শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

এক অনাবিল আনন্দে ঘরে ফেরা—

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

এক অনাবিল আনন্দে ঘরে ফেরা—

’৭২-এর মার্চে ২০/৩০ বাবর রোডে এসেছিলাম। তখন বাবা-মা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পদভারে বাড়িটি গমগম করত। কত জ্ঞানী-গুণী, কত নেতা-মন্ত্রী এসেছেন বাবর রোডে। বঙ্গবন্ধুর পদধূলিতে কয়েকবার ধন্য হয়েছে আমার বাড়ি। ’৭৫-এ তিনি নিহত হলে প্রতিবাদে এক কাপড়ে বাড়ি ছাড়ি। কত যুদ্ধবিগ্রহ, ঝড়ঝঞ্ঝার পর ’৯০-এর ১৬ ডিসেম্বর দেশে ফিরে কোথাও জায়গা না পেয়ে স্যার সৈয়দ রোডে ছোট বোন শাহানার বর দুলালের বাড়ি উঠেছিলাম। ২০ ডিসেম্বর থেকে আবার সেই বাবর রোডের বাড়িতে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, ড. কামাল হোসেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, কত সাহিত্যিক, সাংবাদিক, মন্ত্রীবৃন্দ এসেছেন তার হিসাব-নিকাশ নেই। বাবর রোডেই আছি আবার ২৫ বছর। জানুয়ারিতে সারা দেশ যখন জ্বলছিল, পুড়ছিল, হরতাল-অবরোধে দেশবাসীর নাভিশ্বাস উঠেছিল তখন বিবেকের তাড়নায় উপায়ান্তর না দেখে মতিঝিলে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের অফিসের সামনে ফুটপাথে অবস্থান নিয়েছিলাম। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাস্তায় পড়ে থাকলে তাও যদি নেতানেত্রীদের চৈতন্য হয়, দেশে শান্তি আসে। বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছে আহ্বান ছিল, অবরোধ-হরতাল প্রত্যাহার করুন, আলোচনায় বসুন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছিলাম, দেশের শান্তির জন্য যার সঙ্গে প্রয়োজন তার সঙ্গে আলোচনা করুন। ২৮ জানুয়ারি থেকে ১ ডিসেম্বর দীর্ঘ ৩০৮ দিন পর ২ ডিসেম্বর ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় বসেছিলাম। পেপারে চোখ বুলিয়ে চা পান করতে করতে কেমন যেন নতুন নতুন ভালো ভালো লাগছিল। প্রাণের ধন আমার জিয়নকাঠি কুশিমণির স্কুল না থাকলে তেমন একটা সকালে ওঠে না। বড় মেয়ে কুঁড়িরও একই দশা। ছেলে দীপও খুব একটা ব্যতিক্রম নয়। সবার দেরিতে ওঠা আর আমার সকালে ওঠা অভ্যাস। চেষ্টা করেছি সবাইকে সকাল সকাল ওঠাতে, আল্লাহ রসুলের নাম নিতে। আল্লাহ রসুলের নাম নেয় ঠিকই, কিন্তু সকাল সকাল ওঠে না। এমনিতে কুশিমণি বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখে। সুন্দর পরিচালনায় সিদ্ধহস্ত। কম্পিউটার অপারেটর, গাড়ির ড্রাইভার, কাজের লোক, মা-বাবা, ভাইবোন যখন যাকে যেভাবে চালানো দরকার কোথাও কোনো ত্রুটি নেই। আদর সোহাগ, বকাঝকা যাকে যা দরকার একেবারে বড়দের মতো। কদিন আগে জ্বর হয়েছিল। তাই মেজাজটা আগের চেয়ে একটু কড়া। আমি যেন কী করছিলাম। হঠাত্ই কুশির গলা শুনে আঁতকে উঠে মনে পড়ল জাতীয় সংগীতের কটি কলি—

‘মা তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,

মরি হায়, হায়রে—

মা, তোর বদনখানি মলিন হলে,

ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি’

সেই প্রথম উপলব্ধি করলাম, এই ৩০৮ দিন আমি কত কিছু হারিয়েছি। কত মধুময় সুধা পান থেকে আমার অন্তরাত্মা, আমার হূদয় বঞ্চিত হয়েছে। বার বার মনে হয়েছে কুশিমণির সুধাময় কণ্ঠ না শুনে ওকে না দেখে এতদিন শুধুই নয়ন জলে ভেসেছি। বড় দুই ছেলেমেয়ে দীপ-কুঁড়ির জন্য যে মন কাঁদে না তা নয়। সব সময় ওরা আমার সমস্ত অস্তিত্বজুড়ে খেলা করে। আমি তো এখনো ওদের আমার শরীরেরই অংশ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারি না। কিন্তু ছোটটার জন্য মনটা সব সময় একটু বেশি চঞ্চল থাকে। তাই ওকে নিয়ে দু-চার কথা বেশি বলি।

শুনেছিলাম, ছোটকালে মেয়েরা মা-বাবার নিয়ন্ত্রণে থাকে। বড় হলে স্বামীর, বয়সকালে ছেলেমেয়ে, নাতিপুতির। আমার ব্যাপারটাও অনেকটা তাই। ছেলেবেলায় বাবা-বড় ভাই কত শাসন করতেন, নির্যাতন, মারধর করতেন। কিন্তু তাদের ভয় করতাম না। যে মা আমার গায়ে শক্ত করে হাত বুলাননি তার ভয়ে সব সময় কম্পমান থাকতাম। বয়সকালে স্ত্রী এলো। তার সঙ্গে শুরুতে খটাখটি হতো। দিন যত গড়িয়েছে ততই আমাদের বোঝাবুঝি হয়েছে। মা কুশি আসার পর সে এখন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেছে। আমার ইদানীং মনে হয় মা যেমন জন্ম দিয়ে পরম আদরে লালন-পালন করে ছেলে বড় করে, ঠিক তেমনি সত্যিকারের নারী স্বামীর ঘরে ধীরে ধীরে স্ত্রী থেকে মা হয়ে স্বামীকে সন্তানের চেয়ে অধিক দরদে শেষ জীবন পার করে। আমার স্ত্রীকে এখন আমি আমার মায়ের প্রতিচ্ছবি ছাড়া অন্যকিছু ভাবী না। সব স্ত্রী অমন না হলেও অনেক স্ত্রী তেমন হয়। দু-চার বছর আগেও কখনোসখনো একটু আধটু বিরক্ত করলেও এখন আমার দুঃখ আমার কষ্ট সে বুঝে তাই করে না। কুশিমণি কিছু মনে করবে এ ভয়ে ওর মাকে আওয়াজ করে কিছু বলা যায় না। আমি তো নয়ই, তার ভাইবোনেরা মায়ের সঙ্গে জোরে কথা বললে জবাবদিহি করতে হয়। এসব নানা কারণে রাজনৈতিক-সামাজিকভাবে ছোটখাটো অস্বস্তি থাকলেও আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বাড়িতে পরম যত্ন ও স্বস্তিতে রেখেছেন। রাস্তাঘাটে বাইরে বাইরে অতটা অভাববোধ হতো না, যতটা ইদানীং ঘরে ফিরে হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে দীর্ঘ ১৬ বছর ভারতে নির্বাসনে কাটিয়ে ’৯০-এর ১৬ ডিসেম্বর যেদিন বাবর রোডে ঢুকেছিলাম, সেদিন যেমনটা লেগেছিল অনেকটা তেমনই লাগছিল। সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম গুলশান ক্লাবে। কোনো ক্লাবে আমার তেমন যাতায়াত নেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খানের আহ্বানে ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতির স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জি তার ভরতনাট্যম নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। দিদিকে বাবর রোডে আনতে সেই প্রথম গুলশান ক্লাবে যাওয়া। বাবর রোডে এসে রান্নাঘরে ঢুকে দিদি নাসরীনের হাতের যে ইলিশ ভাজা খেয়েছিলেন তা আজীবন ভোলেননি। আমি কোনো দিন কোনো ক্লাবের সদস্য ছিলাম না, কোনো ক্লাবে তেমন যাইও না। দ্বিতীয়বার গুলশান ক্লাবে যাই পীর হাবিবের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে। আর পয়লা ডিসেম্বর গিয়েছিলাম বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক প্রিয় নঈম নিজামের আহ্বানে ভারতের মান্যবর রাষ্ট্রদূত পঙ্কজ শরণের বিদায় অনুষ্ঠানে। পঙ্কজ শরণ কংগ্রেস আমল থেকে বিজেপি আমল পর্যন্ত ঢাকায় দায়িত্ব পালন করে গেলেন। বেশ কয়েকবার তার সঙ্গে দেখা ও কথা হয়েছে। সেদিনও হায়-হ্যালো হয়েছে। শ্রী পঙ্কজ শরণ আর আমার ছোট বোন শর্মিলা বকশী মিলুর স্বামী পাঞ্জাবের অখিল বকশী রাজীব গান্ধীর সময় প্রধানমন্ত্রীর দফতরে একসঙ্গে কাজ করতেন। অখিল এক অসাধারণ মানুষ। পাগলের মতো আমাকে ভালোবাসে। গাড়ির বহর নিয়ে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো তার প্রধান শখ। একবার নেপালে গিয়ে গাড়ি-ঘোড়া নিয়ে বরফে আটকা পড়েছিল। পরে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার তাদের উদ্ধার করে। নঈম নিজামের আহ্বানে পঙ্কজ শরণের বিদায় অনুষ্ঠানে গিয়ে বেশ কজন মন্ত্রীসহ অনেক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী, আওয়ামী লীগ, বিএনপির নেতা ও অনেক সাংস্কৃতিক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়। বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান জনাব শাহ আলম ভীষণ আন্তরিকতার সঙ্গে অতিথিদের আপ্যায়ন করছিলেন। বিত্তবান মানুষ কিন্তু আচার-আচরণে তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছিল না। হাসিমুখে সবাইকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিলেন যা আমার খুব ভালো লেগেছে। নঈম নিজামকে বহুদিন পর খুবই স্বতঃস্ফূর্ত মনে হলো। বসুন্ধরা গ্রুপের আমার আরেক প্রিয় শামীমকে সেদিন দেখিনি। শামীমরা ৯ ভাই, ১ বোন। সবাই মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়েছিল। কুষ্টিয়ার অ্যাডভোকেট খন্দকার লুেফল হক ও বেগম সখিনা খাতুনের সন্তান খন্দকার মাসুদুল হক (রাজু আহমেদ), খন্দকার আমিনুল হক বাদশা, খন্দকার রাশিদুল হক নবা, খন্দকার এমদাদুল হক (মান্না হক), খন্দকার এনামুল হক টিপু, খন্দকার ওবায়দুল হক সেলিম, খন্দকার শামসুল হক লালিম, খন্দকার কামরুল হক শামীম, খন্দকার নুরুল হক নাসিম ও নাদিরা বানু কল্পনা। পরিবারের বড়রা প্রায় সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। মাসুদুল হক রাজু আহমেদ স্বাধীন বাংলা বেতারে ‘জল্লাদের দরবার’ নামে এক ভীষণ জনপ্রিয় অনুষ্ঠান করতেন। স্বাধীনতার পরপরই আততায়ীর হাতে নিহত হন। তার উপযুক্ত বিচার হয়নি। খন্দকার আমিনুল হক বাদশা বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন। এই কদিন আগে দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতারে গান গাইত মান্না হক, আমাকে পিতার মতো ভালোবাসত, সম্মান করত। ’৮৯ সালে লন্ডন সফরে প্রায় ছয় মাস আমার পাশে পাশে ছায়ার মতো ছিল। তার স্ত্রী মিঠু শুধু খন্দকার মোশতাক আহমদের ভাস্তি হওয়ার কারণে সংসার ভেঙেছে। মান্নাকে কিছুতে বোঝানো যায়নি, মিঠু বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নেতা খন্দকার মোশতাকের ভাস্তি হলেও তাদের বিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার অনেক আগে হয়েছে। এখানে মিঠুর অপরাধ কী? কিন্তু তাহলে কী হবে, মিঠুকে সে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সহ্য করতে পারত না। পরিণামে বিচ্ছেদ। কে এসবের খবর রাখে? মেয়ে শাউলি, ছেলে প্রিতম দেখতে শুনতে যেমন তেমনি আমাকে খুবই ভালোবাসত। পরে শুনেছি শামীম সেদিন বাইরে থাকায় অনুষ্ঠানে ছিল না।

এ কদিন দাওয়াতে দাওয়াতে কেটেছে। গত ৬ তারিখ ছিল এরশাদবিরোধী আন্দোলনের এক উল্লেখযোগ্য দিন। ওইদিন গোপালগঞ্জের কামারখালীতে এক বেইলি ব্রিজ উদ্বোধন করে লাখো মানুষের সামনে গর্ব করে দেশের উন্নয়ন নিয়ে জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দিয়ে ঢাকায় ফিরেই পদত্যাগ। তাই দিনটি স্বৈরাচার পতন, গণতন্ত্র মুক্তির দিন। অন্যদিকে ১৯৭১-এর ৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে মহান ভারত আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছিল। যে স্বীকৃতি সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে মুক্তির দিশা দেখিয়েছিল। সেই ৬ ডিসেম্বর বসুন্ধরা গ্রুপের ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারের ৪ নম্বর হলে ইসলামপুরের সাবেক এমপি সুলতান মাহমুদ বাবু বড় মুখ করে বাসায় এসে দাওয়াত দেওয়ায় সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের প্রাণপুরুষ মো. রুহুল আমিনের ছেলে সাইফের বিয়েতে গিয়েছিলাম। অসম্ভব আদরযত্ন করেছেন তারা। হুমড়ি খেয়ে চিত্রনায়ক ফারুকের ভাই আয়ুব খানের সালাম করা আমাকে পাগল করে দিয়েছিল। অত ভিড়েও কিছু পাগল ছাড়তে চায় না। খাবার টেবিলে পাশে বসেছিল সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সচিব শফিক আলম মেহেদী, সামনে কসবার নেতা শাহ আলম এমপি। মেহেদীর লেখার বাতিক আছে। ’৯৬-এর বাসাইল-সখীপুর-কালিহাতীর ঘূর্ণিঝড়ে ভদ্রলোককে দেখেছিলাম। তখনকার অফিসার আর এখনকার অফিসারদের মধ্যে আসমান জমিন পার্থক্য। যোগ্যতা, মেধা সব দিক থেকেই। জাতীয় নির্বাচনের তখন খুবই তোড়জোড়। গভীর রাতে টাঙ্গাইল থেকে ছুটে এসেছিলাম বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে। পরদিন খুলনায় কর্মসূচি ছিল। তার মধ্যেই তাকে ঘূর্ণিদুর্গতদের একবার দেখে আসতে অনুরোধ করেছিলাম। তখন আমার অনুরোধ তিনি রাখতেন। ভীষণ কষ্ট করে সাড়ে ৭টা-৮টার মধ্যে বাসাইল পৌঁছেছিলেন। সব জায়গায় যেতে পারেননি। কিন্তু যেখানে যেখানে যাওয়া সম্ভব, সেখানে গিয়েছিলেন এবং ১১টার দিকে সোজা খুলনার পথে রওনা হয়েছিলেন। শত শত মানুষের মধ্যে একপর্যায়ে দুর্গতদের দেওয়ার জন্য আমার হাতে ২০ হাজার টাকা গুঁজে দিয়েছিলেন। অমন জায়গায় কারও হাতে টাকা দেওয়ার চেয়ে বড় বিড়ম্বনা আর কিছু হয় না। আমি না হয়ে অন্য কারও হাতে ওইভাবে টাকা দিলে দুস্থরা তাকে ছিঁড়ে খেত। ২০ হাজারের জায়গায় ২০ লাখ দিলেও দাবি মিটত না। এ রকম আর একটি ঘটনা বলি। কাগমারী কলেজ সরকারিকরণ ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধু গাড়িতে উঠেছেন। পেছনে হুজুর মওলানা ভাসানী আর বঙ্গবন্ধু, সামনের সিটে আমি। হুজুরের বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামলে ভিড়ের মধ্যে কিছু লোক বঙ্গবন্ধুর কাছে সাহায্য চায়। একে ওকে ১০০, ২০০ টাকা দেন। তখন ১০০ টাকার মূল্য ছিল।

১০০ টাকায় ১০-১৫টা প্রমাণ সাইজের আস্ত ইলিশ কেনা যেত। ১০০ টাকায় ১২ আনি সোনা পাওয়া যেত। ১০০, ২০০ করে মনে হয় এক-দেড় হাজার দিয়েছিলেন। বাকিটা জননেতা আবদুল মান্নান ভাইয়ের হাতে গুঁজে দেন, যেমনটা মিরিকপুরে জননেত্রী আমার হাতে দিয়েছিলেন। লোকজন তখন মান্নান ভাইকে ছিঁড়ে খাবার অবস্থা। মান্নান ভাই আমার মতো বোকা ছিলেন না, ভীষণ মেধাবী ছিলেন। উপায়ান্তর না দেখে মুঠ করা টাকা হুজুরের হাতে দিয়ে দেন। অবাক কাণ্ড, আর হুড়োহুড়ি, পারাপারি নেই, সব শান্ত। আর ৫টা লোকও হুজুরের কাছে হাত পাতেননি। বড় অবাক হয়েছিলাম সেদিন। কত বড় মাপের নেতা ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। হুজুর ভাসানীর সব থেকে প্রিয় বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশে কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র নিতে প্রথম টাঙ্গাইল গিয়েছিলেন। আবার রাজধানীর বাইরে কাগমারী মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ সরকারি করতে টাঙ্গাইলেই তার শেষ সফর।

বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টার থেকে ক্যান্টনমেন্টের ভিতর দিয়ে ফিরছিলাম। এমনিতে সাধারণ সৈন্যরা আমায় ভীষণ ভালোবাসে, সম্মান করে। গেটে চার-পাঁচ জন ছিল। গাড়ি থামাতেই সবাই হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। তার মধ্যে টাঙ্গাইল দেলদুয়ারেরও একজন ছিল। মনে হলো আমাকে দেখে তারা খুব খুশি হয়েছে যেমন বাপ-চাচাকে দেখে হয়। দীর্ঘদিন বাংলাদেশ প্রতিদিনে লিখি। বলতে গেলে বাংলাদেশ প্রতিদিনের জন্মের মাসখানেক পর থেকেই শুরু। দেখতে দেখতে কত দিন চলে গেল। ২০১০ সালে সশস্ত্র বাহিনী দিবসে সেনাকুঞ্জে গিয়েছিলাম। কেবলই জন্ডিসের আক্রমণ থেকে উঠেছি। শরীর একেবারে ভেঙে গিয়েছিল। ভিআইপি তাঁবুর এক পাশে স্বামী-স্ত্রী বসেছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমার ভগ্নি জননেত্রী শেখ হাসিনা সেখানে আসেন। নাসরীনের পাশে আমাকে দেখে আঁতকে উঠে বলেন, ‘বজ্র, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’ আমার বলার আগেই নাসরীন বলেছিল, ‘ওর জন্ডিস হয়েছিল।’ নাসরীনের মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘নাসরীন ওকে প্রত্যেক দিন মুলা সিদ্ধ দেবে। জন্ডিসের জন্য মুলা সিদ্ধ খুবই উপকারী।’ প্রধানমন্ত্রীর কথায় সেদিন মনে হয়েছিল তিনি যেন একজন চিকিত্সকও বটে। সেদিন ছিল দারুণ ঝলমলে সেনাকুঞ্জ। কিন্তু গত পরশু অন্ধকারে ডুবে থাকা সেনাকুঞ্জ বড় বেমানান ঠেকেছে।

লেখক : রাজনীতিক

সর্বশেষ খবর