শনিবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

হিজরত প্রসঙ্গ

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক কে. আলীর মতে, তার মক্কা ত্যাগ একটি সামান্য ঘটনা বলে মনে হলেও ফলাফলের দিক দিয়ে এটা পৃথিবীর ইতিহাসের স্মরণীয় ঘটনাগুলোর সঙ্গে তুলনীয় এবং অনেক ক্ষেত্রে ওইসব ঘটনাবলির মহিমাকেও ম্লান করে দিয়েছে। অধ্যাপক পিকে হিট্টি বলেন, এটা মক্কা যুগের অবসান ঘটিয়ে এবং মদিনা যুগের সূত্রপাত করে হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। হিজরত শুধু হজরতের জীবনের পরিবর্তনই আনেনি, ইসলামের ইতিহাসেও এটা বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করল। এ সময় থেকে ইসলামে হিজরি সন গণনা করা শুরু হয়। অবমাননা, অত্যাচার ও নিরাশার দিনগুলো শেষ হয়ে বিজয়ের যুগ আরম্ভ হয়। এতদিন ধরে হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় তার দেশবাসী কর্তৃক লাঞ্ছিত ও অবহেলিত হয়ে আসছিলেন। কিন্তু মদিনায় এসে তিনি শুধু সম্মানিত অতিথি রূপেই সংবর্ধিত হলেন না, কালক্রমে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সভাপতিও হয়েছিলেন।

হিজরতের আগে মক্কাতে ইসলাম নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের ধর্ম ছিল। দীর্ঘ তের বছর যাবৎ হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শান্তিপূর্ণ প্রচারের মাধ্যমে মূর্তি-উপাসক কুরাইশদের তার ধর্মে দীক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। ধর্মপ্রচারের শেষের তিন বছর ইসলামের অগ্রগতি মক্কাতে প্রকৃতপক্ষে থেমে গিয়েছিল। কাজেই মক্কায় ইসলামের ভবিষ্যৎ সাফল্য একেবারে অন্ধকারাচ্ছন্ন না হলেও অস্পষ্ট ছিল। সুতরাং হিজরতের মতো ঘটনা সংঘটিত না হলে ইসলাম মক্কার পৌত্তলিকদের মধ্যে স্বল্প পরিচিত একটি ধর্ম হিসেবেই হয়তো সীমাবদ্ধ থাকত। হজরতের মদিনা আগমনের পর হতে ইসলাম দিন দিন শক্তিলাভ করতে লাগল। অধিকাংশ মদিনাবাসী ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে এর ভিত্তি দৃঢ় করল। এতদিন পর হজরতের ত্যাগ ও সাধনা সার্থকতার পথে ধাবিত হলো। পরবর্তীকালে ইসলাম যে পৃথিবীর নানা দেশে বিস্তার লাভ করেছিল, তা হিজরতের ফলেই সম্ভব হয়েছিল।

ইসলাম তথা বিশ্বের ইতিহাসে হিজরতের প্রত্যক্ষ ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সুদৃঢ়প্রসারী। মদিনায় ধর্মপ্রচারের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থারও ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামের মৌলিক বৈশিষ্ট্য ও নীতি (যেমন আল্লাহ, রোজ কেয়ামত, বেহেশত প্রভৃতিতে বিশ্বাস) মক্কাতে অবতীর্ণ হলেও এটা মদিনাতে হিজরত করার পর একটি সংগঠিত ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। হিজরত হজরতের কার্যপদ্ধতিতে এক বিরাট পরিবর্তন এনেছিল। মক্কাতে ইসলাম শুধু একটি ধর্মই ছিল; কিন্তু মদিনাতে এটা ধর্ম ও রাষ্ট্রপদ্ধতি হিসেবেও স্বীকৃতি হলো। মক্কায় হজরত ধর্মগুরু ভূমিকায় কাজ করেছিলেন। কিন্তু মদিনায় এসে তিনি একজন শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদের ভূমিকাও গ্রহণ করলেন।

এ সম্বন্ধে পিকে হিট্টি বলেন, হজরতের ভিতরের দ্রষ্টা তার জীবনের পটভূমিতে স্থিতি লাভ করল, আর জেগে উঠল রাজনীতির বাস্তব মানব।’ তাই বলা হয়, হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কাতে নবী ছিলেন, কিন্তু মদিনাতে তিনি রাজনীতিবিদও হলেন। উপজাতীয় আবরদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা হিজরতের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল। হিজরতের পর মদিনাকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের রাজধানী করা হয়। এতে মদিনার মর্যাদা ও গুরুত্ব যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি বিভিন্ন গোত্র নিজেদের স্বার্থ ভুলে গিয়ে ইসলামের খাতিরে এক জাতিতে পরিণত হয়। ‘সবাই ভাই-ভাই’ এ ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি বৃহৎ মুসলিম সমাজ গড়ে উঠেছিল— যার কাছে পরবর্তীকালে পরাক্রমশালী রোম ও পারস্য সাম্রাজ্য মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়।  সর্বশেষে বলা যায়, হিজরত ইসলামের নৈতিক মূল্যবোধ, ধর্মের দৃঢ়তা এবং নবদীক্ষিত মুসলমানদের আনুগত্য প্রমাণ করে। ধর্ম রক্ষার্থে দারিদ্র্য, অনশন কিংবা যুদ্ধ কোনো কিছুই তাদের বিন্দুমাত্র লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে পারেনি এবং ধর্মের প্রতি এ দৃঢ়তা পরবর্তীকালে তাদের অপরাজেয় করে তোলে।   -শাকিল জাহান

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর