শনিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

আমার ভাই শহীদ জিয়া

আহমেদ কামাল

আমার ভাই শহীদ জিয়া

প্রিয় দেশবাসী! আস্সালামু আলাইকুম। আজ কিছু কথা বলার জন্য আমার এই লেখা। আপনারা হয়তো জানেন আমি গত ৪ নভেম্বর আমার মরহুম পিতা-মাতা, আমার ভাই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, আমার আরও তিন ভাই এবং ভাতিজা কোকোসহ সবার রুহের মাগফিরাত কামনায় এক মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছিলাম। আমি বলেছিলাম এটা আমাদের একান্ত পারিবারিক অনুষ্ঠান।  মরহুম পিতা-মাতা, শহীদ জিয়া, মৃত পরিবারবর্গের মিলাদ মাহফিল। এই মিলাদের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক সম্পর্ক নেই বা ছিল না। যদি রাজনীতি করি আপনাদের জানিয়ে আসব। যেহেতু শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আমার ভাই এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন, তাই আমি বিএনপির চেয়ারপারসন, ঊর্ধ্বতন সব নেতা-কর্মী, সুশীল সমাজ ও বিশিষ্টজনদের দাওয়াত করেছিলাম এবং নিজে ব্যক্তিগতভাবে ফোনের মাধ্যমে মিলাদ মাহফিলে আসার জন্য অনুরোধ করি। অনেকের ফোন নম্বর বা ঠিকানা না পাওয়ায় কার্ড পৌঁছাতে পারিনি। মিলাদে কারও আসা, না আসা এটা তাদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারি, আমার এই পারিবারিক মিলাদ মাহফিলকে নিয়ে একটা বিশেষ মহল ও কিছু ব্যক্তি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং মিলাদ মাহফিলে না আসার জন্য বিভিন্নভাবে প্রপাগান্ডা ছড়ায়, যা আমাকে প্রচণ্ডভাবে ব্যথিত করেছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তথা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং তার মৃত পরিবারবর্গকে এর মাধ্যমে অপমানিত করা হয়েছে বলে আমি মনে করছি।

তাই আজ আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি আমিও স্বাধীন বাংলাদেশের একজন নাগরিক, দেশকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করার অধিকার আমারও আছে। তাছাড়া শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আমার বড় ভাই। তার রক্ত আমার রক্ত এক। তাই আজ বিএনপির বর্তমান নাজুক অবস্থা দেখে কিছু কথা না বলে পারছি না। মাঝে মাঝে দুঃখ হয়, যখন দেখি আমার ভাই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নীতি আদর্শের সঙ্গে বিএনপির অনেক কর্মকাণ্ডের এখন মিল নেই। স্বার্থান্বেষী মহল ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দালাল চক্রের ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছে বিএনপি। তারা বিএনপি নেতৃত্ব এবং বিএনপি চেয়ারপারসনকে ভুল পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করছে।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মূল আদর্শ-নীতি থেকে বিএনপি আজ অনেকটা দূরে সরে গেছে। যে ভুলের কারণে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শে বিশ্বাসী বিএনপির সর্ব পর্যায়ের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মাশুল দিতে হচ্ছে। মাথায় শত শত মিথ্যা মামলা নিয়ে তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, গ্রেফতার, হত্যা, গুম হওয়ার ভয়ে বাসাবাড়িতেও ঘুমাতে পারছেন না। তারা যাযাবর জীবনযাপন করছেন।

তাই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৪ বছর পর এসে কিছু কথা না বলে পারছি না। দেশ আজ এক চরম ক্রান্তির পথে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশে গণতন্ত্র বলে কিছু আছে তা আজ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত এবং প্রায় তিন লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। যারা মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছিলেন তাদের আত্মা জানতে চায় কোথায় সেই স্বাধীন বাংলাদেশ? যার জন্য আমরা জীবন দিয়েছিলাম? কোথায় আমার দেশের মানুষের গণতন্ত্র? কোথায় শান্তিকামী মানুষের নিরাপত্তা? তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভুলে গেলে চলবে না। এটাকে সামনে রেখে জাতিকে এগিয়ে আসতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ত্যাগের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধী দালালদের দ্বারা অনেক মা-বোন ইজ্জত হারিয়েছেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা, নিরীহ মানুষ ও বুদ্ধিজীবীকে তারা হত্যা করেছে। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বাংলাদেশের জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত দিয়ে গেছেন। স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেও কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্রে শহীদ হয়েছেন। তিনি এদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেছিলেন।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার গণতন্ত্রের কথা মুখে বলে কিন্তু গণতন্ত্রের লেশমাত্র দেশে কোথাও নেই। দেশে সাধারণ মানুষের স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার নেই। সাধারণ মানুষের গণতন্ত্র, বাক-স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করা, এমনকি গণতন্ত্রের ভাষায় কথা বলার অধিকারও কেড়ে নিয়েছে এই সরকার। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগের ক্যাডার বাহিনী দিয়ে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার পাঁয়তারা করছে।

তারা সংবিধানের দোহাই দিয়ে ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচন দিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। সর্বস্তরে দুর্নীতি-অনিয়ম করে দেশকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। অপরদিকে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের মিথ্যা মামলা, হামলা, গুম ও হত্যার ভয় দেখিয়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চাচ্ছে। কিন্তু এটাও সত্য যে, অবৈধভাবে ক্ষমতা করায়ত্তকারী কোনো সরকার হামলা-মামলা দিয়ে সাধারণ মানুষ ও গণতন্ত্রকে অতীতে রুখতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। একদিন না একদিন এদেশের জনগণ রুখে দাঁড়াবে। অতীত ইতিহাস থেকে এই সরকারের শিক্ষা নেওয়া উচিত। সম্প্রতি মিয়ানমারের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। সেখানে সামরিক জান্তাও পরাজিত হয়েছে।

সরকারের জেনে রাখা উচিত, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শের বিএনপিকে কেউ নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না। কারণ শহীদ জিয়ার আদর্শ ১৬ কোটি মানুষের হূদয়ে গাঁথা আছে এবং থাকবে। আমি তার একমাত্র জীবিত ভাই হিসেবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের আদর্শের বিএনপিতে আছি এবং থাকব। দলকে সুসংগঠিত করে দেশে স্বচ্ছ গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য সবাইকে দেশের এই দুর্দিনে একসঙ্গে এগিয়ে আসার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। আজ সমগ্র দেশবাসীর চিন্তা করার সময় এসেছে। জেগে ওঠার সময় এসেছে। প্রতিবাদ করার সময় এসেছে। ৪৪ বছর পর আজও এদেশের মানুষ প্রত্যক্ষভাবে ভোটদানের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারছেন না।

তার প্রমাণ ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন। ক্ষমতাসীনরা অটোভোটে সরকার গঠন করেছেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে ভোট কারচুপি, সন্ত্রাসের মাধ্যমে ভোট কেন্দ্র দখল, জালভোট প্রদান, যা সমগ্র দেশবাসী ও বিশ্ববাসী স্বচক্ষে দেখেছেন। পৌরসভা নির্বাচনও তার ব্যতিক্রম নয়। এসব যদি দীর্ঘায়িত হয় তা কখনো দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। এ অবস্থার পরিবর্তনে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। নতুন প্রজন্ম থেকে শুরু করে শহীদ জিয়ার আদর্শে বিএনপির সব নেতা-কর্মীকে এগিয়ে আসতে হবে। আপামর মেহনতী মানুষ, কৃষক শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজকে সঙ্গে নিয়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মূল আদর্শ নীতিকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে আনতে হবে। দেশের এই নাজুক পরিস্থিতিতে দেশের মঙ্গলের জন্য সুষুম ভোটের মাধ্যমে, গণতন্ত্র  প্রতিষ্ঠা ও দেশের মানুষের সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রপ্রেমী। তারা যেমন স্বৈরশাসন চায় না তেমন ধ্বংসাত্মক ও হিংসাত্মক রাজনীতিতেও বিশ্বাসী নয়। নতুন প্রজন্মসহ দেশের সর্বস্তরের জনগণ ও নিরীহ মানুষ এমন এক স্বাধীন গণতন্ত্রের দেশ দেখতে চায়, সেখানে যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন তাদের জনগণের রায় নিয়েই তা করতে হবে। নিরপেক্ষ ও সুষুম নির্বাচনের মাধ্যমে সুশাসনের জন্য একটি কল্যাণমুখী সরকার গঠন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে যেসব সংস্কার প্রয়োজন তা সব দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার এবং সব দলকে গঠনমূলক আলোচনার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।

হিংসাত্মক রাজনীতি, ভোট কারচুপি, প্রশাসন দলীয়করণের অপখেলা বন্ধ করতে হবে। বিচার বিভাগকে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দিতে হবে। সর্বোপরি নির্বাচন কমিশনকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রদানের মাধ্যমে সুষুমভাবে নির্বাচন করার অধিকার দিতে হবে। দেশে আইনের শাসন কায়েম করতে হবে। বিদ্যমান সংকটের সমাধান এবং স্বচ্ছতা প্রমাণ করা এখন সরকারেরই দায়িত্ব।  জনগণের জন্য দেশ, আবার দেশের জন্য জনগণ। দেশের আপামর ১৬ কোটি মানুষের সুখ-দুঃখের কথা চিন্তা করে, প্রয়োজনে দেশের উন্নয়নের স্বার্থে সংবিধান সংশোধন করেও দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং গণতন্ত্র চর্চার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এ জন্য সরকার এবং সব দলকে গঠনমূলক সংলাপের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। সে ক্ষেত্রে দেশের জনগণকেও ভূমিকা রাখতে হবে।

প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ অন্য দেশগুলোর গণতান্ত্রিক চর্চার উদাহরণ বাংলাদেশের সব দলের নেতা-কর্মীদের শুভবুদ্ধি উদয়ে ভূমিকা রাখতে পারে।  সত্যিকার গণতন্ত্রের মাধ্যমে সরকার ও বিরোধী দল উভয়ের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন সোনার বাংলা হিসেবে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের একটি মডেল হিসেবে গড়ে উঠুক এটাই আমাদের সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা।

লেখক : প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ছোট ভাই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর