শনিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

পৌর নির্বাচন থেকে কেউ কি কিছু শিক্ষা নেবে?

বিভুরঞ্জন সরকার

পৌর নির্বাচন থেকে কেউ কি কিছু শিক্ষা নেবে?

পৌরসভা নির্বাচন এবারই প্রথম রাজনৈতিকভাবে অনুষ্ঠিত হলো। ২৩৪টি পৌরসভায় অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে ২১৪টি পৌরসভার ফলাফল প্রকাশ পেয়েছে যার ১৬৮টিতে আওয়ামী লীগ, ১৯টিতে বিএনপি ও ১টিতে জাতীয় পার্টি জয়ী হয়েছে। মেয়র পদে প্রার্থীরা দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করেছেন। ফলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও পৌর নির্বাচন ভিন্ন রাজনৈতিক মাত্রা লাভ করেছিল।  বিশেষ করে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় নির্বাচন নিয়ে সব মহলেই তৈরি হয়েছিল বাড়তি আগ্রহ ও কৌতূহল। অংশগ্রহণমূলক হওয়ায় এই নির্বাচনটি যে যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, সেটা শুরু থেকেই বোঝা গিয়েছিল। তবে নির্বাচনটি শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু হবে না বলে যে ধরনের আশঙ্কা প্রচার করা হচ্ছিল বাস্তবে তেমনটি হয়নি। পৌর নির্বাচনকে কেউ কেউ ‘নজিরবিহীন সন্ত্রাস-সহিংসতার নির্বাচন’ বললেও এরচেয়ে বেশি সহিংসতার নির্বাচনের নজির আমাদের দেশে আছে। তিন হাজার ৫৫৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে প্রায় ২০০ কেন্দ্রে নানা ধরনের অনিয়ম, গোলযোগ হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাকি সব কেন্দ্রেই শান্তিপূর্ণভাবে ভোট সম্পন্ন হয়েছে। জালভোট প্রদান, কেন্দ্র দখলের ঘটনা সব নির্বাচনেই কিছু না কিছু থাকে। এবারও ছিল। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম, কারচুপির অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। বিএনপি প্রার্থীদের বিজয় ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ তুলে বিএনপি নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে।

পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রদত্ত ভোটের ৫২ ভাগ এবং বিএনপি ২৮ ভাগ ভোট পেয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবার রাজনৈতিকভাবে এবং দলীয় প্রতীকে হওয়ায় স্বভাবতই নৌকা এবং ধানের শীষের মধ্যে লড়াই হবে বলে গণমাধ্যমে আগাম যে খবর প্রকাশিত হয়েছিল, বাস্তবে হয়েছেও তাই। তবে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোট কারও কারও কাছে ‘অতিরিক্ত’ বা অস্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নৌকা প্রতীক নিয়ে বেশিসংখ্যক পৌরসভায় জিতবেন এবং ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিএনপি প্রার্থীরা দ্বিতীয় স্থানে থাকবেন, এটা নিয়ে কারও মনে খুব বেশি সংশয় ছিল না। কিন্তু মেয়র পদে বিএনপি প্রার্থীরা এত কমসংখ্যক পৌরসভায় জিতবেন, এটা ছিল অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত। ভোট জালিয়াতি কিংবা কারচুপি করে অথবা ভোটারদের ভয়ভীতি দেখিয়ে কিংবা প্রশাসনকে ব্যবহার করে বিএনপিকে হারিয়ে দিয়ে তাদের বিজয় আওয়ামী লীগ ঘরে তুলেছে বলে এখন বিএনপি অভিযোগ করলেও মানুষের কাছে তা খুব বেশি বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে বলে মনে হয় না। বিএনপি দুর্বল অবস্থানে থেকেই নির্বাচন করেছে। তারপরও তারা যে ভোট পেয়েছে, ভোটের রাজনীতিতে তারাই যে এখনো অধিক প্রাসঙ্গিক সেটা ভালোভাবেই প্রমাণ হয়েছে। অনিয়ম-কারচুপি কিছু হলেও সেটা যে ভোটের সামগ্রিক ফলাফলকে প্রভাবিত করার মতো হয়নি— এটা নির্বাচন পর্যবেক্ষক এবং বিশ্লেষকরাও বলছেন।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বড় সমস্যা হলো তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে শুধু জয়লাভের জন্য। নিজেরা জিতলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়। আর হারলেই অনিয়ম-কারচুপি, ফলাফল প্রত্যাখ্যান। অথচ নির্বাচনে হার-জিত হলো স্বাভাবিক ঘটনা। নির্বাচনে অনেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, কিন্তু জয়লাভ করেন একজন। অন্যদের পরাজয় মেনে নিয়ে বিজয়ীকে অভিনন্দন জানাতে হয়। আমাদের দেশে যে কোনো নির্বাচনে অনিয়ম ও সহিংসতার বড় কারণ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের জয়লাভের মরিয়া চেষ্টা। কেবল সরকার সমর্থক প্রার্থীদের পক্ষ থেকেই জোরজবরদস্তি করা হয়, তা কিন্তু নয়। যেখানে যে প্রার্থীর ‘শক্তি’ বেশি সেখানে সে প্রার্থীর পক্ষ থেকেই ‘বল’ প্রয়োগের ঘটনা ঘটে। এবার পৌর নির্বাচনে অনেক জায়গায় ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীরাও শক্তি দেখাতে গিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত ও সংঘাতময় করে তুলেছেন।

ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ এনে বিএনপি পৌর নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করলেও এ নিয়ে বড় ধরনের কোনো আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়নি। এটা ভালো লক্ষণ। স্থানীয়ভাবেও কোনো পরাজিত প্রার্থী হরতাল বা অন্য ধরনের কোনো কর্মসূচি দেয়নি। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে আগে-পরে যে ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটে এবার তার পরিমাণও কম।

পৌরসভা নির্বাচনেও এটা প্রমাণ হয়েছে যে, দেশের অসংখ্য রাজনৈতিক দল থাকলেও ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়া আর কোনো দলের জায়গা নেই। এমনকি জাতীয় পার্টির অবস্থানও প্রান্তিকে চলে এসেছে। জামায়াত স্বতন্ত্রভাবে অংশ নিয়ে দুটি পৌরসভায় জয় পেয়েছে, আর দলীয় লাঙ্গল প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও জাতীয় পার্টি জিতেছে মাত্র একটি পৌরসভায়। আবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ওপর দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত বলে যেসব রাজনৈতিক দল প্রচার করে এবং দেশের মানুষ বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি চায় বলে দাবি করে, সেসব দলই উল্টো ভোটারদের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ভোটাররা আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ছাড়া আর কোনো দিকেই ঝুঁকছে না। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির ওপরই যেহেতু দেশের মানুষের আস্থা-ভরসা বেশি, সেহেতু এই দুই দলেরই উচিত পৌর নির্বাচনের ফলাফল ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনায় নিয়ে ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করা।

পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আশাতীত ভালো করেছে। কিন্তু এতে যদি দলের নীতিনির্ধারকরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন তাহলে ভুল করবেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে জিতলেও দলের সাংগঠনিক অবস্থার বেহাল চিত্রও অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। অনেক চেষ্টা করে, অনুরোধ-উপরোধ কিংবা প্রশাসনিক চাপ দিয়েও সব ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে বিরত করা যায়নি। বরং ১৭ জন বিদ্রোহী প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। দলের জন্য এটা অবশ্যই সতর্ক সংকেত। এখনই প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন না আনলে, তৃণমূলের মনোভাব বুঝতে না পারলে, প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা যাচাই করার পদ্ধতি ঠিক না করলে ভবিষ্যতে এটা বড় বিপর্যয়ের কারণ হবে। আওয়ামী লীগকে মনে রাখতে হবে যে, কেবল ব্যাপক উন্নয়নের ঢোল বাজিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করা যায় না। নির্বাচনে জেতার জন্য আরও অনেক উপাদান-উপকরণ লাগে। মানুষের ভালোবাসা, আস্থা পেতে হয়। সরকারে থাকলে স্বাভাবিকভাবেই সবাইকে সমান খুশি করা যায় না। জনপ্রিয়তা ধরে রাখা যায় না। আবার জনপ্রিয়তায় টান পড়লে ভোটে জেতা যায় না। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী, মন্ত্রী-এমপি সম্পর্কে মাঠ পর্যায়ে সমালোচনা আছে। অনেকের ‘ঔদ্ধত্য’ আচরণে মানুষ ক্ষুব্ধ। দুর্নীতি স্বজনপ্রীতির অভিযোগও একেবারে কম নেই। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি চলছে। কান পাতলেই সেসব শোনা যায়। চোখ মেললে অনেক কিছু দেখাও যায়। কিন্তু চোখ-কান বন্ধ রেখে যদি সবার প্রতি এক ধরনের বিশ্বস্ততা দেখানো হয়, ‘দুষ্টদের ক্রমাগত প্রশ্রয় দেওয়া হয়’ খারাপ-ভালোর পার্থক্য করা না হয় তাহলে মানুষ তা ভালোভাবে গ্রহণ করে না।

পৌর নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিতে হবে বিএনপিকেও। মানুষ ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলেই বিএনপিকেই ভোট দেবে— এমন অন্ধ বিশ্বাস থেকে দলটিকে সরে আসতে হবে। বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি যত দুর্বলই হোক তাদের একটি স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থক গোষ্ঠী আছে। তারা আওয়ামী লীগবিরোধী এবং বিএনপির প্রতি অন্ধ দরদী। যাই হোক না কেন, এরা বিএনপিকেই ভোট দেবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কেবল এই অন্ধ সমর্থকদের ভোটেই কোনো নির্বাচনে জয়লাভ করা যায় না। যারা কোনো দল সমর্থক নন অথচ খোঁজখবর নিয়ে ভোট দেন, অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভোট দেন, ভালো-মন্দ বিচার করে ভোট দেন, তাদের ভোট পেতে হলে বিএনপিকে তার রাজনৈতিক নীতি-কৌশল বদলাতে হবে। এটা ধরে নিয়ে বসে থাকলে চলবে না যে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যেখান থেকে নির্বাচন করেন, সেখান থেকেই জেতেন— কাজেই তার জনপ্রিয়তা সর্বব্যাপী এবং সর্বপ্লাবী। তার জনপ্রিয়তা কিংবা প্রভাবেও কিন্তু ধস নেমেছে। এটা এখন আর সত্য নয় যে, তিনি যা বলবেন, দেশের সব মানুষ তা-ই অভ্রান্ত বলে মেনে নেবে। এই মহাজন বাক্য ভুলে গেলে চলবে না যে, কিছু মানুষকে কখনো কখনো বিভ্রান্ত করা যায়, বোকা বানানো যায়; কিন্তু সব মানুষকে সব সময় যায় না। বেগম জিয়ার ডাকে সাধারণ মানুষ, এমনকি তার দলের নেতা-কর্মীরাও আর আগের মতো সাড়া দেন না। হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচির সময় বেগম জিয়া ঢাকাবাসীকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ঢাকাবাসী, এমনকি তার দলের কর্মী-সমর্থকরাও তাতে সাড়া দেয়নি।

বেগম জিয়াসহ বিএনপির নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে যে, দেশের মানুষ এখন রাজনৈতিক বিভেদ-হানাহানির চেয়ে বেশি চায় শান্তি, স্থিতিশীলতা। রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে সহিংসতা মানুষ চায় না। বিএনপিকে বুঝতে হবে, কোনো ধরনের হঠকারিতাই তাদের কোনো সুফল দেবে না। অধৈর্য ও অসহিষ্ণু মনোভাব পরিহার করে তাদের ধৈর্য ধরা, অপেক্ষা করার শিক্ষা নিতে হবে। মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির কাছ থেকে রাজনৈতিক কৌশল শিখতে হবে। নির্বাচনে জিতেও ক্ষমতা দখলের জন্য কোনো মরিয়া চেষ্টা না করে বছরের পর বছর অপেক্ষা করার সুফল এবার তিনি পাচ্ছেন। একটি নির্বাচিত সরকারকে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই ক্ষমতা থেকে ফেলে দেওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে যে সন্ত্রাস-সহিংসতা বিএনপি চালিয়েছে তা মানুষের কাছে সমর্থনযোগ্য হয়নি। বিএনপি ক্ষমতায় আসলে জামায়াতও আসবে, আর এই দুই শক্তি একযোগে ক্ষমতায় থাকলে পরিস্থিতি কি হয়, সেটা দেখার সুযোগ দেশের মানুষের হয়েছে।  একদিকে দাবি করা হবে বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হবে, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে কটাক্ষ করা হবে— এই দ্বিমুখী নীতি মানুষ পছন্দ করে না। আওয়ামী লীগের, বর্তমান সরকারের ভুলভ্রান্তি নিয়ে কথা বলা যেতেই পারে, তাই বলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকে অস্বীকার বা খাটো করলে মানুষ যে তার গালে উল্টো চপেটাঘাত করতে ছাড়ে না— পৌর নির্বাচনের ফলাফলকে তার একটি প্রমাণ বলে ধরে নিলেই ভালো করবে বিএনপি।

 ♦ লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর