শনিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ইসলামের নির্দেশনা

অধ্যক্ষ আল্লামা আলহাজ মুহাম্মদ জালাল উদ্দীন আল কাদেরী

ইসলাম একমাত্র মনোনীত দীন ও জীবন ব্যবস্থা। ইসলামের আদর্শ শাশ্বত ও সর্বজনীন। মুসলমান আর অমুসলমানের মধ্যে এখানে কোনো বিভাজন নেই। পরমতসহিষ্ণুতা ও সাম্প্রায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ইসলামের ভূমিকা ও নির্দেশনা কালজয়ী আদর্শ হিসেবে বিশ্ব সভ্যতায় একটি স্বীকৃত বিষয়। ইসলামে অপরের কল্যাণ সাধন উপযোগিতা একটি জাতি ও আদর্শের টিকে থাকার মূলমন্ত্র। অস্তিত্বের এই শাশ্বত দর্শনের উল্লেখ করে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে— ‘আর যা মানুষের জন্য কল্যাণকর যা মানুষকে উপকৃত করে তা টিকে থাকে পৃথিবীতে। (সূরা রাদ : ১৩:১৭)।

অপরের কল্যাণ সাধন তথা পরমতসহিষ্ণুতার পরিধি ইসলামে কত ব্যাপক ও বিস্তৃত এর কিঞ্চিৎ ধারণা আমরা প্রিয় নবী (সা.)-এর একটা বাণী থেকে পেতে পারি। তিনি বলেন— ‘দয়াময়দের ওপর দয়া করেন দয়াময়। যারা দয়াপরবশ হয়, রাহমানুর রাহিম আল্লাহতায়ালা দয়া করেন তাদের। পৃথিবীবাসীর ওপর তোমরা দয়াপরবশ হও, আকাশে যিনি আছেন তিনি তোমাদের ওপর দয়াপরবশ হবেন।’ (আবু দাউদ)।

মহান আল্লাহতায়ালা মানুষে মানুষে কোনো বিভেদ করেননি। সুতরাং মানুষের প্রতি দয়াদ্রতার মনোভাব সৃষ্টি না হলে পরমতসহিষ্ণুতা ও সামাজিক সম্প্রীতি কখনো সম্ভব নয়। একজন মুমিনের কাছে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ,  প্রতিটি বস্তুই বড় আপন এবং বড় আদরের। কারণ সে জানে ও বিশ্বাস করে— ‘সব সৃষ্ট বস্তুই হলো আল্লাহতায়ালার পরিবার-পরিজন।’ ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তার নিজের পরিচয় তুলে ধরেছেন— ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ হিসেবে। সারা বিশ্বের যেখানে যত কিছু আছে সবার জন্যই তিনি রহমত। অপরিমেয় করুণা এবং পরমতসহিষ্ণুতার আঁকর ছিলেন তিনি। ইরশাদ হয়েছে : ‘আমিতো হে রসুল সারা জাহানের (দ্যুলোক ভূলোক, জলে স্থলে অন্তরীক্ষে যা কিছু আছে সবার) জন্য রহমতস্বরূপ, করুণাস্বরূপ প্রেরিত হয়েছি।’ (সুরা আম্বিয়া-২১:১০৭)।

পরমতসহিষ্ণুতার এক অনন্য প্রতীক ছিলেন তিনি। যেসব অমুসলিম কাফের সদা তাকে অত্যাচার করেছে, নিপীড়ন চালিয়েছে, দন্ত মোবারক ভেঙে দিয়েছে, হাড্ডি গুঁড়া গুঁড়া করে দিয়েছে, ক্ষেপা কুকুর ও পাগলদের লেলিয়ে দিয়েছে, স্ত্রী-সন্তানদের তুহমতের নিশানা বানিয়েছে, পথে কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছে, এমনকি সিজদারত অবস্থায় মৃত পশুর নাড়িভুঁড়ি মাথায় ফেলেছে, সেই নির্মম ও পাষণ্ডদের প্রতিও অপার সহিষ্ণুতার আদর্শ প্রদর্শন করেছেন তিনি। কোনো দিন কারও প্রতি তিনি প্রতিশোধপরায়ণ ছিলেন না। পরমতসহিষ্ণুতা তার মধ্যে এতটাই প্রবল ছিল যে, যারা একদিন তাকে ঘরছাড়া করেছিল, হিজরত করে যাওয়ার পরও নিরাপদ শান্তিতে থাকতে দেয়নি, আবহমানকালের রেওয়াজ থাকার পরও প্রস্তুতি নেওয়া সত্ত্বেও ‘পবিত্র কাবাঘরের তাওয়াফ দৃশ্যত অপমানজনক চুক্তির বন্ধনে ছেড়ে দিতে হয়েছিল, সেই দুরাচারীদের পবিত্র মক্কা বিজয়ের দিবসে পূর্ণ কব্জায় পেয়েও পরমতসহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতির পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরলেন তিনি। অবাক বিস্ময়ে সর্বকালের পৃথিবী প্রত্যক্ষ করল একজন দাস পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে, বিনয়ে গ্রীবা ছুঁইয়ে ওয়াহদানিয়াতের জিকির করতে করতে প্রবেশ করেছেন।’ প্রিয় মাতৃভূমিতে আশ্বাসের বাণী সহিষ্ণুতার বাণী, মুক্তির উচ্চারণ ব্যঙ্গময় হয়ে উঠল তার কণ্ঠে— ‘আজ তোমাদের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। যাও তোমরা মুক্ত ও স্বাধীন।’ এ অনন্য ঘোষণার মাধ্যমে তিনি চিরশত্রু অমুসলিম কাফের ও মক্কার সব অপরাধীকে ক্ষমা প্রদর্শন করে পরমতসহিষ্ণুতা এবং সামাজিক সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করে এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

ইসলাম শুধু আরব ভূমিতেই নয়, বহির্বিশ্বে ক্রমান্বয়ে যখন ইসলামের পতাকা উড্ডীন হচ্ছে তখন সব বিজিত অঞ্চলে অমুসলিম ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে সদাচরণ করার এবং পরমতসহিষ্ণুতার আদর্শকে কঠোরভাবে পালন করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও পরমতসহিষ্ণুতা ইসলামের অন্যতম বিষয় হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দরুন এক্ষেত্রে যেসব শর্ত বাস্তবায়নে ইসলাম দায়বদ্ধ মনে করে থাকে তার উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো— ক. শত্রুর হাত থেকে অমুসলিমদের রক্ষা করা হবে। খ. অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখা হবে।। গ. তাদের ধন-সম্পদ ও প্রাণের নিরাপত্তা দান করা হবে। ঘ. স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি তাদের হাতেই ন্যস্ত থাকবে। ঙ. পূজা-অর্চনা থেকে পাদ্রী-পুরোহিতদের পদচ্যুত করা হবে না। চ. তাদের ধর্মীয় প্রতীক (ক্রুশ ও মূর্তি) বিনষ্ট করা হবে না। ছ. তাদের কাছ থেকে উশল নেওয়া হবে না। জ. তাদের অঞ্চলে অভিযান প্রেরণ করা হবে না। ঝ. তাদের ধর্মীয় চেতনার ওপর আঘাত করা হবে না।

ইসলামে মদিনার সনদের চেতনাই হলো, কারও ওপর জোরজবরদস্তি নয়। চাপ প্রয়োগ বা ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা নিষেধ। অমুসলিমদের প্রতি মানবিক আচরণ এবং সম্প্রীতির সম্পর্ক পৃথিবীর সব ভূখণ্ডে ইসলামের শান্তিকামিতার আদর্শকে ছড়িয়ে দিয়েছিল। পরমতসহিষ্ণুতার এত বাস্তব উদাহরণ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো ধর্ম বা মতবাদে কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না।  পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে— ‘আপনার রব ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে সবাই ইমান আনত তবে কি আপনি মুমিন হওয়ার জন্য মানুষের ওপর জোরজবরদস্তি করবেন।’ (১০:৯০)।

সর্বশেষ খবর