রবিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

সবার প্রিয় আলতাফ মাহমুদ

মুহম্মদ ফজলুর রহমান

সবার প্রিয় আলতাফ মাহমুদ

প্রায় প্রতিদিনই দেখা হয়েছে গত নভেম্বর মাসজুড়ে। কে ভেবেছিল তিনি আমাদের ছেড়ে এত দ্রুতই চলে যাবেন! যার কথা বলছি তিনি বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সবার প্রিয় নেতা আলতাফ মাহমুদ। সদ্য বিদায়ী বছর ২০১৫ সালের অক্টোবরের ৩১ তারিখের ভোরে হাসিকে (স্ত্রী অধ্যাপিকা হুসনে আরা) সঙ্গে নিয়ে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করি। মিরপুরে একটু বিশ্রাম নিয়ে দুপুরেই গিয়ে হাজির হই আমার প্রিয় জায়গা জাতীয় প্রেসক্লাবে। এরপর ৪ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই প্রেসক্লাবে গিয়েছি এবং প্রতিদিনই সাংবাদিক সমাজের প্রিয় নেতা আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। কখনো এক টেবিলে বসে আড্ডা, কখনো দূর থেকে ইশারায় হাই-হ্যালো। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে আলতাফ মাহমুদ সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তারই আরেক সহযাত্রী এবং আমাদেরও সুহূদ আবদুল জলিল ভূঁইয়া ছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী। নির্বাচন নিয়ে তাকে খুব স্বাভাবিকভাবেই ব্যস্ত থাকতে দেখেছি। ব্যস্ততার মধ্যেও তার সঙ্গে হাসি এবং কুশল বিনিময় কিংবা হাই-হ্যালো বাদ যায়নি কখনো। বেশ বড় ব্যবধানেই তিনি বিজয়ী হন। তাকে অভিনন্দন জানাতে গেলে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘দোয়া করবেন। শরীরটা খুব ভালো যায় না। তারপরও এসব করতে হয় সাধারণ সাংবাদিকদের তাড়নায়। ওরা ছাড়ে না।’ আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে আমার পরিচয় সাপ্তাহিক খবর যখন দৈনিক খবর হয়ে আত্মপ্রকাশ করে তখন থেকেই। আলতাফ সাপ্তাহিক খবর থেকেই সেখানে। আবু তাহের, আশরাফ খান, শফিকুল আলম কাজল, কবি শাহনূর খান, শাহজাহান সরদার, আমীরুল মোমেনীন, সুনীল গায়েন, আমিসহ আরও বেশ কয়েকজন নতুন হিসেবে দৈনিক খবরে যোগ দিই নির্বাহী সম্পাদক আওয়াল ভাইয়ের (আবদুল আওয়াল খান) নেতৃত্বে। সম্পাদক ছিলেন মালিক স্বয়ং মিজানুর রহমান। তখন দৈনিক খবরের অফিস শান্তিনগরে। সবার মধ্যে উত্সাহ-উদ্দীপনার শেষ নেই। সবার মধ্যেই কর্ম-উদ্যম। নতুন সম্পর্কের উষ্ণতা। দৈনিক পত্রিকা জগতের আধুনিকায়নে দৈনিক খবর পথনির্দেশক। ফটো কম্পোজ এবং কম্পিউটার কম্পোজের মধ্য দিয়ে সংবাদপত্র জগতের আধুনিকায়নের যাত্রা শুরু। তার নেতৃত্ব দেয় দৈনিক খবর। আলতাফ মাহমুদসহ আমরা ছিলাম সেই অভিযাত্রী দলের লড়াকু সদস্য। পরে শান্তিনগর থেকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় স্থানান্তর একই আন্তরিকতায় মাখামাখি হয়ে। শান্তিনগরের সেই কর্মযজ্ঞ থেকে আলতাফ মাহমুদ এবং আমার একসঙ্গে চলার শুরু। এরপর দীর্ঘ পথচলা। সাংবাদিকদের পেশাগত মর্যাদা, অধিকার, পেশার মান উন্নয়নে আন্দোলন, সংগ্রাম। সে সময় আমি ইউনিটে এবং ইউনিয়নে সমান সক্রিয়। আলতাফ মাহমুদের মধ্যে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য সবসময় লক্ষ্য করা গেছে। সত্য তা যত কঠিনই হোক, খুব সহজ করে বলে ফেলতে পারতেন। নির্ভয়ে নিজের অধিকার এবং অন্যের ন্যায্য অধিকারের পক্ষে দাঁড়াতে পারতেন। আর যা কিছু করতেন ভিতরের গভীর বিশ্বাস থেকেই করতেন। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের দৈনিক খবর ইউনিট খোলা হলে আমি তার প্রথম ইউনিট চিফ নির্বাচিত হই। কেমন করে যেন আমি সাংবাদিকতা পেশার শুরু থেকেই ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। ইকবাল সোবহান চৌধুরী, হাবিবুর রহমান মিলনের নেতৃত্বাধীন ফোরামের একজন হয়ে যাই। নির্বাচনের আগে এই ফোরামের মনোনয়ন কমিটির সদস্যও আমাকে করা হতো প্রায় প্রতিবারই। আলতাফ মাহমুদের সাহস, সততা, পেশার মানুষের জন্য কিছু করার একাগ্রতা এবং সুন্দর করে বক্তৃতা দেওয়ার যোগ্যতা আমাকে শুরু থেকেই মুগ্ধ করে। তাই আমি আমার ইউনিটের পক্ষ থেকে আমাদের ফোরামে নির্বাচন করার জন্য প্রথম আলতাফ মাহমুদের নাম প্রস্তাব করি সম্ভবত প্রচার সম্পাদক পদে। এরপর আর আলতাফ মাহমুদকে পেছনে ফিরে দেখতে হয়নি। নিজের যোগ্যতা, সাহস, সততায় সাংবাদিকদের আস্থা অর্জনের মধ্য দিয়ে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে), বিএফইউজের সেক্রেটারি/প্রেসিডেন্ট পদে একাধিকবার নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজের একজন অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। গত নভেম্বর মাসে বিএফইউজের যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সে নির্বাচনেও প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়ে শেষবারের মতো তিনি সাংবাদিকদের কত বিশ্বস্ত এবং প্রিয় নেতা ছিলেন তার প্রমাণ দিয়ে গেছেন। আলতাফ মাহমুদ কর্মে এবং ভালোবাসায় বিশ্বাস করতেন। নিজে যেমন অন্যকে ভালোবাসতেন অন্যের ভালোবাসাও অর্জন করেছেন তেমনি। আলতাফ মাহমুদ সম্পর্কে একথা বারবার বললেও কম বলা হবে, তিনি সততায়, বিশ্বস্ততায়, পেশাদারিত্বে, সরলতায় ও নির্ভীকতায় ছিলেন উজ্জ্বল ও অনন্য এক ব্যক্তিত্ব। নেতৃত্বের এমন এক বিরল গুণে তিনি ছিলেন উদ্ভাসিত যা আজকের এই স্বার্থান্ধ সময়ে দুর্লভ এবং ব্যতিক্রমী। তাই তো তার মহাপ্রয়াণে সবাই শোক সাগরে নিমজ্জিত। আলতাফ মাহমুদ বাংলাদেশের নিষ্ঠুর বাস্তবতায় খুব ভালো করেই জানতেন সত্ মানুষের নিত্যসঙ্গী দুর্ভোগ আর টানাপড়েন। সেটা হাসিমুখে তিনি মেনে নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক পেশাজীবী সাংবাদিক-বান্ধব এক নেতা। সেখানে কোনো আপস ছিল না, কোনো ভণ্ডামি বা বেইমানি ছিল না। সাংবাদিক সমাজের শীর্ষ নেতা হয়েও বারবার কর্মহীন হয়েছেন। কিন্তু দুর্ভোগের কাছে পরাজয় মানেননি কখনো। সততার বিনিময়ে সবকিছু হাসিমুখে মেনে নিয়েছিলেন শ্রমজীবী সাংবাদিকদের প্রিয়নেতা আলতাফ মাহমুদ। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আজ সত্য-অসত্য অনেক কথাই শুনতে পাওয়া যায়। অনৈতিকতা, স্বার্থপরতা, লোভ— আলতাফ মাহমুদকে এসব কখনোই স্পর্শ করতে পারেনি। ত্যাগ, নিষ্ঠা মাধুর্যে আলতাফ ছিলেন সবার প্রিয় এক নেতা। আমি খবর ছেড়ে চলে যাই দৈনিক রূপালীতে। অতঃপর চলে আসি নিউইয়র্কের প্রবাস জীবনে। দীর্ঘদিন সরাসরি যোগাযোগ ছিল না।

কিন্তু নিউইয়র্কে যখনই বাংলাদেশ থেকে আগত কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে দেখা হতো কিংবা টেলিফোনে কোনো সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে কথা হলে সহকর্মী হিসেবে আবু তাহের এবং আলতাফ মাহমুদের খবর সবসময় নেওয়ার চেষ্টা করেছি। গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম সফরসঙ্গী হয়ে নিউইয়র্ক এসেছিলেন ইকবাল সোবহান চৌধুরী, আলতাফ মাহমুদ, আবদুল জলিল ভূঁইয়া, প্রণব সাহা। তাদের সম্মানে জ্যাকসন হাইটসে ছোট একটি পার্টির আয়োজন করেছিলাম দাউদ ভূঁইয়া, শরীফ সাহাবুদ্দিন এবং আমি মিলে। সেখানেও অনেক কথা হয় আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে। দেশে যতবার গিয়েছি তার সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, কুশল বিনিময় হয়েছে। আলতাফ মাহমুদ এর আগেও একবার হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। এবার অসুস্থ হওয়ার সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় তাহের ভাই, মনোজের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। কিন্তু দুজনের কারও সঙ্গেই সংযোগ হয় না। অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, বন্ধু মোমেনীন এবং এশিয়ান টিভির প্রধান নির্বাহী মঞ্জুরুল ইসলামের কাছে টেলিফোন করে খবর পাই তার সফল অপারেশন হয়েছে। ডাক্তাররা আশা করছেন এখন তিনি আস্তে আস্তে সুস্থ  হয়ে উঠবেন। অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, ২৩ জানুয়ারি শনিবার রাত ১১টার দিকে সাংবাদিক বন্ধু দাউদ ভূঁইয়ার সঙ্গে আলতাফ মাহমুদের অসুস্থতা নিয়ে কথা বলে টেলিফোন রেখে দেওয়ার ‘মুহূর্তেই আবার দাউদ ভূঁইয়ার টেলিফোন। জানালেন মর্মান্তিক সংবাদটি— আলতাফ মাহমুদ নেই। টিভি খোলেন, দেখতে পাবেন স্ক্রলে দুঃসংবাদটি।’ বারবার স্ক্রলে দেখছিলাম। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। এমন একজন নেতা এত দ্রুত কীভাবে চলে যান, এত অনুরাগী ফেলে রেখে? কী এমন তাড়া, কী এত অভিমান? প্রিয়তমা স্ত্রী, প্রিয় সন্তান, স্বজনদের সবাইকে কেন এমন করে কাঁদিয়ে অসময়ে চলে যাওয়া? চলে যাওয়ার মতো তার বয়সও হয়েছিল না। প্রিয় নেতা, আপনি তো জানেন, যাদের বুকে ভালোবাসা থাকে, তাদের বুকেই জমে থাকে অপার শোক। আপনার অসময়ে চলে যাওয়ায় সেই ভালোবাসার মানুষগুলোর শোক এখন বাংলার আকাশ-বাতাসজুড়ে। ২৪ জানুয়ারি টেলিভিশনের পর্দায় প্রেসক্লাবে তার জানাজা এবং হেলিকপ্টারে লাশ পটুয়াখালীর গলাচিপায় তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে চোখের জলে মনে হচ্ছিল, এই তো সেদিন আমরা সবাই মিলে কোলাহল-কলরবে মেতে ছিলাম। আজ সেখানে নেই আওয়াল ভাই, কবি শাহনূর খান, কাজী জাহিদুল ইসলাম, সুনীল গায়েন। সবার নেতা আলতাফ মাহমুদও চলে গেলেন। পেছনে স্বজনদের হাহাকার, আহাজারি, চোখের জল, যেতে নাহি দেব— বুক ফাটা আর্তনাদ, কিছুই তাদের ফেরাতে পারল না। সব মানুষকেই চলে যেতে হবে। আলতাফ তার নিজের গড়া সংসারে, তার প্রিয় কর্মপরিসর এবং সর্বোপরি পেশাদারিত্বের সংগঠনে যে শূন্যতা রেখে গেলেন, সে শূন্যতা পূরণ করবে কে, কতদিনে? তার মতো সহজ-সরল, সত্-সাহসী নেতা আমরা আবার কবে পাব কে জানে! আমরা কি কেউ আলতাফ মাহমুদকে অনুসরণ করতে চাইব? আমরা কি আলতাফকে ভুলে যাব, নাকি তার আদর্শ অনুসরণের মধ্য দিয়ে তাকে স্মরণে রাখব? আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী-সন্তানদের সান্ত্বনা দেওয়ার সাধ্য আমার নেই। স্রষ্টা তাদের সান্ত্বনা লাভের শক্তি জোগাক। আলতাফ মাহমুদের রুহের মাগফিরাত কামনা করি। 

লেখক :  প্রধান সম্পাদক ‘ঠিকানা’, নিউইয়র্ক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর