বৃহস্পতিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
রাজনীতি

বাংলাদেশে এখন বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট

সুভাষ সিংহ রায়

বাংলাদেশে এখন বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট

বাংলাদেশে এখন বিশ্বাসযোগ্যতার ভয়াবহ সংকট চলছে। এবং এই সংকট একদিনে তৈরি হয়নি। কারণ অতীতের ঘটনাবলি বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট তৈরি করেছে। বাংলাদেশে দুটি বৃহত্ রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই; শত্রুতা আছে। এক দল আরেক দলকে একেবারেই বিশ্বাস করে না। নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভিত্তি শক্ত হওয়ার কথা। অথচ আমাদের দেশে ঠিক তার উল্টো। একেকটা নির্বাচন আসে আর নতুন নতুন উপসর্গ  যোগ হয়। আমরা এখনো একটা শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন পাইনি। আমাদের পাশের রাষ্ট্র ভারতের প্রখ্যাত নির্বাচন কমিশনার টিএন সেশনও খুব কম কথা বলতেন। অথচ এই ভদ্রলোক ভারতের সব রাজনীতিবিদকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন একটি নির্বাচন কমিশন কত শক্তিশালী ও কার্যকরী হতে পারে। আমরা কথায় কথায় আমলাতন্ত্রকে গালাগালি করি; অনেক ক্ষেত্রে যৌক্তিক কারণও আছে। কিন্তু ভারতের একজন আমলা সেই দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ভীষণভাবে শক্তিশালী করে গেছেন। আমাদের দেশে দীর্ঘকাল ধরে নির্বাচন কমিশন সবসময়ই যেন একটা বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট তৈরি করে রেখেছিল। বিচারপতি রউফ, বিচারপতি সাদেক, বিচারপতি সাঈদ, বিচারপতি আজিজ, বিচারপতি মাহফুজ পালাক্রমে দেখিয়েছেন কীভাবে কমসময়ের মধ্যে জনগণের বিশ্বাসযোগ্যতা হারানো যায়। বিচারপতি মাহফুজ সাহেবের ভিডিও ক্লিপগুলো কমপাইল করলে একটি বড় ধরনের হাসির নাটক তৈরি হতে পারে। বরং যিনি বিচারপতি ছিলেন না তিনি এতটা সংকট তৈরি করেননি। আবুহেনা সাহেব এত কথা বলতেন না অবশ্য তিনি চাইলেও বেশি কথা বলতে পারতেন না। তখন এক বিটিভি ছাড়া কোনো চ্যানেল ছিল না। এখন সব জায়গায় শুধু কথা আর কথা। চ্যানেলে কথা, মোবাইলে অনবরত কথা, দিনভর কথা, এমনকি রাতভর কথা। আমাদের দেশে বেসরকারি টিভি চ্যানেলে টকশোগুলো অনেকসময় মধ্যরাত অবধি হয়। আমরা প্রতিদিন টকশোতে যা বলছি— তত্ত্বের দিক দিয়ে কতটুকু যথার্থ। আংশিক সত্য, বিকৃত সত্যের ছড়াছড়ি। হয়তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভালো করার সুযোগও থাকছে না। এই পারা, না পারা মাঝখানে থাকলে অনেক সময় বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট তৈরি হতে পারে। দেশে নীতিহীনতার রাজনীতি প্রাধান্য পেলে সব ক্ষেত্রে আস্থার সংকট দেখা দেয়। ধারণা করা যায় আমাদের দেশ এতটাই পাপে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল যে একটা ১১ জানুয়ারি অবশ্যম্ভাবী ছিল।

দেশের মানুষের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে রাজনীতিবিদদের ভাবতে হয়। জনগণের মতামত সবার উপরে। দেশের মানুষ সব সময় কি ভালো-মন্দের বিচার সঠিকভাবে করতে পারে? এ প্রশ্ন থেকেই যায়। এখানে রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব জনগণকে আস্থায় নিয়ে সঠিকটাকে চিনিয়ে দেওয়া। আবার সবকিছু সংখ্যাতত্ত্বে বিচার করা যায় না। পৃথিবীর অনেক বৃহত্ কাজ সংখ্যাধিক্য মানুষ প্রথম দিকে মেনে নেয় না। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন বিধবা বিবাহ প্রচলন করতে যান তখন খুব বেশি মানুষ তার পক্ষে ছিল না। ব্রিটিশ সরকারের কাছে মাত্র ৯৮৭ জন মানুষ বিদ্যাসাগরের সেই উদ্যোগের পক্ষে আবেদনে স্বাক্ষর করেছিলেন। আর বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে প্রায় ৩৪ হাজার মানুষ ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন। অনেক পরে প্রমাণিত হয়েছে বিদ্যাসাগর সঠিক ছিলেন। ২০১৪ সালে শেখ হাসিনা জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করা জাতির জন্য খুব জরুরি ছিল। আমরা জানি, হিটলার সরকার ক্ষমতায় এসেছিল চধঁষ ঠড়হ ঐরহফবহনঁত্ম সরকারের ব্যর্থতার কারণে। জার্মানিসহ সারা পৃথিবীতে ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে এসেছিল। বলতে গেলে শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচন করে জাতিকে মহাদুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। নির্বাচন পরবর্তীতে সরকার জনগণের সামনে দুষ্টের দমন-শিষ্টের পালন দৃশ্যমান করতে পারলে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা অনেক অনেক বেশি লক্ষ্য করা যেত। কিন্তু নির্বাচন পরবর্তীতে পরিস্থিতির উন্নতি হবে সাধারণ মানুষ আশা করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে জাতীয় রাজনীতিতে বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট আরও প্রকট হয়েছে সংবাদ মাধ্যম খুবই স্পর্শকাতর মাধ্যম, এক্ষেত্রে এই মাধ্যমের কর্তৃপক্ষের আরও যত্নবান ও দায়িত্বশীল হতে হয়। অনেক সময় দেখা গেছে সংবাদ মাধ্যমও বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট তৈরি করে থাকে, সন্দেহ প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। এমনিতেই সন্দেহপ্রবণতা রোগ বাঙালি অস্থিমজ্জায় যেন মিশে আছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কাছে সব প্রশ্নের উত্তর থাকে। ‘মানুষ একমাত্র জীব যে আপনার সহজ বোধকেই সন্দেহ করেছে, প্রতিবাদ করেছে, হার মানাতে পারলেই খুশি হয়েছে।’ সবাই স্বীকার করবেন আওয়ামী লীগের কাছ থেকে মানুষ আশা করে ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন’। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে ‘যদি রাজা নিরলসভাবে দণ্ডনীয়ের প্রতি দণ্ডপ্রয়োগ না করেন, তাহলে অপেক্ষাকৃত অধিক বলশালী ব্যক্তিগণ দুর্বল লোকদের শূলে মত্স্যপাকের ন্যায় কষ্ট দিতে পারে।’ (জলে যেমন বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে তেমনই প্রবল দুর্বলকে নষ্ট করে। একে বলে মাত্স্যন্যায়)। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মানুষের অভিযোগ— অনেক উন্নয়ন; অনেক অগ্রগতি— সে তুলনায় সুশাসন নেই। 

আমাদের সমাজের ভালো অংশ আওয়ামী লীগের সফলতার দিকে তাকিয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলা দরকার এই জাতির ভালো অংশ খুবই নিষ্প্র্রভ, এরা দূর থেকে দেখতে ভালো বাসে। প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে এদের নানান সংশয়। এ কারণে শত শত বছর এ জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খলে বাঁধা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলতেন— ‘আশা ছেড়ে তবু আশা রেখে দাও’। আমাদের হতাশ হবার কারণ আছে। কিন্তু এটা মেনে নিলেও; আমরা যখন দেখি, আধিপত্যের নানান আয়ুধ- সুযোগবঞ্চনা ও তাকে যৌক্তিক করে তোলার জন্য নানান অযুক্তির সমাহার— এগুলোর বিরুদ্ধে সমাজের অন্তরে বয়ে চলেছে একটা গণযুক্তির ধারা, তখন আশাবান না হয়ে পারা যায় না। বঞ্চনা, অবমাননা, অস্বাধীনতার মধ্যেও সমাজের ভিতর থেকে উঠে আসে একটা তার্কিক কণ্ঠস্বর— জীবনের একটা জীবন্ত ব্যাখ্যা, যাকে বলছি লোক প্রজ্ঞা ।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর