রবিবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

নগরের আর্তনাদ

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ

নগরের আর্তনাদ

বিশ্ববাসীর প্রতিদিনকার আর্তনাদ নগরের যানজটকে কেন্দ্র করে। আমাদের মহানগর ঢাকাবাসীও একইভাবে আর্তনাদ করছে যানজটে নাকাল হয়ে।  ঢাকা মহানগরীর যানজটে প্রতিদিন আমরা মুমূর্ষু রোগীর আর্তনাদ শুনতে পাই। প্রতিদিন কারও মা, বাবা, সন্তান, স্বামী হারানোর বেদনায় আমাদের মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। মনের মাঝে একটি শঙ্কা নিয়ে দিনাতিপাত করি, আশঙ্কায় ফোন ধরি আমার বুঝি হয়তো একটি খারাপ খবর অপেক্ষা করছে। যানজটে আমাদের ক্ষোভ প্রতিদিন ঘনীভূত হচ্ছে। আমাদের শরীরের নাম মহাশয় নাম দিয়ে প্রতিদিন চলছি। এ আর্তনাদ থেকে কি আমাদের মুক্তি নেই? আমাদের ড্রাইভার কমিউনিটি কি আমাদের এ কষ্ট কোনো দিন বুঝবে না? এই জনদুর্ভোগ থেকে কি আমাদের মুক্তির কোনো উপায় নেই? আমাদের প্রতিদিনকার আর্তনাদের মাঝে মেট্রোরেল নির্মাণের ঘোষণা আশার আলো। অনেকেই অনেক কিছু ভাবছেন। আমাদের সাম্প্রতিক ভাবনা মেট্রোরেলকে কেন্দ্র করে। আমরা অনেকেই ভাবছি মেট্রোরেল হলে আমাদের যানজট সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এমনটি ভাবা আমি ভুল বলব না, তবে কেবল মেট্রোরেল চালু করে যানজট দূর করা যাবে না। মেট্রোরেলের রুট নিয়ে দেখা দিয়েছে সমস্যা। এ সমস্যা কেন আরও আগে চিন্তা করা হলো না জানি না। আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে সমস্যা উপস্থাপন করা হলো তা কেন আরও আগে চিন্তা করা হলো না। দায়ভার আমাদের পরিকল্পনাবিদদের নিতে হবে। অধ্যাপক নিকোলাস লো লন্ডন টাউন প্ল্যানিংয়ের মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। বিশ্বের এক নম্বর শহর মেলবোর্নে ৪২ বছর আছেন ও মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। অধ্যাপক নিকোলাস লো বিগত ১২ বছর ট্রান্সপোর্ট সমস্যা নিয়ে রিসার্চ করছেন। বিশ্বের নানান দেশ ঘুরে তিনি একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। তিনি মনে করেন প্রাইভেট কারই সব যানজটের মূল সমস্যা। তিনি মনে করেন একটি বাস ৪০টি কারের প্রয়োজন মেটাতে পারে। সেদিক বিবেচনা করে মেট্রোরেল একটি ভালো উদ্যোগ। আমি তার সঙ্গে যোগ করে বলতে চাই, ভালো ড্রাইভার ছাড়া কোনোভাবে যানজট নিরসন করা যাবে না। যানজটের সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের চিন্তা করতে হবে কী কী কারণে একটি ট্রিপের উৎপত্তি হয়। চিন্তায় রাখতে হবে কী কী ভাবে ব্যস্ত সময় কম ট্রিপ উত্পন্ন হয়। মেট্রোরেল হলেও যানজট থাকবে যদি না আমরা প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ না করি। ইতিমধ্যে দিল্লি একটি নীতি প্রবর্তন করেছে। আমরা সেটি এখনই করতে পারি কিনা? যদি সেটা করি তবে আরও উন্নত মানের বাস চালু করতে হবে। এসব সমস্যার মাঝে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো ড্রাইভারের আচরণ ও নিয়ম মেনে চলার বিষয়টি।  ড্রাইভার যদি প্রতিটি নিয়ম মেনে চলেন তবে নগরবাসী কিছুটা শান্তি পেতে পারে। তাদের কোনো নীতি নেই। নগরের বাস ড্রাইভাররা সকাল ৬টা থেকে শুরু করে রাত ১২টা পর্যন্ত গাড়ি চালান। তিনি কি তবে সুস্থভাবে চিন্তা করতে পারেন? সুতরাং নিয়ম করা উচিত এ অনিয়ম তারা করতে পারবেন না। ঢাকা মহানগরীর যানজট সমস্যার সমাধান হতে পারে যদি একটি company সব বাস চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে। মেলবোর্ন সিটিতে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ভিক্টোরিয়া ট্রেন ট্রাম ও বাস সার্ভিস কন্টাক্ট সার্ভিসের মাধ্যমে পরিচালনা করে। ফলে ড্রাইভারের কর্মঘণ্টা, রুট, স্টপ, ভাড়া, সবকিছু পরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ড্রাইভারদের লাইসেন্স নিয়ে অনেক কাহিনী আছে। সেই কাহিনীর একটা পরিসমাপ্তি সবার দাবি। চালক যদি নিয়ম মেনে যাত্রী ওঠানামা করান তাহলে অর্থাৎ বাসস্টপ ছাড়া যাত্রী তোলা বন্ধ করেন, নিষিদ্ধ জায়গায় বাস না থামান বা পার্কিং না করেন তা হলে ড্রাইভার, মালিক ও নগরবাসী শান্তি পাবে। আমাদের মিডিয়া এ মস্তবড় উপকারটা করতে পারে। আসুন আমরা সবাই মিলে আমাদের শহরটিকে সুন্দর করি। আমাদের ঢাকা শহরের ফুটপাথ দিয়ে মোটরসাইকেল চলে। কতটুকু নীতিবিবর্জিত হলে তারা ওই কাজ করতে পারেন। যারা ফুটপাথে নির্মাণসামগ্রী রাখেন তারা কি ফুটপাথের হকারের মতো বা রিকশাচালকের মতো গরিব বা কম শিক্ষিত? ফুটপাথ যদি নিরাপদ হয়, রিকশা যদি কেবল বাম লেনে চলে তাহলে বাস/কারের গতি বাড়ে। এতে কিন্তু যানজট কমবে। আমাদের পুলিশ নাকি যানজটের কারণ। আমার জিজ্ঞাসা, আমি যদি আইন মানি তবে পুলিশ কেন আমাকে আটকাবে? ড্রাইভার যদি সৎ হয় পুলিশ কোনোভাবে যানজটের কারণ হতে পারে না। আমাদের কারণে পুলিশ অসৎ হয়। আমরা অনেক সময় ড্রাইভারকে নিয়ম ভাঙতে উৎসাহ দেই। আমাদের এসব ভুল অনেক বিপদ ডেকে আনে। আমরা জানি না মেট্রোরেল কতটুকু আমাদের সমস্যা কমাতে পারবে। তবে আমাদের আরও অনেক দিকে নজর দিতে হবে। আমাদের ঠিক করতে হবে সিটি সেন্টার মতিঝিল থাকবে নাকি সচিবালয় অন্য কোথাও সরাব। আমাদের ঢাকা শহরে প্রতিদিন নতুন মানুষ আসছে। এভাবে জনসংখ্যা বাড়লে মেট্রোরেল দিয়ে কোনো কাজ হবে না। আমাদের শহরের মাঝে শিল্প কারখানা আছে। ওইগুলো থাকলে নতুন রাস্তা করে বা মেট্রোরেল করে কিছু করা যাবে না। আমরা প্রতিদিন কষ্ট করছি কিন্তু তার শেষ কোথায় জানি না। তবে প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ও ড্রাইভারদের সচেতন করতে পারলে খুব দ্রুত সুফল পেতে পারি। আমরা একজন ভালো প্রধানমন্ত্রী পেয়েছি বলে দেশ ভালো চলছে। জনগণ ঢাকার দুই মেয়রের দিকে তাকিয়ে। তাদের সদিচ্ছা বদলে দিতে পারে বাংলাদেশের নাগরিক জীবন। অর্থাৎ চালক যদি ভালো হন তাহলে সবাই নিরাপদ বোধ করেন। আমরা ইতিমধ্যে গাবতলী ও মহাখালী যানজটমুক্ত দেখেছি। আমরা আরও ভালো কাজের সংবাদ শুনতে কান পেতে আছি। প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সচিবালয়ের চারদিকে ও মতিঝিলে শুধু ফ্রি বাস সার্ভিস চালু করতে পারি। তেমনি সদরঘাট থেকে গুলিস্তান ফ্রি বাস সার্ভিস চালু করতে পারি। এরকম সিস্টেম মেলবোর্ন ও ফ্রান্স নগরীতে আছে। তাতে রিকশা ও প্রাইভেট কার কম চলবে। আমরা স্কুল সময় ৮টা ৩০, অফিস ৮টা, ব্যাংক ৯টা ৩০ করতে পারি। আমাদের এ ঘনবসতি শহরে নিয়ম না মেনে চললে ও বাস সার্ভিসের মান উন্নত না করলে সবাই প্রাইভেট কারের দিকে ঝুঁকবে। মেলবোর্নে লক্ষ্য করেছি সকাল ৭টা ৩০ থেকে ৯টা ৩০ পর্যন্ত ও বিকাল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত ব্যস্ত সড়কগুলোতে পার্কিং ও থামা নিষিদ্ধ। একটি সড়কে সিটিমুখী তিনটি লেন থাকে সকালে আর বিকালে বিপরীতভাবে তিনটি লেন চালু থাকে। ওখানে ট্রেন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সবাই কার নিয়ে ট্রেন স্টেশন আসেন। কার সেখানে পার্কিং করে ট্রেনে চড়ে কাজে চলে যান। আবার একইভাবে ফেরেন। আমাদের শহরের নিরাপত্তা ভঙ্গুর। প্রাইভেট কারের প্রতি ঝোঁক ও বাসের প্রতি অনীহা এসবের কারণ। সুতরাং ভালো পুলিশ ও সব নাগরিকের পরিচয় সংরক্ষণ খুবই জরুরি। শহরের মাঝে শিল্প নিরাপত্তাকে হুমকিতে রেখেছে। নগরের গতিশীলতা বাড়লে উন্নয়ন বাড়বে। আমাদের মেয়রদের সবাই যদি সহযোগিতা না করি তবে এ দেশ কোনো দিন বাসযোগ্য হবে না। আমরা ভারত নেপাল ভুটানের সঙ্গে

connectivity বাড়াতে চাই। কিন্তু আমাদের নগর যদি নিরাপদ না হয়, যদি যানজট লেগে থাকে, তাহলে ওরা আসবে না। আমাদের বিপুল জনগোষ্ঠী আমাদের সম্পদ। আমরা আজ ভারত থাইল্যান্ড সিঙ্গাপুর যাই বিনোদন ও চিকিৎসার জন্য।  আমরা আমাদের ঢাকা শহর যদি যানজটমুক্ত না করি তবে ঘরে ঘরে অশান্তি বিরাজ করবে।  এ শহর বাসোপযোগী করতে ড্রাইভারদের সুমতি অতি জরুরি।

     লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর