রবিবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

এরশাদ কি বিএনপির সঙ্গে জোট করতে চান?

কাজী সিরাজ

এরশাদ কি বিএনপির সঙ্গে জোট করতে চান?

এরশাদের জাতীয় পার্টি আবারও জাতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। দলের নেতৃত্ব কাঠামোয় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দলীয় গঠনতন্ত্রের ৩৯ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি এ পরিবর্তন এনেছেন।  ১৭ জানুয়ারি এরশাদ তার ছোট ভাই জি এম কাদেরকে উত্তরসূরি হিসেবে দলের কো-চেয়ারম্যান নিয়োগ করার পর কিছু দলীয় লোক জাতীয় সংসদে ‘গৃহপালিত’ বলে সমালোচিত বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদকে নিয়ে এরশাদবিরোধী অবস্থান নেন। তারা রওশন এরশাদকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন এরশাদের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ এনে। এতে ক্ষুব্ধ হন এরশাদ এবং ১৯ জানুয়ারি মঙ্গলবার পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুকে অব্যাহতি দিয়ে এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে পুনরায় মহাসচিব নিযুক্ত করেন। এর আগেও হাওলাদার জাতীয় পার্টির মহাসচিব ছিলেন। রওশন এরশাদকে সামনে রেখে দলে এরশাদবিরোধী জোট পাকিয়েছেন মূলত পাঁচজন। এরা হলেন পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, দুই প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু এবং মশিউর রহমান রাঙ্গা। দলের অপসারিত মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু এবং ‘সরকারপন্থি’ বিরোধী দলের চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। এরশাদবিরোধীরা দলের সংসদীয় কমিটিকে কাজে লাগিয়ে এরশাদকে জব্দ করতে চাইলেও এরশাদ স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, বাড়াবাড়ি করলে তিনি পার্টিবিরোধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন। এ ক্ষেত্রে গঠনতন্ত্র তার অতিশয় মজবুত রক্ষাকবচ। তিনি বারবারই বলছেন, তিনি যা করেছেন সব কিছু গঠনতান্ত্রিক ক্ষমতাবলেই করেছেন। জাতীয় পার্টিতে যারা এরশাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, প্রত্যেককে নাম ধরে ধরে ধমকিয়েছেন তিনি। মজার কাণ্ডও ঘটেছে। সংসদীয় কমিটির সভা থেকে বেরিয়ে তাজুল ইসলাম চৌধুরী অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, তাদের সংসদীয় কমিটি এরশাদ কর্তৃক তার ভাইকে দলের কো-চেয়ারম্যান এবং রুহুল আমিন হাওলাদারকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে। এটা সবাইর জানা যে, কোনো দলের গঠনতন্ত্রসম্মত কোনো সিদ্ধান্ত সে দলের সংসদীয় কমিটি বাতিল বা নাকচ করার ক্ষমতা রাখে না। এরশাদ সাহেব নিজেও সংসদীয় কমিটির সভায় ছিলেন যদিও ‘বিদ্রোহী’রা ভেবেছিল তিনি যাবেন না। সভা থেকে বেরিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে তার সরকারি কার্যালয়ে বসা ছিলেন। খবরটা শুনে ক্ষুব্ধ এরশাদ তাজুলকে ডাকতে বলেন। এরশাদ সমর্থকরা প্রায় ধরেই নিয়ে আসেন তাকে এরশাদের সামনে। এরশাদ সাহেব তাজুল ইসলামকে ধমকিয়ে নাকি জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কি সাংবাদিকদের বলেছ যে, আমার সিদ্ধান্ত সংসদীয় কমিটি প্রত্যাখ্যান করেছে? প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনামতে তাজুল ইসলামের দশা তখন এতই জবুথবু যে, দৃশ্যটা দেখার মতো ছিল। তাজুল ইসলাম জানান যে, তিনি অমন কথা বলেননি। এরশাদ সাহেব তখন তাকে বলেন, চল, এখন আবার সাংবাদিকদের বলে আস যে, তুমি ও কথা বলনি। তাজুল ইসলাম চৌধুরী যথারীতি তার চেয়ারম্যানের নির্দেশ পালন করেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বাহ্যিকভাবে রওশনপন্থি বলে পরিচয়দানকারীরা আপাতত চুপসে গেছেন। এর কারণও আছে। রওশন এরশাদকে সামনে রেখে যারা খেলছেন তারা তিনজন মন্ত্রী, বাকিরা প্রশ্নবিদ্ধ সংসদের সদস্য-এমপি। এরশাদ সাহেবের সিদ্ধান্ত যে জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রসম্মত তা উপরোল্লিখিত গণতান্ত্রিক ধারা থেকে স্পষ্ট। কাজেই তার সিদ্ধান্ত দলীয় সিদ্ধান্ত। নির্বাচন কমিশনে জাতীয় পার্টির যে গঠনতন্ত্র জমা দেওয়া আছে তা-ই দলের এখনো বলবৎ আছে। দলের নিবন্ধন হয়েছে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নামে ও স্বাক্ষরে। তার সিদ্ধান্ত কোনো এমপি অগ্রাহ্য করলে তা দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে এবং দল থেকে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কারণে বহিষ্কৃত হলে সংশ্লিষ্ট এমপির সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাবে। যারা মন্ত্রী আছেন তাদের মন্ত্রিত্বও চলে যাবে। ভোটের খেলায় শেখ হাসিনার তো দরকার এরশাদের গোটা জাতীয় পার্টিকে। এরশাদ সেখানে তারকা। এরশাদবিরোধীরা আপাতত হারানোর আতঙ্কে চুপসে গেলেও তারা কি ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ ছাড়বেন? মনে হয় না।

‘কেন? এই কারণে যে, জাতীয় পার্টির বিরোধটা বাহ্যত বা দৃশ্যত এরশাদ ও রওশন এরশাদের মধ্যকার কর্তৃত্ব-নেতৃত্ব বহাল ও প্রতিষ্ঠার জন্য মনে হলেও বিষয়টা এত হালকাভাবে দেখছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, লড়াইটা মূলত শাসক লীগ ও এরশাদের লড়াই— আরও সরলীকরণ করলে বলা যাবে সরকার বনাম এরশাদ লড়াই। এর ব্যাখ্যা এটাই যে, সরকার ও সরকারি দল জাতীয় পার্টিকে তাদের নিয়ন্ত্রণে বা ‘অধীনে’ রাখতে চায় ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল হিসেবে। আর এরশাদ চাইছেন তার নেতৃত্বে জাতীয় পার্টিকে ‘স্বাধীন’ একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে একটা মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে। মন্ত্রিসভা থেকে দলীয় মন্ত্রীদের পদত্যাগ করতে ‘প্রকৃত’ বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করা হলেও অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য তা নয় বলেই ধারণা করা যায়। সাধারণ মানুষও এ কথা বোঝে যে, ৩০০ আসনের সংসদে যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৫৩ আসনে বিনানির্বাচনে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গণরায় ছাড়াই এমপি হয়ে শাসক লীগ সরকার গঠন করার অধিকারী হয়ে গেছে, বাকি ১৪৭ আসনের নির্বাচন নিয়েও দেশে-বিদেশে বিতর্ক এখনো থামেনি, সেই প্রশ্নবিদ্ধ সংসদে সরকারি দলই যেখানে নৈতিক বৈধতার সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছে সেখানে অনির্বাচিত ও কাটাকাটির ভোটের এমপিদের নিয়ে গঠিত ‘বিরোধী দল’ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেই ‘ধোয়া তুলসী পাতা’ হয়ে যাবে না। এরশাদ সাহেব তো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ই ছিলেন না। তিনি তিন আসন থেকেই মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। হাস্যকর কাণ্ড করেছে নির্বাচন কমিশন। ঢাকার আসনসহ দুটি আসনে তার মনোনয়ন প্রত্যাহূত হলেও রংপুরের একটি আসনে তার মনোনয়ন প্রত্যাহার করেনি ইসি! কি তাজ্জব! ওনার এবং ওনার দলের এমপি সাহেবদের এমপি হওয়ার ‘শানে নজুল’ তো এরশাদ সাহেব জানেন। এখন এরশাদ সাহেব নিজে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের চাকরি যদি ছেড়ে দেন এবং তার দলের তিন মন্ত্রীও যদি পদত্যাগ করেন, তারপরও সব দলের অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচিত সংসদের বিরোধী দলের মর্যাদা যে তাদের কপালে জুটবে না তা এরশাদ সাহেবের মতো চতুর লোক বিলকুল বোঝেন। এতদিন দুধকলা খাইয়ে ‘নানাভাবে হূষ্টপুষ্ট করে সরকার ও সরকারি দল তাদের তা করতেই বা দেবে কেন? এরশাদ সাহেবের সিদ্ধান্তটি একটি সুচিন্তিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলেই মনে হয়। সরকার এবং সরকারি দলের সঙ্গে সব ‘বন্ধন-শৃঙ্খল’ তিনি টুটে ফেলতে চান। এতে ঝুঁকি আছে, জেল-জুলুমের ভয় আছে। একটি প্রকৃত সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের মর্যাদা নিয়ে তিনি নতুন করে জনগণের কাছে যেতে চাচ্ছেন বলে ভাবা যেতেই পারে। দলের পরিবর্তনের দিকে লক্ষ্য করলেও এমন ধারণাটি স্পষ্ট হয়। সরকারপন্থি প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ৩-৪ দিন জাতীয় পার্টিতে এরশাদের ঝাঁকুনি নিয়ে যে ‘আতঙ্কিত’ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে, তাতে বোঝা গেছে এরশাদের সিদ্ধান্তে সরকারের নীতিনির্ধারকদের বোধহয় ‘পেটে গুড়গুড়ি’ শুরু হয়ে গেছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের এই সিদ্ধান্তকে অনেক পর্যবেক্ষক-বিশ্লেষক আগামী দিনের জাতীয় রাজনীতির তাত্পর্যপূর্ণ বার্তা বলে মনে করেন। তারা মনে করেন অদূর ভবিষ্যতে দেশে নতুন একটি রাজনৈতিক মেরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে। সে প্রক্রিয়ায় নতুন জোট হতে পারে, পুরাতন জোটে হতে পারে ভাঙা-গড়ার খেলা। ইতিমধ্যে সে লক্ষণ তো দেখা দিয়েছে। দীর্ঘ ১৭ বছর পর ২০ দলীয় জোট থেকে ইসলামী ঐক্যজোটের বেরিয়ে যাওয়া এবং সরকারের পক্ষ ত্যাগের জন্য জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের উদ্বেল মনোভঙ্গি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা দেখার জন্য কিছু সময় হয়তো অপেক্ষা করতে হবে। সাবেক বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার বিএনএ’র ১৪ দলীয় জোটে যোগদানের সিদ্ধান্তও তাত্পর্যহীন নয়।

এরশাদ সাহেব শেষ পর্যন্ত কী করবেন, তিনি তার সিদ্ধান্তে আদৌ অটল থাকবেন কিনা তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন আছে। কারণ তিনি ইতিপূর্বে বহু ডিগবাজি খেয়েছেন। তবে একটা বিষয়ের প্রতি নজর দেওয়া উচিত। দলে তিনি যে পরিবর্তন এনেছেন তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তার ভাইকে কো-চেয়ারম্যান করায় সমালোচনা করছেন কেউ কেউ। কিন্তু জি এম কাদের তার ভাই-ই শুধু নন, তার দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতাও আছেন অনেক দিন ধরে। জাতীয় পার্টির অন্যসব নেতার মধ্যে তিনি অবিতর্কিত এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় দলের তৃণমূল স্তরেও। নিজ দলের বাইরে অন্য দলের কাছেও তার একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে। এরশাদ সাহেবের যেমন বয়স হয়েছে, রওশন এরশাদেরও তাই। রওশন এরশাদ বরং এরশাদের চেয়ে বেশি কাবু। তাদের  দুজনের পর সে দলের মূল নেতৃত্ব দেওয়ার প্রশ্নে জি এম কাদেরের কোনো বিকল্প নেই। মনে রাখা দরকার, দলটি এরশাদনির্ভর। এরশাদই হচ্ছেন সে দলের ‘ভোট কারেন্সি’। এই উপমহাদেশের রাজনীতিতে পারিবারিক উত্তরাধিকারের যে সংস্কৃতি চলমান আছে, মানি না মানি আমাদের দেশেও তা বাস্তব। সেদিক থেকে উত্তরাধিকারী হিসেবে জি এম কাদের বেস্ট চয়েস। জাতীয় পার্টির বর্তমান ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায়ও রংপুর বিভাগে তাদের সমর্থন অন্য জেলা-বিভাগ থেকে বেশি। সেই অবস্থান ধরে রাখার জন্য রংপুরে এরশাদের বিকল্প রওশন এরশাদ নন, জি এম কাদের। সারা দেশের নেতা-কর্মীদের কাছেও এরশাদের পরই জি এম কাদেরের জনপ্রিয়তার কথা শোনা যায়। সারা দেশে ঘুরেফিরে দল গঠন-পুনর্গঠনে শারীরিক সক্ষমতার দিক থেকেও তিনি অধিকতর সফল। মহাসচিব পদে রুহুল আমিন হাওলাদারও এরশাদের ভালো চয়েস বলে বিবেচনা করছেন বিশ্লেষকরা। তিনি এর আগেও দলের মহাসচিব ছিলেন এবং পার্টি চেয়ারম্যানের প্রতি অনুগত থেকে তার সন্তুষ্টি অনুযায়ী কাজ করেছেন। সারা দেশে জাতীয় পার্টির যেটুকু সাংগঠনিক ভিত্তি আছে সব জায়গায় তার প্রত্যক্ষ সংযোগ আছে বলে তাদের দলীয় লোকজনের মুখেই শোনা যায়। ভদ্রলোক কষ্টসহিষ্ণুও। দীর্ঘদিন রাজনীতি করছেন। এক সময় বিএনপিতেও বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। তাকে বলা হতো জেনারেল (অব.) নুরুল ইসলাম শিশুর রিক্রুট। দল নিয়ে হু. মু. এরশাদের যে পরিকল্পনা আছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন, তা বাস্তবায়নের জন্য এরশাদের চালানে এর চেয়ে ভালো কিছু নেই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সোর্স অব ইনফরমেশন এখন অনেক। ১২ বছরের প্রধানমন্ত্রিত্ব, তার চেয়েও বেশি সময়ের জন্য সংসদে বিরোধী দলের নেতৃত্ব এবং তারও বেশি সময় আওয়ামী লীগের মতো একটি বিশাল সংগঠনের সভানেত্রীত্ব তার অভিজ্ঞতার ঝুলিকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। ভোটের রাজনীতি তিনি ভালো বোঝেন। লীগ সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টার এবং শাসক লীগের নেতা-পাতি নেতারা বাংলাদেশের সব ভোট ‘ব্যাঙের মতো’ লাফিয়ে লাফিয়ে নৌকা মার্কা বাক্সে পড়বে বলে যত গাল-গল্পই ছড়াক না কেন, প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন দলের ভোটের পরিসংখ্যানগত অবস্থান খুবই ভালো করে জানেন। জানেন বলেই একা নির্বাচনের ঝুঁকি আপাতত নিচ্ছেন না। জোট গড়ছেন, কখনো মহাজোট। আবার জোট-মহাজোট গড়ার প্রশ্নে প্রধান দুই দলের বাইরে তৃতীয় ও চতুর্থ ভোট পাওয়া দলের মধ্যে জাতীয় পার্টিকেই সঙ্গে রাখার কৌশল বাস্তবায়ন করছেন। বিগত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের পরিসংখ্যান বলে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোট প্রায় সমান সমান। কখনো কখনো ৩ থেকে ৪ পার্সেন্ট ভোট কারও বাড়ে, কারও কমে। তখনই কারও দরকার হয়েছে জামায়াতকে কারও জাতীয় পার্টিকে। একদিকে রাজাকার, আরেকদিকে স্বৈরাচার। ক্ষমতার জন্য এদের সঙ্গী করতে কারোরই লজ্জা হয় না, বিবেক দংশন করে না।

জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির এখন টানাপোড়েন চলছে। পৌর নির্বাচনে তা একেবারেই স্পষ্ট হয়েছে। জামায়াতও ভাবছে, বিএনপির সঙ্গে থেকে তাদের আর লাভ নেই। নেতাদের বাঁচাতে পারেনি, দলও হয়তো বিপদে পড়বে। জামায়াত বিএনপি ছেড়ে গেলে আগামী নির্বাচনের আগে দলটি নিষিদ্ধ নাও হতে পারে। কিন্তু তার পরও জামায়াতের কিছু ভোট ধানের শীষে চলে যেতে পারে যেহেতু তারা দলীয়ভাবে নির্বাচন করতে পারবে না। সে ভোট ব্যালেন্স করার জন্য আওয়ামী লীগের দরকার জাতীয় পার্টিকে। জাতীয় পার্টির শক্তি ছাড়াও এরশাদের দেশ-বিদেশে আরও মিত্র ও সোর্স আছে বলে শোনা যায়। প্রধানমন্ত্রীর তা না জানার কথা নয়। বাংলাদেশে দ্রুত একটি অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জাতীয় আন্তর্জাতিক চাপের কথা অগ্রাহ্য করা যায় না। এরশাদ সাহেব কি তেমন একটি নির্বাচনের সম্ভাবনার গন্ধ পেয়েছেন? সে গন্ধ পেয়েই কি তিনি নড়েচড়ে উঠেছেন? প্রধানমন্ত্রী গত ২১ জানুয়ারি সিলেটের জনসভায় নৌকার পক্ষে ভোট চেয়ে এমন ধারণাকেই জোরালো করেছেন। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদেরও বলেছেন, সরকার আগাম নির্বাচনের কথা ভাবছে। একটি আগাম অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সম্ভাবনাকে মাথায় রেখেই কি এরশাদ সাহেব তার দলকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে পুরনো মিত্র আওয়ামী লীগকে ত্যাগ করে রাজনীতির নতুন মেরুকরণে বিএনপির সঙ্গে নতুন মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ার কথা ভাবছেন? রাজনীতির এই অঙ্কের সহজ সমাধানের জন্য সরকার চাইবে এরশাদকে হটিয়ে রওশন এরশাদের নিয়ন্ত্রণে জাতীয় পার্টিকে রাখতে। এমতাবস্থায় জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে রওশনপন্থিরা এরশাদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু করেছেন, সে যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়বেন বলে মনে হয় না। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তারা আবার ‘ফণা’ তুলতে পারেন। এরশাদ সাহেব তো বলেছেন মৃত্যুর আগে তার সিদ্ধান্ত বদল হবে না।  এরশাদ যদি অটল থাকেন, এবার যদি ‘র্যাবের চিকিৎসা’ তিনি ইগনোর করতে পারেন তাহলে একটি আগাম অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এবং জাতীয় রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের ধারণা ও সম্ভাবনা প্রবল হবে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। ই-মেইল : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর