিত হয় নতুবা প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে ছাড়ে। গত ৫০ বছরে তারা যেমন বহু রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক নেতার সর্বনাশ করে ছেড়েছে তেমনি নিজেরাও অনেকের কাছে বারবার অপমানিত, লাঞ্ছিত এবং অবদমিত হয়েছে। গত সাতটি বছর ধরে বাংলাদেশে সরকার অকারণে পশ্চিমা শক্তিসমূহের সঙ্গে যে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ শুরু করেছে তা সাম্প্রতিক সময়ে এসে কতটা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে তা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেই স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে কোনো আইএস নেই— পশ্চিমারা জোর করে এ দেশের ললাটে আইএসের কলঙ্ক লেপন করতে চাচ্ছে।

 

 

সরকারকে বুঝতে হবে, তাদের বর্তমান ক্ষমতা, কৌশল, শক্তিমত্তা, দমনপীড়ন প্রভৃতির কাছে দেশের বিরোধী দলগুলো যতটা অসহায় এবং ক্ষমতাহীন তার চেয়েও বেশি করুণ অবস্থায় পড়তে হবে সরকারকে পশ্চিমা ধাক্কা সামলানোর জন্য। বর্তমানে সবাই জানে আইএস, আল-কায়েদা এবং তালেবান কাদের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল। কীভাবে পশ্চিমারা এসব সংগঠনের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছে এবং দুনিয়াব্যাপী মানবতার ধ্বংস সাধন করেছে। পশ্চিমাদের রোষানলে পড়ে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া এবং সাম্প্রতিককালে সিরিয়ার কি হাল হয়েছে তা বর্তমান জমানার শিশু-কিশোররাও জানে। তারা কাউকে টার্গেট করলে সেই টার্গেট পূরণের অভিলাষ থেকে ফিরে আসে না। বিশ্বব্যাপী তাদের লাখ লাখ এজেন্ট, কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ এবং সর্বাধুনিক অস্ত্র এবং প্রযুক্তির সাহায্যে তারা স্বর্গভূমিকে বধ্যভূমি বানিয়ে ফেলে। গত অর্ধশতাব্দীর ইতিহাসে একমাত্র ইরানই পেরেছে পশ্চিমা বিশ্বকে চমত্কার এবং স্মরণযোগ্য উচিত শিক্ষা দিতে। সরকার যদি দেশ ও জাতিকে আগামী দিনের পশ্চিমা চক্রান্ত থেকে বাঁচাতে চায় তবে আধুনিক ইরানের ইতিহাস থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।

ইরানে ইসলামী বিপ্লব হয়েছিল ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। বিপ্লবের আগে দেশটি শাসন করতেন রেজা শাহ পাহলবি। মাত্র ২০ বছর সময়ের মধ্যে রেজা শাহ ইরানের সর্বক্ষেত্রে সে উন্নয়ন সাধন করেছিলেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তিনি মনে করতেন, যেহেতু তিনি যথেষ্ট উন্নয়ন করছেন এবং জনগণকে একটি আধুনিক জীবনমান উপহার দিয়েছেন সেহেতু জনগণ তার পক্ষে রয়েছে। আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে যে আন্দোলন হচ্ছিল তিনি তা শক্ত হাতে দমন করলেন। আয়াতুল্লাহ দেশ থেকে পালিয়ে ইরাক চলে গেলেন। শাহ ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দামকে অনুরোধ করলেন খোমেনিকে মেরে ফেলার জন্য। কিন্তু সাদ্দাম তার কুকর্মটি শুরু করার আগেই খোমেনি ফ্রান্স চলে গেলেন। এ অবস্থায় পুরো ইরান কয়েক বছর কবরের মতো চুপচাপ হয়ে রইল। জনগণ কিছু বলল না বটে কিন্তু মনে মনে শাহকে প্রবলভাবে ঘৃণা করতে আরম্ভ করল। তারা মনে করল, শাহ হলো ইসলাম ধর্মের শত্রু এবং মার্কিনিদের দালাল। ইরানের মতো ঐতিহ্যবাহী জাতি কোনো পাপিষ্ট দ্বারা শাসিত হতে পারে না। ফলে ১৯৭৮ সালের শেষ দিকে এসে তুচ্ছ কয়েকটি ঘটনা নিয়ে পুরো দেশ অচল হয়ে পড়ল। রাস্তাঘাট বিরোধীদের দখলে চলে গেল। খোমেনি ফ্রান্স থেকে দেশে ফিরে এসে জনগণের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন আর শাহ পালিয়ে গেলেন আমেরিকায়।

উপরোক্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারকে গভীর প্রজ্ঞা দিয়ে নিজেদের অবস্থান নির্ণয় করতে হবে। যদি তারা মনে করে যে, জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববোধ তাদের অনুকূলে সে ক্ষেত্রে তারা ইরানের ইতিহাসের পরবর্তী অংশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। ইরানের বিপ্লবী সরকার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর বাণিজ্য অবরোধ আরোপ করে এবং তাদের দেশসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে ইরান সরকারের জমাকৃত প্রায় আট বিলিয়ন ডলার আটকে দেয়। এ অবস্থায় ইরানি বিপ্লবের তরুণ নেতৃবৃন্দ তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে জরুরি বৈঠক বসে এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে, তেহরানস্থ মার্কিন দূতাবাস আক্রমণ করে সবাইকে জিম্মি করা হবে। ১৯৭৯ সালের ৪ নভেম্বর বিপ্লবী ছাত্ররা তেহরানস্থ মার্কিন দূতাবাস আক্রমণ করে ৫২ জন মার্কিন নাগরিককে জিম্মি করে ফেলে। প্রথমদিকে আয়াতুল্লাহ খোমেনি বিষয়টি জানতেন না। পরে যখন তাকে জানানো হলো— তখন তিনি উদ্ভূত পরিস্থিতিকে দ্বিতীয় বিপ্লব আখ্যা দিয়ে ছাত্রদের সমর্থন দিলেন। সারা দুনিয়া হৈচৈ আরম্ভ করল— হ্যাং করেঙ্গা, ত্যাং করেঙ্গা, লাঠিকো আন্ধার মগুর ভরেঙ্গা ইত্যাদি লম্ফঝম্ফের বিরুদ্ধে ইরানি কর্তৃপক্ষ স্থির ও অবিচল হয়ে পড়ে রইল। ছাত্ররা কয়েকটি দাবি পেশ করল। ১. ফ্রিজকৃত ইরানি অর্থ ফেরত দিতে হবে। ২. যুক্তরাষ্ট্রকে দুটি কারণে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। প্রথমটি হলো— ১৯৫৩ সালে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ইরানি প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে চক্রান্ত করে ক্ষমতাচ্যুত এবং শাহকে ক্ষমতায় বসানোর কারণে এবং দ্বিতীয়টি হলো সুদীর্ঘকাল ধরে ইরানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর কারণে। ৩. পালিয়ে যাওয়া শাহকে বিচারের জন্য ইরানে ফেরত পাঠাতে হবে।

ঘটনার সময় জিমি কার্টার ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তিনি বল প্রয়োগের সর্বচেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন এবং তড়িঘড়ি করে ইরানের সব দাবি মেনে নিলেন। কারণ অল্প কদিন পরই ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন। কিন্তু জিমি কার্টারের শেষ রক্ষা হলো না। ক্ষমতায় এলেন রোনাল্ড রিগ্যান। তিনি সর্বতো চেষ্টা শুরু করলেন তার পূর্বসূরির অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এবং সুযোগও পেয়ে গেলেন। লেবাননে তখন গৃহযুদ্ধ চলছিল। ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ গেরিলাদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য মার্কিনিরা তাদের পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে লেবাননে সৈন্য সমাবেশ করল। আত্মঘাতী বোমা হামলার মাধ্যমে একসঙ্গে ২৪১ জন মার্কিন সেনা এবং ৫৮ জন ফরাসি সৈন্যকে মেরে ফেলা হলো। এ অবস্থায় রিগ্যান প্রশাসন সঙ্গে সঙ্গে লেবানন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিল। অন্যদিকে হিজবুল্লাহদের হাতে আটক হওয়া বিপুলসংখ্যক মার্কিন ও ফরাসি সৈন্যদের মুক্ত করার জন্য প্রেসিডেন্ট রিগ্যান এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরার ওপর সে দেশের জনগণ মারাত্মক চাপ প্রয়োগ করল।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট কালবিলম্ব না করে ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করলেন এবং সামরিক সরঞ্জাম এবং যুদ্ধাস্ত্র বিক্রির বিনিময়ে ফরাসি সৈন্যদের মুক্ত করলেন। তিনি যে কারণে এত কিছু করলেন তার সবই জলে গেল। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি পরাজিত হলেন। ক্ষমতায় এলেন জ্যাক শিরাক। অন্যদিকে ইরানি কূটনৈতিক চাপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোপনে অস্ত্র বিক্রির চুক্তি করে মার্কিন সৈন্যদের ছাড়ানোর ব্যবস্থা করলেন। চুক্তি মোতাবেক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ইসরায়েল তার অস্ত্র ভাণ্ডার থেকে ইরানকে অস্ত্র সরবরাহ করবে এবং পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র সেই অস্ত্র ইসরায়েলকে প্রদান করবে। দুদফায় পুরো অস্ত্রের চালান বুঝে পাওয়ার পর জিম্মিরা মুক্ত হলো বটে কিন্তু রিগ্যান পড়ে গেলেন মহাবিপদে। ইরানকে অস্ত্র সরবরাহের চুক্তিটি ফাঁস হয়ে গেল যা কন্ট্রা কেলেঙ্কারিরূপে মার্কিন সরকারের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে ফেলল।

ইরাক-ইরান যুদ্ধের ঘটনায় মার্কিনিরা আরেকবার ইরানিদের কাছে ধরা খেল। ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সাদ্দাম হোসেন পশ্চিমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার লোভে কোনো উসকানি ছাড়াই ইরান আক্রমণ করে বসল। এই আক্রমণের অল্প কয়েক দিন পরই পশ্চিমা গোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধভাবে ইরানের বিরুদ্ধে ইরাককে সব রকম সাহায্য প্রদান শুরু করল। প্রথমদিকে ইরান খুব মার খেল। কিন্তু লেবাননের ঘটনার পর মার্কিন এবং ফরাসি অস্ত্র এবং যুদ্ধবিমান লাভ করে ইরান যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি পাল্টে দিল। এ অবস্থায় সাদ্দাম যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব দিতে বাধ্য হন। একের পর এক পরাজয় এবং বিপর্যয়ে মার্কিন প্রশাসন দিশাহারা হয়ে ইরানিদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে থাকে। এ লক্ষ্যে তারা তত্কালীন ইরানি প্রেসিডেন্ট রাফসান জানির কাছে দূত প্রেরণ করেন। জবাবে রাফসান জানি বলেন, যেভাবে কাদা ছোড়াছুড়ি হয়েছে তাতে রাতারাতি কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন হলে ইরানি জনগণ তা মানবে না। তিনি মার্কিন দূতকে সময় নিয়ে ধীরে চলার পরামর্শ দেন এবং সাংস্কৃতিক দল, শিল্পী, সাহিত্যিক এবং খেলোয়াড় বিনিময়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি সহনীয় করার কথা বলেন। মার্কিনিরা ইরানি প্রেসিডেন্টের কথায় রাজি হয়ে যায় এবং অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই একদল মার্কিন কুস্তিগিরকে তেহরান পাঠায়।

একদিকে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা এবং অন্যদিকে নানারকম চক্রান্ত, কূটকৌশল অবরোধ ইত্যাদির মাধ্যমে তারা অব্যাহতভাবে ইরানকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে। তাদের সর্বশেষ দুটি চেষ্টা হলো— আফগানিস্তানের তালেবান এবং আল-কায়েদা দিয়ে ইরানকে বিপদে ফেলা। মার্কিন গোয়েন্দা এবং আল-কায়েদার সম্মিলিত অপারেশনে সাবেক আফগান ভাইস প্রেসিডেন্ট, পানসির উপত্যকার শাসক এবং ইরানিদের দক্ষিণহস্ত জেনারেল আহম্মদ শাহ মাসুদকে মেরে ফেলা হয় ২০০১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। এ ঘটনার দুদিন পর আল-কায়েদা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ হামলা চালিয়ে টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে ফেলে। ঠিক তখনই মার্কিনিদের টনক নড়ে। তারা আফগানিস্তানে শুরু করে নির্বিচার বোমাবর্ষণ। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এ অবস্থায় তারা আবার ইরানের দারস্থ হয়। ইরান তাদের অনুগত প্রয়াত আহম্মদ শাহ মাসুদের বাহিনীর সাহায্যে কাবুল দখল করে দেয় এবং হামিদ কারজাইকে জোগাড় করে দেয় মার্কিন তাঁবেদার হওয়ার জন্য।

এত কিছুর পরও যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে তাদের চক্রান্ত বন্ধ করেনি। ইরানের পরমাণু কেন্দ্র নিয়ে সাম্প্রতিক চুক্তি এবং সিরিয়ার আইএসবিরোধী যুদ্ধের হালহকিকত সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানেন। এ দুটি ঘটনায় ইরান কীভাবে পশ্চিমা শক্তিসমূহকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে তা নিয়ে আলোচনা না করে আমরা বরং উপসংহারে চলে যাই। আজ বাংলাদেশের দরজায় আইএস নামের শব্দ তুলে মূলত পশ্চিমারা যে আওয়াজ করছে তা বন্ধ করতে হলে দরকার ইরানের মতো শক্তিশালী কূটনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক দক্ষতা। অন্যথায় শুধু সরকার নয়— পুরো জাতিকেই দুর্ভোগ পোহাতে হবে। আশা করি সরকার বাহাদুর দয়া করে তার কানগুলো দরজায় রাখবেন এবং দরজার বাইরের আওয়াজ অনুধাবনের চেষ্টা করবেন এবং বিধি-মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

-লেখক : কলামিস্ট।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর