মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

তৃতীয় মহাযুদ্ধের গর্জন কি শোনা যাচ্ছে?

মুহাম্মদ রুহুল আমিন

তৃতীয় মহাযুদ্ধের গর্জন কি শোনা যাচ্ছে?

সিরিয়া ইস্যুকে কেন্দ্র করে যদি অত্রাঞ্চলে বড় কোনো যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে আমি অবাক হব না। এমনকি সিরিয়ায় রাশিয়া, ফ্রান্স এবং অন্যান্য পাশ্চাত্য শক্তির সামরিক অভিযানের কারণে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনাও আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না এ মুহূর্তে।

আরব বসন্তের পর মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো সিরিয়ায়ও সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হয়। সিরিয়ার সরকারবিরোধীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের উত্খাতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। বাশারবিরোধী বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ডে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সিরিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেয়ে দেশটিতে পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত স্বার্থসিদ্ধিই ছিল বাশার বিরোধিতার মূল লক্ষ্য। স্পষ্ট যে, সিরিয়ায় দেশটির চিরায়ত মিত্র রাশিয়া ও প্রতিবেশী বন্ধু ইরান— এ দুটি রাষ্ট্রের আধিপত্য খর্ব করতে পাশ্চাত্যের মদদপুষ্ট বিদ্রোহীরা মরিয়া হয়ে ওঠে। সংগত কারণে বাশারবিরোধীরা সিরিয়া ও সিরিয়ার বাইরে তাদের আন্দোলনের যৌক্তিতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়। তদুপরি বাশারবিরোধীরা এতটাই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে যে তাদের লক্ষ্য ও চেতনা ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র সৌদি আরব এবং উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও শাসনতান্ত্রিক কাঠামো সিরিয়ার মতোই স্বৈরতান্ত্রিক। রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের চারণভূমি মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশগুলোর প্রতি সমর্থন অক্ষুণ্ন্ন রেখে সিরিয়ার সরকারকে দোষারোপ করে সেই সরকারকে সরিয়ে দেওয়ার পাশ্চাত্য উদ্যোগ তাই বৈশ্বিক বিশ্বাসযোগ্যতা লাভ করতে পারেনি। গত কয়েক বছর বাশারবিরোধী আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করেছে রাশিয়া ও ইরানসহ তার উপসাগরীয় মিত্রদেশগুলো। সিরিয়ায় যুদ্ধরত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের দমননীতির প্রতি তারা বাহ্যিকভাবে সমর্থন দিয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশন চলাকালে গত ২৮ সেপ্টেম্বর ওবামা ও পুতিন সিরিয়ার সন্ত্রাসী দমনে একযোগে কাজ করার ‘গঠনমূলক আলোচনা’ সম্পন্ন করেছেন। বোঝা যাচ্ছে, রাশিয়া সিরিয়ায় সামরিক অভিযান শুরু করার যৌক্তিকতা অনুসন্ধান করছিল। যৌথ আলোচনার মাত্র দুই দিন পর ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়া তারতুজ নৌ ঘাঁটি ও কাস্পিয়ান সাগর থেকে সিরিয়ায় বিমান হামলা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সূচনা করে। ওবামা-পুতিনের আলোচনায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অনুমতি লাভ হয়েছে, রাশিয়া তাই আইএসসহ সিরিয়ায় যুদ্ধরত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে। তবে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে সন্ত্রাসীদের চিহ্নিতকরণে পার্থক্য রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আইএস ও বাশারপন্থিদের সন্ত্রাসী হিসেবে গণ্য করছে। কিন্তু রাশিয়া আইএস ও বাশারবিরোধী বিপ্লবীদেরও সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচনা করছে।

মিত্ররাষ্ট্র হিসেবে সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নিরসনে সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে সহযোগিতা করা রাশিয়ার নৈতিক দায়িত্ব এবং আন্তর্জাতিক আইনে মিত্ররাষ্ট্রের প্রতি এমন সহযোগিতা অন্যায় নয়। সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত যৌথ বাহিনীর অভিযানের পক্ষে না আছে জাতিসংঘের সমর্থন, না আছে সিরিয়া সরকারের আহ্বান। পুতিনের কাছে তাই সিরিয়ায় পাশ্চাত্যের সামরিক অভিযান অন্য রাষ্ট্রে আগ্রাসনের শামিল ও অন্য দেশের অভ্যরীণ ব্যাপারে অন্যায় হস্তক্ষেপ, এবং সে কারণে সিরিয়ায় পাশ্চাত্যের হস্তক্ষেপ বেআইনি ও অন্যায় এবং আন্তর্জাতিক রীতিবিরোধী।

সিরিয়ায় রাশিয়ান অভিযান আরেকটি কারণে যুক্তিযুক্ত হতে পারে যে, ইউরোপে সিরিয়ার শরণার্থীদের ব্যাপারে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সিরিয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন প্রয়োজন। চার বছর ধরে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলো সিরিয়ার গৃহযুদ্ধকে পুঁজি করে ওই দেশের জনগণকে বিতাড়িত করেছে, বেসামরিক এলাকায় বোমা বর্ষণ করে নিরীহ জনগণের হত্যায় ফাঁদ পেতেছে এবং সর্বোপরি সিরিয়াকে রাষ্ট্র হিসেবে চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছে। সিরিয়ার অসহায় জনগণ দলে দলে ভূমধ্যসাগরে বিশাল জলরাশি অতিক্রম করে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ইউরোপে শরণার্থী হিসেবে পাড়ি দিচ্ছে এবং জীবন-যন্ত্রণার সব অভিশাপ ভোগ করছে। রাশিয়ার সামরিক অভিযানের প্রধান লক্ষ্য হলো ভেঙে খান খান হওয়া সিরিয়া রাষ্ট্র পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখা, বাশারের নেতৃত্বাধীন সরকারকে সহযোগিতা করে স্থিতিশীল রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখা এবং সিরীয়দের মরণযন্ত্রণার অবসান ঘটানো। ইরাক, আফগানিস্তানসহ অন্যত্র গণতন্ত্র রক্ষার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ‘মানবিক হস্তক্ষেপের’ নামে পাশ্চাত্যের সামরিক অভিযানের কোনো নৈতিক ও আইনি ভিত্তি নেই। কিন্তু সিরিয়ায় রাশিয়ার অভিযানের মানবিক তাত্পর্য অনস্বীকার্য।

পুতিনের সিরিয়া অভিযানের আরেকটি কারণ হলো সাবেক পরাশক্তি হিসেবে রাশিয়ার রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তি যে এখনো তাত্পর্যপূর্ণ, তা পাশ্চাত্যকে জানানো। ইউক্রেন ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার প্রতি পাশ্চাত্য নীতির প্রতিশোধ নেওয়া হচ্ছে সিরিয়া অভিযানের মাধ্যমে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তার সিরিয়া নীতির সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করেছে এবং সে কারণে আকাশ-নিরাপত্তা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার জন্য রাশিয়াকে আহ্বান করেছে। অধিকন্তু সিরীয় বিদ্রোহীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত বিতর্কিত ট্রেনিং ও অস্ত্র সরবরাহ কর্মসূচিতে আপাতত ধীরগতি আনা হয়েছে। সিরিয়া চায় পাশ্চাত্য অনুধাবন করুক যে রাশিয়া সাবেক পরাশক্তি এবং পাশ্চাত্যকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা তার আছে। ইউক্রেন ইস্যুকে পুঁজি করে রাশিয়ার প্রতি পাশ্চাত্যের বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার অবসান চায় রাশিয়া, জি-৮ গ্রুপের সদস্য পদও ফেরত চায় রাশিয়া। সর্বোপরি মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র ক্ষমতা দেখানোর যুগ শেষ হয়েছে, এ বার্তাও পৌঁছে দিতে চায় রাশিয়া।

এ মুহূর্তে ভাববার বিষয় হলো, সিরিয়ায় রুশ সামরিক অভিযানের ফলে সিরিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি কি স্বাভাবিক হবে নাকি সিরিয়াসহ অত্রাঞ্চলে বৃহত্ যুদ্ধ শুরু হবে। এ প্রশ্নের উত্তর নিহিত রয়েছে রুশ সামরিক অভিযানের প্রতি পাশ্চাত্যের নীতির প্রকৃতি ও পরিধি জুড়ে। গত চার বছরের ক্রমাগত আক্রমণ এবং ৭ হাজার বার বিমান হামলার পরও পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলো আইএসসহ সিরীয় সন্ত্রাসীদের কুপোকাত করতে যখন হিমশিম খেয়েছে, গত ১০ দিনের রুশ অভিযানে সেখানে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে। রাকা, হামা, দামেস্ক ও আলেপ্পোসহ অন্যান্য প্রদেশে অবস্থিত আইএস সন্ত্রাসীদের কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, অস্ত্র গুদাম এবং ট্রেনিং কেন্দ্রগুলোর ব্যাপক ধ্বংস সাধন হয়েছে বলে বিশ্ব মিডিয়ায় খবর প্রচারিত হয়েছে। রাশিয়ার একক এ সামরিক অভিযানের সঠিক মূল্যায়ন করে পাশ্চাত্য দেশগুলো যদি সিরিয়ার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নে রাশিয়ার সঙ্গে একত্রে কাজ করে তাহলে সিরীয় জনগণের দুর্ভাগ্যের অবসান ঘটতে পারে। এ ব্যাপারে ‘গঠনমূলক আলোচনা’ শুরুর সময় এখন এবং এখনই। জাতিসংঘের ওপর গুরুদায়িত্ব বৃহত্ শক্তিগুলোকে আলোচনায় নিয়ে আসা। আর যদি পাশ্চাত্য রাশিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে, ফ্রান্সের মতো অন্যরাও বিমান আক্রমণ চালায় তাহলে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির তৈরি হতে পারে। অত্র এলাকায় ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে যে কোনো সময়। এখানে কেবল একটি গুলিই যদি ভুল বোঝাবুঝির পরিবেশ তৈরি করে তাহলে বৃহত্ শক্তির মধ্যে বৃহত্ যুদ্ধ শুরু হতে পারে। সিরিয়ার জনগণ এখন বাস্তুচ্যুত, পড়ে রয়েছে কেবল  যুদ্ধ-বিক্ষত পোড়া মাটি। সিরিয়ার এ পতিত ভূমি বৃহত্ শক্তির পরীক্ষায় ব্যবহূত হতে পারে। ভূমধ্যসাগর থেকে উড়ে আসতে পারে ইউরোপের বোমারু বিমান, আটলান্টিক মহাসাগরের বুক চিরে ধেয়ে আসতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের রণতরী, উড়তে পারে আমেরিকার ড্রোন বিমান, কাস্পিয়ান সাগর থেকে সজোরে আঘাত হানতে পারে রাশিয়ার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, ভূমধ্যসাগর থেকে নিক্ষিপ্ত হতে পারে চীনের ক্ষেপণাস্ত্র, ভারত মহাসাগর এবং উত্তমাশা অন্তরীপ পেরিয়ে উড়ে আসতে পারে ভারতের অগ্নি, পারস্য উপসাগর অতিক্রম করতে পারে ইরানের যুদ্ধজাহাজ, ধেয়ে আসতে পারে ইরানি স্কাড মিসাইল, যুক্ত হতে পারে পাকিস্তানি শিহাবের বহ্নিশিখা, অগ্নিঝরা ধ্বংসের সয়লাব বয়ে দিতে পারে ইসরায়েলের রাসায়নিক ও পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ। বৃহত্ শক্তিবর্গের বিন্দুমাত্র ভুলের জন্য বিশ্বকে হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের তর্জন-গর্জনও শুনতে হতে পারে।

লেখক : প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর