সোমবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

শাসকরা কেন ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে

আমীর খসরু ও শাহাদাত হোসেন বাচ্চু

শাসকরা কেন ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে

প্রসঙ্গটি নতুন নয়। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং বিভাজনের রাজনীতির শুরুতেই প্রসঙ্গটি ছিল নাস্তিকতাবাদ বা নাস্তিক। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে কমিউনিস্ট ঘরানার রাজনীতির সঙ্গে যুক্তদের নাস্তিক হিসেবে অভিহিত করা হতো। পাকিস্তানের শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী যে কাউকেই তাত্ক্ষণিক নাস্তিক হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। প্রগতিশীল যে কোনো মানুষকে সহজেই এ অভিধায় অভিষিক্ত করা যেত। যেমন বাঙালিদের কাফের হিসেবে আখ্যায়িত করে ’৭১-এ নিষ্ঠুর গণহত্যা চালানো হয়। সুতরাং শুরু থেকেই নাস্তিক শব্দটি ব্যবহূত হয়েছে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিতে শোষণের মৌল উপাদান হিসেবে।

আসলে রাষ্ট্র এবং ধর্মকে একসঙ্গে মিলিয়ে ফেলার ধারণাগত ঝামেলাটা এ অঞ্চলে বেশ পুরনো। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি গঠনের অতি অল্প সময় পরেই তত্কালীন শাসকবর্গ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়ার ব্যবস্থাটি চালু করে। ‘অন রিলিজিয়ন অ্যান্ড সেক্যুলারিজম ইন দ্য মেকিং অব পাকিস্তান’ শীর্ষক এক দীর্ঘ নিবন্ধে হামজা আলাভী এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ১৯৪৯ সালের মার্চে অর্থাত্ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র দুই বছরের মাথায় পাকিস্তানের সাংবিধানিক পরিষদ বা কনস্টিটুয়্যান্ট এসেম্বলিতে একটি বিশেষ প্রস্তাব পাস করা হয়— যাতে ‘মুসলমান’দের অগ্রাধিকার দেওয়া হয় এবং কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে ব্যক্তি ও সম্প্রদায়গতভাবে বসবাসের অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়।

১৯৫০’র সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি (বিপিসি) কমিটিতে ইসলামী মতাদর্শ রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে প্রাধান্য পাবে বলে উল্লেখ করা হয়। পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের দ্বিতীয় খসড়া যখন চূড়ান্ত করা হয় তখন এবং ১৯৫২ সালের ২২ ডিসেম্বর রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি কমিটি চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দিলে দেখা গেল ‘ইসলামী আদর্শ’ একটি বিশাল স্থান দখল করে আছে। একই সময়ে তালিমাত-ই-ইসলাম নামে ইসলামী চিন্তাবিদ ও বিভিন্ন ইসলামী প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের নিয়ে একটি বোর্ড গঠিত হয়— যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ও অন্য ক্ষেত্রে আদর্শ হিসেবে কীভাবে ইসলাম বাস্তবায়ন করা যাবে সে সম্পর্কিত বিষয়াবলিতে সুপারিশ করবে বলে কর্মপরিধি নির্ধারিত হয়। এখানে দুটো বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, ওই সময় একদিকে পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, অন্যদিকে সমগ্র পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন এলিটরা এটা কখনো চাননি যে, কোনোভাবেই মাদ্রাসা পড়ুয়া ‘কতিপয় ব্যক্তির সঙ্গে’ ক্ষমতার ভাগাভাগি হোক। হামজা আলাভী বলছেন, ‘মোল্লাদের’ সঙ্গে ওই রুলিং এলিটদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। পেছনের এ ইতিহাস পর্যালোচনা এ কারণে জরুরি যে, কীভাবে শাসক শ্রেণি ধর্মকে ব্যবহার করেছে তাদের ক্ষমতার স্বার্থে। আর এ স্বার্থের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল— তত্কালীন প্রগতিশীল ও অগ্রগামী অংশকে পরাস্ত করা এবং পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা প্রশ্নকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক সংগ্রামের সূচনা হয়, তাকে প্রতিহত করা যায়। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না পূর্ব পাকিস্তানের শাসকবর্গ পশ্চিম পাকিস্তানের সমগোত্রীয়দের সঙ্গেই ছিল বরাবর।

স্বাধীনতার পরে আমাদের রাষ্ট্রচিন্তকরা রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির সঙ্গে ধর্ম নিরপেক্ষতা জুড়ে দিয়েছিলেন, অত্যুত্সাহে। তারা ভুলেছিলেন যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আলাদাভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা উচ্চারণ করার দরকার হয় না। ‘রাষ্ট্র যদি গণতান্ত্রিক’ হয়ে ওঠে তাহলে সেই রাষ্ট্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে ওঠে। গণতন্ত্র তো নিরপেক্ষভাবে সব ধর্মের মানুষদের সমন্বিত আশ্রয় হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় চরিত্রের মধ্যেই। আর এটি একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা।

যুক্তরাষ্ট্রের অস্টিনের পেই ইউনিভার্সিটির সিকিউরিটি স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিশ্লেষক তাজ হাশমী তার এক সাম্প্রতিক নিবন্ধে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ কি বাংলাদেশে কখনো শেকড় গেড়েছিল? ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হচ্ছে পাশ্চাত্য ধারণা। পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকায় রেনেসাঁস, রিফর্মেশন, এনলাইটমেন্ট এবং রাজনৈতিক ও শিল্প বিপ্লবের পর সেটা বিকশিত হয়ে উঠেছিল। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ ও ‘গণতন্ত্র’, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পর যেভাবে ঘোষিত হয়েছিল— মনে রাখতে হবে, ঘোষণা করা হলেই কোনো জাতি রাতারাতি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক হতে পারে না। বাংলাদেশে কেন গণতন্ত্র কার্যকর হতে পারেনি তার প্রধান কারণ নিহিত রয়েছে এখানকার দীর্ঘ আধা সামন্তবাদী ও ঔপনিবেশিক ঐতিহ্য, সেই সঙ্গে রাজনীতিবিদ ও এলিটদের ধর্ম ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুযোগ মতো ব্যবহার করার মধ্যে। এসব কারণেই গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ এই দেশে দৃঢ়ভাবে শেকড় গাড়তে পারেনি। এসব প্রাক-আধুনিক ঐতিহ্য ধর্মভাব, কুসংস্কার ও বৈষম্য বিকাশ ঘটায়, সাক্ষরতা, সৃষ্টিশীলতা ও মুক্তচিন্তাকে চেপে ধরে এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে অসঙ্গত করার জন্য ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে।’

এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিশেষ করে রাজা ও রাজ্য শাসনে প্রভাব বিস্তার নিয়ে মধ্যযুগে এবং তার আগেও ইউরোপে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার সূত্রপাত যদিও আরও অনেক আগের। তবে মধ্যযুগের আলোচনায় গেলে এটা দেখতে পাওয়া যায় যে, ১৩৭০-এর দিকে জ. উইক্লিফসহ অনেকেই তত্কালীন পোপ প্রথা এবং পোপকে অর্থ প্রদান, তার সম্পত্তি থাকার প্রবল বিরোধিতায় নামলেন। তারা চার্চের সীমাহীন ক্ষমতার ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপন করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে চার্চ ব্যবস্থা সংস্কারের দাবি উত্থাপন করেন। এরও দেড়শ বছর পর মার্টিন লুথার প্রকাশ্যেই তত্কালীন রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রচলিত নিয়মনীতির বিরোধিতায় নেমে পড়লেন। পোপ এবং বিভিন্ন চার্চগুলো ছিল সামন্ত প্রভুদের প্রবল সমর্থনে পুষ্ট। স্বাভাবিক কারণেই তারা মার্টিন লুথারের বিপক্ষে ছিলেন। অন্যদিকে মার্টিন লুথারকে সমর্থন দিয়েছিল— একদিকে নব্য পুঁজিপতি শ্রেণি, শহুরে এলিট শ্রেণি এবং অন্যদিকে কৃষক সম্প্রদায়। তাদের ওই সমর্থনের পেছনে ভিন্ন ভিন্ন কারণ থাকলেও তাদের উদ্দেশ্য ছিল চার্চ এবং এর যাজকদের সীমাহীন কর্তৃত্বমূলক এবং অর্থ উপার্জনের পথকে অস্বীকার করা। তবে মার্টিন লুথার শেষ পর্যন্ত পোপ এবং ক্যাথলিক চার্চ ও এর যাজকদের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করলেও ধর্মকে কোনোক্রমেই অস্বীকার করেননি। তিনি থেকে গিয়েছিলেন খ্রিস্ট ধর্মের সংস্কারক  হিসেবেই। তবে এর প্রভাবটি যে সুদূরপ্রসারী হয়েছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

ইউরোপজুড়েই আগে-পরে নানা ঘটনা ঘটতে থাকে যা আগেই বলা হয়েছে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে— যাতে পরবর্তীকালে রাষ্ট্র এবং চার্চের ক্ষমতার বিষয়টি আলাদা হয়ে যায়। আর এ কারণে ধর্ম রাষ্ট্রের সঙ্গে সমার্থক হয়ে উঠেনি। ইংল্যান্ডে রাজার সঙ্গে চার্চ অর্থাত্ খ্রিস্ট যাজকদের ক্ষমতার আধিপত্য এবং কার কর্তৃত্ব চলবে সে প্রশ্নে দীর্ঘকাল লড়াই চলেছে। এটি মূলত শুরু হয়েছিল রাজা প্রথম হেনরির (১০৬৮-১১৩৪) সময়কাল থেকেই। ইউরোপজুড়ে এ ধরনের নানা যুদ্ধ ও লড়াইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এসব পরবর্তীকালে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করার ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা পালন করেছে। তবে শিল্পবিপ্লব এবং পুঁজিপতি, বুর্জোয়াশ্রেণির উত্থান এসব বিষয় রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করে রাখার ক্ষেত্রে সীমাহীন অবদান রেখেছে।

৪৫ বছরে সংবিধানকে কাটা-ছেঁড়া করা হয়েছে ১৫ বার। অজস্র গোঁজামিলে রাষ্ট্র পড়েছে বিভ্রান্তির মধ্যে। পঞ্চদশ সংশোধনীর পরে দাবি করা হয়েছিল, ১৯৭২’র মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারটি। ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিস্থাপনের পরেও সংবিধান শুরু হয়েছে পরম করুণাময়ের নামে। আবার প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম রয়েছে। অথচ মূলনীতিতে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের মতো আদর্শকে বলা হচ্ছে মূলনীতি। ফলে এ সংবিধানে রাষ্ট্র ও আদর্শ বিভাজিত নয়। কি অদ্ভুত বৈপরীত্য!

এরকম একটি গোঁজামিলের মধ্যে বলা হচ্ছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ চাই। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না। অথচ এ রাষ্ট্রে ধর্ম হচ্ছে আদর্শ বা ইডিওলজি। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার মানেই হচ্ছে রাষ্ট্র আদর্শভিত্তিক রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেবে না। তাহলে সেই আদর্শকে কেন রাষ্ট্র সুরক্ষা দিচ্ছে? এ দ্বিচারিতা কি আধুনিক কোনো রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নীতি হতে পারে? আমাদের রাজনীতিবিদরা সংবিধানের মৌলিক বিষয়গুলোকে সাংঘর্ষিক রেখে জনগণকে প্রতিনিয়ত বিভ্রান্তির মধ্যে রাখছেন। রাষ্ট্রের সংবিধানে এরকম গোঁজামিলের কারণে সৃষ্ট বিভ্রান্তির শিকার এ জনপদের মানুষও এক বৈপরীত্যময় জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। সে যুক্তিনির্ভর নয়, বিজ্ঞানমনস্ক নয়।

বিপরীতমুখী বিশ্বাস তার সম্বল। কুসংস্কার ও কুযুক্তি সঙ্গে নিয়ে সে বেড়ে উঠছে, জীবনভর চলছে এবং পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে। ভিতরের আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছার অবদমন চলছে অনুক্ষণ এবং বিভ্রান্ত ও বিরক্ত হয়ে গড্ডলিকায় গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। রাষ্ট্রীয় মূলনীতির বহুমাত্রিক বৈপরীত্যের কারণে ব্যক্তি-পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র, সবখানেই অধিকতর জটিলতা তৈরি হচ্ছে, যা সব সুনীতি নির্বাসনে পাঠিয়ে দিচ্ছে।

-লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর