শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

রাজনীতি বাচ্চাদের খেলা নয়

আবু হেনা

রাজনীতি বাচ্চাদের খেলা নয়

২০০৪ সালের নির্বাচনে ভারতীয় কংগ্রেসের বিশাল বিজয়ের পর নির্বাচিত দলীয় সদস্যরা যখন কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীকে অভিনন্দন জানাতে ব্যস্ত তখন তার পুত্র রাহুল গান্ধী বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এ সময় একজন সাংবাদিক ভারতীয় জনতা পার্টি সম্বন্ধে জানতে চাইলে রাহুল অনেকটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বললেন, ‘বিজেপি? বিজেপি কোনো রাজনৈতিক দল নয়, ওটা একটা ফার্স, একটি জোক।’ অর্থাৎ ‘বিজেপি শুধু একটি হাসি-তামাশার বস্তু, কোনো রাজনৈতিক দল নয়’।  তার এ বক্তব্যটি সাংবাদিকরা বিজেপি দলীয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির গোচরে আনলে তিনি তার তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘রাজনীতি বাচ্চোকা খেল নেহি হ্যায়।’ অর্থাৎ রাজনীতি বাচ্চাদের খেলা নয়। ভারতের ২০১৪-এর নির্বাচনে ভারতরত্ন খেতাবে ভূষিত বিশিষ্ট রাষ্ট্রনায়ক বাজপেয়ির এই উক্তিটি সত্যে রূপান্তরিত করেছে সে দেশের শত কোটি জনতা, নির্বাচনের পর লোকসভায় নবম সারিতে আসন নিয়েছেন রাহুল আর সোনিয়া গান্ধী, হারিয়েছেন সংসদে বিরোধী দলের নেতার আসনটি।

২০০৪ সালের অভূতপূর্ব সাফল্যের পর সোনিয়া গান্ধী শিখ ধর্মাবলম্বী মনমোহন সিং-এর মতো একজন অরাজনৈতিক শিক্ষাবিদকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে দলীয় রাজনীতিতে নেহরু পরিবারের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কাজে লেগে যান। একে একে প্রধান রাজনীতিবিদরা সরে যান দলের শীর্ষ নেতৃত্বের রেসট্র্যাক থেকে। রাষ্ট্রপতি হয়ে যান আর একজন পরীক্ষিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, প্রণব মুখার্জি, এক সময় যিনি ইন্দিরা গান্ধীর ক্যাবিনেটে অর্থমন্ত্রী ছিলেন। আজ রাহুল গান্ধী তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন। শিগগিরই তিনি সোনিয়া গান্ধীর স্থলাভিষিক্ত হবেন। ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হবেন তিনি।

স্বাজাত্যবোধের উন্মেষের সঙ্গে যুক্ত হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যই ১৮৮৪ সালে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সবকিছুর ওপর প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের গৌরব আরোপ করে সনাতনী ধর্মের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার মনোভাব নিয়েই কংগ্রেসের সৃষ্টি। এ পথ অনুসরণ করেই মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু, বল্লব ভাই প্যাটেল কংগ্রেসের নেতৃত্ব নেন। ১৯৪৬ সালে নেহরু যখন সর্বভারতীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন তখনই রাষ্ট্রকার্যে তাকে সহায়তা দেওয়ার জন্য তিনি তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকে তার ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাছে নিয়ে আসেন। স্বাধীনতার আগে ও পরে যেসব প্রবীণ রাজনীতিক তার মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন তারা হলেন— গুলজারিলাল নন্দ, মোরারজি দেশাই, লালবাহাদুর শাস্ত্রী এবং পিসি নরসিমা রাও। এ সময় কংগ্রেস দলের সভাপতি ছিলেন কুমারস্বামী কামরাজ। নেহরুর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী হন লালবাহাদুর শাস্ত্রী, ইন্দিরা গান্ধী ও নরসিমা রাও। তারপর ইন্দিরা গান্ধী এবং রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী। দুজনই আঁততায়ীর হাতে নিহত হলেন এবং তারপরই ২০০৪-এর নির্বাচনে কংগ্রেসের অভূতপূর্ব বিজয় এবং একই সঙ্গে সোনিয়া আর রাহুলের যাত্রা শুরু।

এর ঠিক দশ বছর পর, বিগত নির্বাচনে বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি ‘মা আর বেটার’ কংগ্রেসকে তুলাধোনা করে ভারতীয় পার্লামেন্টে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন। এর কারণ একটিই। আশির দশকে যে স্বাজাত্যবোধ এবং হিন্দু পুনরুত্থানবাদকে অবলম্বন করে কংগ্রেসের সূচনা হয়েছিল, এখন জন্মসূত্রে ইতালীয় খ্রিস্টান সোনিয়া এবং পার্সিধর্মীয় ফিরোজ গান্ধীর স্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ তত্ত্ব কংগ্রেসকে সেই মতাদর্শ থেকে অনেক দূরে নিয়ে যায়। তারই সুযোগ নিয়ে হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান বানারসিতে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি হিন্দু পুনরুত্থানবাদকে পুনরুজ্জীবিত করে একই সঙ্গে হিন্দুত্ববাদ এবং বিজেপির বিজয় ঘোষণা করলেন। এবার সোনিয়া গান্ধীও বিদায় নিচ্ছেন। এখন থেকে কংগ্রেস শুধু রাহুলের। তারুণ্য এবং সেকুলারিজমকে সম্বল করে তাকে মোকাবিলা করতে হবে হিন্দু ধর্মে পুনর্বিশ্বাসী জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদদের এবং স্বাজাত্যবোধ এবং হিন্দুত্ববাদকে। রাহুল অবশ্য এখন আর সেই দশ বছর আগের তরুণ নন। দশ বছর ধরে অনেক শ্রম দিয়ে তিনি দেশকে সংগঠিত করেছেন। কিন্তু তার পাশে নেই মোরারজি দেশাই, গুলজারিলাল নন্দ আর লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মতো জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা। ভারতের রাজনীতিতে তরুণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এক সময় অস্থির হয়ে উঠেছিল ইন্দিরা গান্ধীর কনিষ্ঠ পুত্র যুব কংগ্রেসের নেতা সঞ্জয় গান্ধী এবং তার উচ্চাভিলাষী স্ত্রী মেনকা গান্ধী, বর্তমানে বিজেপি সরকারের মন্ত্রী। রহস্যজনকভাবে সঞ্জয়ের বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল। এরপর একই পরিবারের সদস্য ইন্দিরা এবং রাজীবও আঁততায়ীর হাতে মৃত্যুবরণ করেন। কংগ্রেসের ওপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী এবং তার দুই পুত্র। এবার সোনিয়া গান্ধী, রাহুল এবং প্রিয়াঙ্কার স্বামীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে। ২০১৬’র ৩১ জানুয়ারি ডেইলি স্টারে প্রকাশিত বিশিষ্ট সাংবাদিক এমএজে আকবরের সমীক্ষা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জনসমর্থন এখন ৫৮ শতাংশ। অন্যদিকে রাহুল গান্ধীর জনপ্রিয়তা এ সময়ে ১১ শতাংশে নেমেছে। সেই সঙ্গে কংগ্রেসের সমর্থন বিগত নির্বাচনে ১৯.৫ শতাংশ থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে ১৪ শতাংশে। একইভাবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে ভুট্টো পরিবারকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে জেড.এ. ভুট্টো আর তার কন্যা বেনজির। এখন তার তরুণ পুত্র লন্ডনে অধ্যয়নরত অবস্থাতেই দূর থেকে রিমোট কন্ট্রোলে দলটি পরিচালিত করছেন। ধারণা, ভুট্টো পরিবার ছাড়া দলটি টিকবে না।

বাংলাদেশে ২০০১ সালের নির্বাচনে অভূতপূর্ব বিজয়ের পর বেগম খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে তথাকথিত তরুণ নেতৃত্ব এবং পারিবারিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অনেকটা সঞ্জয় গান্ধীর মতোই তত্পর হয়ে ওঠেন। ১৯৭৮ সালের জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ওপর ভিত্তি করে জনগণনির্ভর গণতন্ত্র ও রাজনীতি এবং জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তি, আত্মনির্ভরশীলতা ও প্রগতির লক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠা করেন। বৈদেশিক আধিপত্যবাদ এবং অভ্যন্তরীণ নৈরাজ্যের অবসান ঘটিয়ে দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে সংরক্ষিত রেখে সামাজিক  অর্থনৈতিক  ন্যায়বিচারের সমাজতত্ত্ব জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলিত করাই ছিল এই দলের উদ্দেশ্য। দলের ঘোষণায় বলা হয় : ‘ইতিহাসের প্রয়োজনে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট যুক্ত রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর এবং অন্যদের সমবায়ে এই দল গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জাতীয় মিলন ও ঐক্যের দল। এ দলের বৈপ্লবিক উদারতা ও বিশালতা সব দেশপ্রেমিক মানুষকে এই অটল ঐক্যবাহী কাতারে শামিল করে জাতীয় পর্যায়ে স্থিতিশীলতা এবং সার্বিক উন্নতি ও প্রগতি আনতে সক্ষম হবে বলে যৌক্তিক ও বাস্তব আশা এবং সম্পূর্ণ বিশ্বাস আমাদের আছে।’

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতা বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। এরপর মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল (অব.) ওসমানীকে দেশব্যাপী ভোটযুদ্ধে পরাজিত করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিন বছর সময়ে তিনি দেশের জ্ঞানীগুণী এবং বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, সমাজে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে সম্পৃক্ত করে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে স্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ১৯ দফার মাধ্যমে গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রার সূচনা করেন। এদের মধ্যে বারডেমের প্রতিষ্ঠাতা ডা. ইব্রাহীম, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবুল ফজল এবং শামসুল হক, শিক্ষাবিদ প্রফেসর এমএন হুদা, সৈয়দ আলী আহসান, ড. ফসিহউদ্দিন মাহতাব, জনপ্রশাসক কাজী আনোয়ারুল হক এবং আজিজুল হক, আকবর কবীর, আইজি কিবরিয়া, সামরিক বাহিনীর জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশু, জেনারেল মাজেদুল হক এবং পানি বিশেষজ্ঞ এ আব্বাস এটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরপর ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮-এ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠা করে যাদু মিয়া, শাহ্ আজিজ, প্রফেসর ইউসুফ আলী, ওবায়দুর রহমান, ভোলা মিয়া, এসএ বারী এটি, ডা. বি. চৌধুরী, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, তানভীর সিদ্দিকী, সাইফুর রহমান, শেখ রাজ্জাক আলী, আবদুস সালাম তালুকদার, প্রফেসর একরামুল হক, কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ, মির্জা গোলাম হাফিজ, ব্যারিস্টার কামরুদ্দিন সরকার, আর এ গনি, তরিকুল ইসলাম, টিএইচ খানসহ অনেক রাজনৈতিক নেতাকে দলীয় সংগঠনে নিয়ে আসেন। ১৯৭০-৭১-এর নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে তিনি উপ-রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেন এবং ১০ এপ্রিল ১৯৭১ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠকারী প্রফেসর ইউসুফ আলীকে প্রথম শিক্ষামন্ত্রী এবং পরে কাজী জাফরকে পরবর্তী শিক্ষামন্ত্রী করেন। তার মৃত্যুর পর বিচারপতি সাত্তার তার স্থলাভিষিক্ত হন এবং তারপর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ড. কামাল হোসেনকে পরাজিত করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯১-এর নির্বাচনে বিএনপির জয়ের পর শেখ রাজ্জাক আলী স্পিকার নির্বাচিত হন এবং প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে সহায়তা করার জন্য ডা. বি চৌধুরী সংসদ উপনেতা নির্বাচিত হন। বেগম জিয়ার মন্ত্রিসভা ছিল উল্লিখিত যোগ্য নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে গঠিত একটি দক্ষ সরকার। পঞ্চম ও ষষ্ঠ সংসদের স্পিকার হিসেবে শেখ রাজ্জাক আলী অনন্যসাধারণ সাফল্যের স্বাক্ষর রাখেন। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে সাইফুর রহমান এদেশের অর্থনীতিতে ভ্যাট পদ্ধতি প্রচলন করে এশিয়ার রাজস্ব ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেন। ষষ্ঠ সংসদ ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করল যার মাধ্যমে সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণে ভ্যাটের ভূমিকা আজ সর্বজন প্রশংসিত।

১৯৯৬ জুনের নির্বাচনে বিএনপি ১১৬টি আসনে জয়ী হয়ে সংসদে বিরোধী দলের গঠনমূলক দায়িত্ব পালন করে। এ সংসদে আমাদের বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে সারা দেশে গণজাগরণ সৃষ্টি হলো। সেই সঙ্গে পথযাত্রা, সভা-সমাবেশ আয়োজন করে দলকে তৃণমূলের আরও কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হলো। গঠিত হলো শতনাগরিক কমিটি। এর মাধ্যমে বিভিন্ন সেমিনার ও আলোচনা সভার মাধ্যমে জাতীয় সমস্যাগুলো এবং এর সমাধান জনগণের সামনে তুলে ধরা হলো। এরপর ২০০১ এর নির্বাচনের আগে শতনাগরিকের উদ্যোগে ‘সংহতি সম্মেলন’ করে ইসলামী মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে চারদলীয় নির্বাচনী জোট গঠন করা হলো। ফলশ্রুতিতে ২০০১ এর ৮ম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ১৯৬টি আসনে জয়ী হলো আর চারদলীয় জোট পেল ২১৭টি আসন।

এরপরই বিএনপি ভারসাম্য হারাল, শেখ রাজ্জাক আলীকে অসম্মানজনকভাবে সরিয়ে দিয়ে হাওয়া ভবনের মালিক আলী আসগর লবীকে মনোনয়ন দিয়ে তারেক রহমানের নেতৃত্বে দ্বৈতশাসন প্রতিষ্ঠিত হলো। সৃষ্টিলগ্ন থেকে যারা শ্রম এবং আত্মত্যাগের মাধ্যমে দলটিকে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিলেন তারা একে একে দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিলেন। এখন থেকে সর্বক্ষেত্রে দ্বিতীয় নেতা শুধু তারেক রহমান। ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম সংসদে উপনেতা ডা. বি. চৌধুরী আর সংসদ উপনেতা থাকলেন না। ব্যারিস্টার আবদুস সালামের মৃত্যুর পর মান্নান ভূঁইয়া দলের মহাসচিব হন। তিনি হয়ে গেলেন নামমাত্র মহাসচিব। মন্ত্রিসভার সব সদস্যই তারেক রহমানের আজ্ঞাবহ হয়ে গেলেন। ওবায়দুর রহমান, কর্নেল অলি মন্ত্রিত্ব বঞ্চিত হলেন। ডা. বি চৌধুরী অসম্মানজনকভাবে বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে গেলেন। সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হলেন। এবার সামনের সারিতে উঠে এলো লুত্ফুজ্জামান বাবর, গিয়াসউদ্দিন আল মামুন, হারিস চৌধুরী, আলী আসগর লবী, রশিদুজ্জামান মিল্লাত, সিলভার সেলিম, এপিএস নুরুদ্দিন, শিমুল বিশ্বাস। হাওয়া ভবনের সামনে খোলা জায়গায় ব্যাঙ্গাত্মক ক্রিকেট খেলা দেখিয়ে শেখ হাসিনার হাওয়া ভবন অভিমুখী কর্মসূচিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হলো। সংসদে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা হলো। শুরু হলো জঙ্গি উপদ্রব সারা দেশে। তারপর এইচএম এরশাদের মনোনয়ন বাতিল করে নির্বাচন বর্জন করার অজুহাত আওয়ামী লীগের হাতে তুলে দেওয়া হলো। ২২ জানুয়ারি ২০০৭ এর নির্বাচন বন্ধ হলো- এরপর এক-এগারোর নাটক মঞ্চস্থ হলো। বেগম জিয়া গ্রেফতার হলেন, তারেক রহমান, আরাফাত রহমান নির্বাসিত হয়ে চিকিত্সার নামে দেশ ছাড়লেন। ২০০৮ এর নির্বাচন দিল ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিন সরকার। এ নির্বাচনে লন্ডন থেকে সব মনোনয়ন দিল তারেক রহমান। ২০০১ এ নির্বাচিত প্রায় সবাই মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হলেন। ফলে নির্বাচনে মুখ থুবড়ে পড়ল বিএনপি, সংসদে আসন এবার মাত্র ২৮টি।

এরপর থেকে শুধু ভুল আর ভুল, একক সিদ্ধান্ত আর অপরিণামদর্শী, আত্মঘাতী আন্দোলনের কর্মসূচি, নির্বাচন বয়কট, ৯৩ দিনের অবরোধ-হরদম হরতাল। হেফাজতের আন্দোলনে প্রথমে সমর্থন দিয়ে পরে তা প্রত্যাহার করা হলো। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর সংলাপের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করা হলো। আরাফাত রহমানের মৃত্যুর পর সমবেদনা জানাতে গিয়ে গুলশান অফিসের গেট থেকে অপমানিত হয়ে ফিরে এলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ চেয়ে পরে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। এসব কিছুর একটিই কারণ— দলের কারও সঙ্গে পরামর্শ না করে সব সিদ্ধান্ত এককভাবে বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান নিয়েছিলেন। দীর্ঘ ৯৩ দিনের অবরোধকালে স্থায়ী কমিটির সদস্য একমাত্র নজরুল ইসলাম খান ছাড়া আর কারও সঙ্গে কোনো সংযোগ স্থাপন করা হয়নি। আজ বিএনপিতে কোনো রাজনীতি চর্চা নেই।  ছয় বছর এ দলের কোনো কাউন্সিল হয়নি। গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে— প্রতি তিন বছর অন্তর কাউন্সিল হবে এবং তিন বছরের জন্য কাউন্সিলরদের ভোটে চেয়ারপারসনসহ সংগঠনের অন্যান্য কর্মকর্তা নির্বাচিত হবেন। ২০০৯-এ বিএনপির শেষ কাউন্সিলের কার্যকারিতা শেষ হয়েছে ২০১২ সালে। কিন্তু আজ অবধি গঠনতন্ত্র মতো কোনো বৈধ সংগঠন গঠন করা হয়নি।  ফলে দল আজ সাংবিধানিকভাবে নেতৃত্বশূন্য। বাচ্চাদের রাজনীতির পরিণতি ভোগ করছে বিএনপি।

     লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর