সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

জন্মদিনের উৎসব না মৃত্যুর পদধ্বনি

সাইফুর রহমান

জন্মদিনের উৎসব না মৃত্যুর পদধ্বনি

এমনটি সাধারণত সিনেমা কিংবা নাটক-নভেলেই ঘটে থাকে। কিন্তু এরকম একটি ঘটনা সত্যি সত্যি আমার জীবনেও ঘটেছিল। এই তো গত বছর ১২ ডিসেম্বর এবং সেটা আমারই জন্মদিনে। কাঁচা কাদামাটিতে শুকিয়ে যাওয়া পদচিহ্নের মতো সব কিছুর খুঁটিনাটি মনে না থাকলেও আমার স্মৃতিভ্রংশ যে সম্পূর্ণরূপে হয়নি সেটা আমি জোর গলায় বলতে পারি। মনে আছে অনেক কিছুই। সেটা ছিল ১২ ডিসেম্বর ২০১৪। একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলাম উত্তরবঙ্গে। টিকিট কেটে রেখেছিলাম আগে থেকেই। বিকাল নাগাদ পৌঁছে গেলাম কোচস্ট্যান্ডে।  নির্দিষ্ট সময়ে কোচের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে আমার জন্য নির্ধারিত আসনটিতে বসতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, অরুন রঙের জমিনের উপর হাতে কাজ করা কামিজ সেই সঙ্গে চোখের আরাম হয় এরকম শ্বেতশুভ্র রঙের সেলোয়ার পরিহিত একটি মেয়ে বসে আছে আমার পাশের আসনটিতে। পিঠের উপর খোলা চুল। থুতনিতে একটি আঙ্গুল দিয়ে এক মনে বই পড়ছে। বিনা প্রসাধনে, বিনা সাধনায় ওর মুখাবয়টি স্নিগ্ধ ও শান্ত অথচ বুদ্ধিমার্জিত একটি পরিপূর্ণ মেয়ের মুখ। বই আমার কাছে প্রিয় একটি বস্তু। প্রকৃত পক্ষে নিজের জীবনের পরেই আমি বইকে বেশি ভালোবাসতে শিখেছি। সে জন্য শয়তানের হাতেও বই দেখলে তাকে আমার সন্তু বলে মনে হয়। গভীরতম অর্থে তিনি হয়ে উঠেন আমার এক পরম আত্মীয়। কারণ তিনি বই পড়েন। নিঃসন্দেহে এটি আমার দুর্বলতা। কোচের জানালার সার্সি গলে রোদের ঝলমলে আলো এসে পড়ছিল বাসের আসনগুলোতে। সেই আলোয় মেয়েটিকে মনে হলো যেন আলোর মধ্যে বসে আছে আলোর তৈরি আরেক প্রতিমা। আজকালকার প্রমোদ বিলাশ বাসের আসনগুলো আঁটোসাঁটো নয় বরং বলতে হয় বেশ খানিকটা প্রশস্ত ও আরামদায়ক। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে আমি সাধারণত বসতে পারি না। তাতে আমার অস্বস্তি বাড়ে। শরীর থেকে কোটটি খুলে বেশ যত্ন ও ভাঁজ করে রাখলাম দুটো সিটের মাঝখানে। দূর ভ্রমণে পাশে কারও সঙ্গে কথা বলে সময় কাটানো সব সময়ই আমার স্বভাববিরোধী। আমি পেশায় আইনজীবী নেশায় লেখক এরকম যাত্রাপথে মৌনতা অবলম্বন করাই আমি শ্রেয় বলে মনে করি। চুপচাপ বসে চিন্তা করলে প্রায়ই অনেক মৌলিক চিন্তা মাথায় আসে। তাতে লেখালেখিতে সুবিধা হয়। মাঝে মধ্যে আমি ভিড়ের মধ্যেও এক প্রকার নির্জনতা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করি। আমি হতে চাই সেই সময়টুকুর সম্পূর্ণ অধীশ্বর। পৃথিবীর সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘মাদাম বোভারির’ লেখক গুস্তাফ ফ্লবেরের একটি উক্তি পড়ে বেশ আশ্চর‌্যান্বিত হয়েছি। তিনি বলেছেন, মাঝে মাঝে প্রকৃত নির্জনতা না কী খুঁজে পাওয়া যায় জনমানুষের ভিড়ের মধ্যেই। আরেকটি বিষয় হলো ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের মাঝে নিজেকে মনে হয় যেন আমি সেখানে অনাহূত একজন। তাছাড়া আমি কোনো কেতাদুরস্ত সুপুরুষ নই যে, মেয়েরা আমার উপর সব ঝাঁপিয়ে পড়বে। উচ্চতায় আমি হ্রস্ব। বেশির ভাগ মেয়েরই দীর্ঘকায় পুরুষ পছন্দ। চেহারাটি যে সুন্দর, সেটাও যে জোরালোভাবে বলব সে উপায়ও নেই। শেষ বিকালের নিদারুণ জ্যাম ঠেলে বাসটি চলতে শুরু করল মৃগী রোগীর মতো অনেকটা ধুঁকে ধুঁকে। আমি নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলাম বাইরে। ঢাকা পেরুলেই বাংলাদেশের দৃশ্য অন্যরকম। সবুজ পাড়ের উপর নীল দিগন্ত। বাইরে ঝলমলে রোদ। কয়েকটা দাঁড়কাক টেলিফোন কিংবা বৈদ্যুতিক তারে বসে কা কা স্বরে চেঁচাচ্ছে। বাইরের দৃশ্যগুলো আমার এতটাই ভালো লাগছিল যে, কাকদের কা কা ধ্বনিও আমার কাছে মনে হচ্ছিল যেন কোনো কিন্নরীর কণ্ঠের সুললিত সুর। শুধু তাই নয়, কাকগুলোর মুখ গহ্বরের গোলাপি অংশটুকুও মনে হচ্ছিল বেশ দৃষ্টিনন্দিত ও সুন্দর। বাইরে তাকিয়ে দৃশ্য দেখছিলাম বেশ কিছুক্ষণ ধরে। হঠাত্ চোখ গেল পাশে বসা মেয়েটির দিকে। তখনো মেয়েটি বইয়ের মধ্যেই ডুবে আছে। বেশ আশ্চর‌্যান্বিত হলাম তার হাতের বইটি দেখে। বইটি আহমেদ ছফার ‘মরণ বিলাশ’। আহমেদ ছফার বই পড়ছে! নিশ্চয়ই কোনো এলেবেলে পাঠক নন। খুবই সিরিয়াস টাইপ পাঠক। এবার নিজেই আগ বাড়িয়ে কথা বললাম— আপনি বুঝি আহমেদ ছফার সাহিত্যের খুব ভক্ত? এবার বই থেকে মেয়েটি চোখ সরিয়ে আমার দিকে চোখ তুলে বলল, জি হ্যাঁ। কেন বলুন তো? এরপর কথাবার্তা চলতে থাকল অক্লেশে। অনেক বিষয়ে আমি বর্ণচোরা গোছের হলেও বই নিয়ে আলোচনায় আমি অক্লান্ত। ওর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম ওর পড়াশোনার ব্যাপ্তিটিও নেহায়েত মন্দ নয়। শঙ্কু, ফেলুদা, সুনীল, শীর্ষেন্দু প্রায় সব কিছুই যেন ওর পড়া। অনেক লোকের মাঝখানে চোখাচোখি হয়ে কথাবার্তা বলতে গেলে সচরাচর একটি সমস্যা হয়। বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় যেন মুহূর্তেই দুজনের চোখের মাঝখানে তৈরি হয়ে যায় অদৃশ্য একটি সেতু যা দিয়ে যাতায়াত করে অব্যক্ত সব ব্যাকুলতা সেই সঙ্গে হূদয় ঘটিত খেলো ও হালকা যত সব ব্যাপার স্যাপার তো আছেই। কিন্তু আমার মধ্যে আদৌ সেরকম কিছু ঘটল না বরং আমার অন্যান্য গ্রন্থকিট সুহূদ বিশেষ করে গল্পকার মেহেদী উল্লাহ, কবি মাসুদ হাসান, কবি জুননু রাইন, কবি অচিন্ত চয়ন, গল্পকার ও কলামিস্ট আবদুল্লাহ ওমর সাইফ কিংবা আমার অ-লেখক অগ্রজ জ্ঞানতাপস বন্ধু খাজা মাসুদ— এদের সঙ্গে বইবিষয়ক আড্ডা দিয়ে যেরকম আনন্দ পাই ঠিক ওর সঙ্গেও কথা বলে অনুরূপ আনন্দ পাচ্ছিলাম। মেয়েটি বলল দেখুন কি দুর্ভাগ্য আপনার। বন্ধুদের নিয়ে জন্মদিনটি আজ উদ্যাপন করতে পারলেন না। আমি বললাম, আমি জন্মদিন উদ্যাপন করি না। কারণ জন্মদিনের রাশ উৎসবের চেয়ে আমি মৃত্যুদিনের পদধ্বনিই বেশি শুনতে পাই। তাছাড়া ছোটবেলায় যখন জন্মদিন পালন করার জন্য বাবা-মায়ের কাছে জেদ ধরতাম বাবা বলতেন, নিজের জন্মদিন নিজে উদ্যাপন করতে চাও সেটা কি লজ্জার বিষয় নয়। তাছাড়া তুমি জন্মে পৃথিবীকে এমন কি ধন্য করেছ যে তোমার জন্মদিন আমাদের ঘটা করে পালন করতে হবে। তখন ছোট ছিলাম বুঝতে পারিনি। সত্যিই তো, আমি জন্মে পৃথিবীর এমন কি উদ্ধার করেছি কিংবা আমি না জন্মালেই বা পৃথিবীর এমন কি ক্ষতি হতো। আমার বাবা সব সময় বলতেন, জীবনে অনেক বড় হও যেন দেশের মানুষ তোমার জন্মদিন পালন করে। জীবনে কিছুই হতে পারিনি। তারপরও আমি ১২ তারিখ ঢাকায় থাকছি না বলে আমার পাঠক গোষ্ঠীর ক্ষুদ্র একটি অংশ আমার জন্য কেক ও ফুল নিয়ে এসেছিল একদিন আগেই অর্থাত্ ১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়। লজ্জায় অধোবদনে আমাকে গ্রহণ করতে হয়েছিল তাদের ভালোবাসায় জারিত অমূল্য সেই অর্ঘ্য।

 

কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। হঠাত্ চৈতন্য পেলাম কোচের লোকজনের হাঁকডাকে। যমুনা সেতু পেরিয়ে কোচটি আশ্রয় নিয়েছে রাস্তার পাশে কোনো একটি রেস্তোরাঁয়। জলপানের বিরতি। অনেকে এই ফাঁকে প্রাকঃকৃত্যও সেরে নিতে পারেন অনায়াসে। মেয়েটি বলল, বাস থেকে নেমে আসুন চটজলদি। আপনার জন্য একটি সারপ্রাইজ আছে। দোতলায় একটি টেবিল দখল করে সেখানে বসলাম দুজন। মেয়েটি কোথায় যেন চলে গেল দৌড়ে। ফিরে এলো খানিক পরে। হাতে ছোট্ট একটি কেক ও মোমবাতি। তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে বের করল ছোট সুদৃশ্য একটি চাকু। আমি বললাম, বেশ তো! সঙ্গে চাকুটাকুও রাখেন দেখছি। মেয়েটি বলল, মেয়েদের আত্মরক্ষার জন্য অনেক কিছুই রাখতে হয় বৈকি। আমি বললাম, এসব পাগলামো করার মানে কি? কেন আপনার বাবা বলতেন না আপনার জন্মদিন পালন করবে বাংলাদেশের মানুষ। আমি কিন্তু জন্মসূত্রে বাংলাদেশি। কৌতুক ভরা দৃষ্টিতে মেয়েটি বলল— মজা করছি। আসুন কেক কাটুন। তাছাড়া আপনি যখন ঘুমিয়ে ছিলেন আপনার ফ্যান পেইজ খুলে অনেক লেখাই আমি পড়ে ফেলেছি এবং ইতিমধ্যে আমি আপনার একজন গুণমুদ্ধ ভক্তও হয়ে গেছি বলতে পারেন। অনাড়ম্বর, নিরাভরণ, ঐশ্বর্যহীন জনবিরলে কেক কাটার এই পর্বটি আমার জীবনে সম্ভবত অন্যতম একটি সেরা জন্মদিনের উৎসব। সবকিছু সাঙ্গ হলে কোচটিতে গিয়ে বসলাম। বাসটি পুনরায় চলতে শুরু করল। বাইরে সূচীভেদ্য গাঢ় অন্ধকার। পরক্ষণেই মনে হলো কবরের ভিতরেও নিশ্চয়ই অন্ধকার হবে এমনই নিকষ কালো।

পৃথিবীতে সবচেয়ে চূড়ান্ত ও মর্মান্তিক সত্য হচ্ছে মৃত্যু। কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন চিন্তা চেতনে একটিবারও কি আমরা ভাবি যে আমাদের অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে মৃত্যু। মৃত্যু থেকে আমরা যতই মুখ লুকোই না কেন মৃত্যু তো একদিন না একদিন আমাদের গ্রাস করবেই। মানুষের শব্দে আরশোলা যেমন দেয়াল ঘেঁষে উল্টো মুখ করে চুপ করে থাকে, ভাবে ওটাকে বোধহয় কেউ আর দেখছে না। কিংবা কাক তার পাখার নিচে সাবান লুকিয়ে রেখে ভাবে কেউ মনে হয় বুঝতে পারছে না যে ওটার পাখার নিচে সাবানের অস্তিত্ব ঠিক তেমনি আমরাও মৃত্যুকে ভুলে থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টা করি সব সময়। বিশেষ করে দেশের সর্বোচ্চ কর্তা ব্যক্তিদের হাবভাব, কথাবার্তা, চালচলনে মনে হয় যেন তারা অমর, তাদের মৃত্যু নেই। আমাদের দেশে যে যত বেশি ক্ষমতাশীন সে ততটাই মৃত্যু সম্পর্কে উদাসীন। কিন্তু মৃত্যু আমাকে ভাবায়। কথাটি বোধকরি ভুল বললাম। মৃত্যু আমাকে ভাবায় তো বটেই। মৃত্যু চিন্তা আমাকে নিদারুণ পীড়িত করে অহর্নিশ। চারদিকে এত মৃত্যু। গুম, খুন নিরুদ্দেশ। মানুষের জীবন যে এতটা তুচ্ছ ও মূল্যহীন হতে পারে বাংলাদেশে না জন্মালে সেটা বোধকরি বুঝতে পারতাম না। আর ভাগ্যিস পড়াশোনার অজুহাতে প্রাশ্চাত্য দেশগুলোতে কিছুদিন কাটানোর সুযোগ পেয়েছিলাম বলে দেখতে পেয়েছি উন্নত দেশগুলোতে মানুষের জীবন কতটা মূল্যবান। পোকামাকড়ের মতো মানুষ যেমন মরে তেমনি ঈশ্বর আমাদের অসীম এক ক্ষমতা দিয়েছেন মৃত্যুশোক অতি দ্রুত ভুলে যেতে। এ প্রসঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা মনে পড়ে যায়। ১৮৯৯ থেকে ১৯০৭ সাল পর্যন্ত বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর হারিয়েছেন তার বহু আপনজনকে। ১৮৯৯ সালে প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ, ১৯০২ সালে স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, ১৯০৩ সালে মধ্যম কন্যা রেনুকা, ১৯০৫ সালে পিতা দেবেন্দ্রনাথ, ১৯০৭-এ তার অতি প্রিয় কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই সময়েই তিনি লিখেছেন সবচেয়ে বেশি- কথা, কাহিনী, কল্পনা, ক্ষণিকা এই চারটি লেখাই তিনি লিখেছিলেন ১৯০০ সালে। নৈবদ্য ১৯০১, খেয়া ১৯০৬। ঠিক প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটেছিল আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রেও। ১৯৩০ সালের মে মাসে বিদ্রোহী কবি নজরুলের পুত্র বুলবুল বসন্ত রোগে মারা যায়। কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়। জসীমউদ্দীন নজরুলকে খুঁজে পেলেন ডি.এস লাইব্রেরির দোকান ঘরের একটি কোণে। পুত্রশোক ভোলার জন্য নজরুল সেখানে বসে বসে হাসির কবিতা লিখছিলেন এবং কেঁদে কেঁদে নিজের চোখ ফুলিয়ে ফেলছিলেন।

আমরা জানি মৃত্যু আমাদের উপর ছায়া ফেলে কতটা নিঃশব্দে ও কতটা অবলীলায়। বিখ্যাত চীনা কবি লি পো চাঁদের জ্যোত্স্না অসম্ভব পছন্দ করতেন। একটি নদীতে লি পো নৌকায় বসে চাঁদের আলো উপভোগ করছিলেন। ঠিক সে সময় নদীতে শ্বেতপাথরের থালার মতোন চাঁদের প্রতিবিম্ব দেখে তিনি আনন্দে এতটাই আত্মহারা হয়ে উঠলেন যে, মাথা নিচু করে চাঁদের সেই প্রতিবিম্বটিকে চুমু খেতে গিয়ে উল্টে নদীতে ডুবে মারা গেলেন তিনি। কী করুণ মৃত্যু? ১৬৬০ সালে থমাস আর্কিউহার্ট নামে স্কটল্যান্ডের এক লেখক যখন শুনলেন যে, ইংল্যান্ডে গণতন্ত্র হত্যাকারী ও সেই কারণে শিরশ্ছেদে মুণ্ডু হারানো রাজা প্রথম চার্লসের জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজকুমার দ্বিতীয় চার্লস ইংল্যান্ডের রাজা হয়েছেন তখন ঘটনাটিতে আর্কিউহার্ট এতটাই মজা পেলেন যে, হাসতে হাসতে দম আটকে শেষ পর্যন্ত মারাই গেলেন বেচারা লেখক। কবি আর্কিউহার্টের কৌতুক বোধ করার কারণ হচ্ছে রাজকুমার চার্লস ছিলেন একেবারেই হাবাগোবা ও অকর্মণ্য গোছের। তার রাজা হওয়ার খবরটি ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। ১৭৭১ সালে সুইডেনের রাজা এডলফ ফ্রেডরিক খেয়েই মারা গিয়েছিলেন। সেদিনের সান্ধ্যকালীন ভোজনে রাজা উদরস্থ করেছিলেন— চার-পাঁচটি গলদা চিংড়ি, স্যালমন মাছের ডিম যাকে বলে ক্যাভিয়ার। ধূম্র প্রয়োগে সেদ্ধ সুস্বাদু সামুদ্রিক হেরিং মাছের বেশ কয়েক টুকরো, ভোজে ছিল মিষ্টান্ন, চেরি, স্ট্রবেরি জাতীয় কিছু ফলাহার, এক বোতল শ্যামপেইন ও বড় এক পেয়ালা দুধ। সেই জন্য ইস্কুলের ছোট ছেলেমেয়েরা টিপ্পনি কেটে ছড়া কাটে। রাজা ফ্রেডরিককে খেলো কে/খেয়ে খেয়ে নিজেকে খেলো বুদ্ধু রাজা ফ্রেডরিক। প্রসঙ্গক্রমেই আমাদের দেশের একজন লেখকের কথা মনে পড়ে গেল, তিনিও খেয়েই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। পথের পাঁচালীর লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় খেতে পছন্দ করতেন অসম্ভব। তার ভোজনবিলাস সম্পর্কে অনেক মজার মজার গল্প আছে। সময় সুযোগ হলে অন্য কোনো সময় সে সব গল্প করা যাবে। এক বিজয়া সম্মেলনীর উৎসবে খাওয়া-দাওয়ার পর বিভূতিভূষণ হঠাত্ই অসুস্থ হয়ে পড়েন। খেয়েছিলেন নেহায়েত মন্দ নয়। তিন-চার বাটি মুড়ি দিয়ে কাঁকড়ার ঝোল। সঙ্গে নিশ্চয়ই আরও অনেক কিছুই ছিল। বিভূতিভূষণ মারা যান ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর। শ্রদ্ধাবাসরের দিন তার সব সতীর্থ লেখক, সাহিত্যিক জমায়েত হয়েছিলেন তার বাড়ি কলকাতার ঘাটশিলায়।

সবাই যখন বিভূতি বাবুর শ্রদ্ধা নিবেদনে ব্যস্ত, পাশ দিয়ে এক বাউল তার একতারাটি বাজাচ্ছিলেন আর গান গেয়ে যাচ্ছিলেন— ‘সজনী আর কি খাবি। সজনী আর কি খাবি’ বাউলের গান শুনে সবাই তো একেবারেই স্তব্ধ। যা হোক মৃত্যুর কথা শুনিয়ে শুনিয়ে পরিবেশ বেশ ভারি করে ফেললাম বোধহয়। তবে রবীন্দ্রনাথের মতে জীবনের শেষ পরিপূর্ণতা হচ্ছে মৃত্যু। তবে সব মৃত্যু নয়। অকাল মৃত্যুকে তিনি কখনোই জীবনের শেষ পরিপূর্ণতা মনে করেন না। রবীন্দ্রনাথের এই মৃত্যুবোধ নিশ্চয়ই বহু মানুষকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে, উজ্জীবিতও করেছে নিশ্চয়ই। নানা অপ্রাপ্তির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের এই মৃত্যু সম্পর্কীয় দর্শনটির মাধ্যমে জীবনের ওপর নতুন কোনো আলো পড়ে। সেই আলো জীবনকে নতুন করে দেখতে শেখায় ও আমাদের বাঁচতে শেখায়।

লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী।

ই-মেইল :  [email protected]

সর্বশেষ খবর