বুধবার, ৯ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে যুদ্ধের দামামা

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে যুদ্ধের দামামা

মার্চ মাস বাংলাদেশ ও ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রমনা ময়দানে লাখ লাখ মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন— ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তার ৪৫ বছর পরে পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে থাকবে তাও অপরিহার্য। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের জনগণ ২০১৬-র মার্চ মাসে মাঠে নেমে পড়েছেন মুক্তি সংগ্রামের জন্য।  সন্ত্রাস এবং আকাশছোঁয়া দুর্নীতির হাত থেকে মুক্তি চাইছেন। আর এই মুক্তির উদ্যোগ নিয়েছেন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দেব, বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। অপরদিকে কংগ্রেসের পক্ষে মুক্তি সংগ্রামের আসরে নেমেছেন স্বয়ং সোনিয়া গান্ধী। তার সঙ্গে একই সুরে সুর মিলিয়ে আসরে আছেন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা সোমেন মিত্র, সংসদ সদস্য আবু হাসেম খান চৌধুরী, আবদুল মান্নান, সর্দার আমজাদ আলি এবং সংসদ সদস্য প্রদীপ ভট্টাচার্য।

তৃণমূলের মমতা ক্ষমতায় আসার আড়াই বছরের মাথায় কেন্দ্রীয় কমিটির দাপুটে নেতা গৌতম দেব দিল্লিতে গিয়ে আবু হাসেম খান চৌধুরীকে নিয়ে কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন।

একসঙ্গে লড়াই করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আড়াই বছর পর সে সময় এসেছে। নির্বাচন। সিপিএম ও কংগ্রেস দুই দলের সমর্থকরা একসঙ্গে আওয়াজ তুলেছেন মা-মাটি-মানুষের বঙ্গেশ্বরীকে হটান। বাংলাকে বাঁচান।

সেদিন বাংলাদেশে রক্ত বইয়ে দিয়েছিল খান সেনারা। আর এই বাংলায় এখন তৃণমূল কংগ্রেস মেতেছে খুনের খেলায়। কেন মমতার হাত থেকে মুক্তি চাইছেন? গত ৫ বছরে এমন একটি দিন যায়নি যেখানে কংগ্রেস বা বামপন্থিরা খুন হয়নি। রেহাই পায়নি তৃণমূলীরাও। সুতরাং তৃণমূলেরও একটা অংশ চাইছে শাসন থেকে তৃণমূলের অবসান।

বেশ কয়েক বছর ধরেই মমতা সংখ্যালঘুদের ধোঁকা দিয়ে চলেছেন। হঠাৎ দেখা গেল তার সেই একদা দোসর ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকী সংবাদ সম্মেলন বৈঠক করে ফাঁস করে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যাবতীয় ধোঁকাবাজি। তিনি বলেছেন, মমতা এমনকি দক্ষিণপন্থি দলগুলোর কথা বলে তাদের চাপে রাখারও চেষ্টা করছেন। ত্বহা বলেছেন, তাতে আমরা ভয় পাই না। আমরা জাতীয়তাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে ছিলাম, আছি এবং থাকব। তার এই ঘোষণার পরই ফুরফুরা শরিফে ছুটে যান মমতার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন। কিন্তু সেখানকার কেউই মমতার দূতদের সঙ্গে দেখা করেননি।

আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে ইতিমধ্যেই ১০০ কোম্পানি নিরাপত্তা বাহিনী কলকাতার স্পর্শকাতর এলাকাগুলোতে টহল দিচ্ছে। তাতেই ভয় পেয়ে মমতার দল জোট নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াতে শুরু করেছে। আর তার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করছেন। বলছেন জোট নয়, ঘোঁট পাকাচ্ছে বিরোধীরা। কিন্তু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন তৈরি হচ্ছে বিরোধী জোট। কারণ বাংলার মানুষ চাইছেন দুর্নীতিমুক্ত রাজ্য। গত পাঁচ বছরে তৃণমূলের অপশাসন থেকে মুক্তি চায় তারা। তাদের প্রতিরোধের সামনে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে তৃণমূলের যাবতীয় ছেঁদো যুক্তি।

ইতিহাসবিদ তরুণ রায়চৌধুরীর আত্মজীবনীর সেই চরিত্রটির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আত্মীয়র ছেলে বিচারপতি হয়েছে কিন্তু সেই বৃদ্ধ তা কিছুতেই মেনে নেবে না। আরে না না ও জজ হয়েছে না ছাই- কোর্টের কেরানি। যখন প্রমাণ দেওয়া গেল, না জজই হয়েছে তখন বেজার মুখে বৃদ্ধের বিলাপ জজ হোক আর যাই হোক মাইনে পায় না।

জোট নিয়ে ঠিক এ ধরনের বিলাপই শোনা যাবে একটু কান পাতলে। মমতা বলছেন, যাদের ৩৫ হাজার কর্মী বামেরা খুন করেছে (তালিকা দিতে বললেই বেমালুম চুপ!) তাদের সঙ্গে জোট? দেখুন না কী হয়! তার কথার সূত্র ধরে বাকিরা বলতে শুরু করেছেন, যারা দেয়ালে দেয়ালে কাটা হাত এঁকেছিল তাদের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট কোনোমতেই টিকবে না। সিপিআই (এম)-এর ভোটাররাই বা কোন আক্কেলে ‘চিরশত্রু’ কংগ্রেসের কাটা হাতে ভোট দিতে যাবে?

মমতাপন্থিদের এসব দুশ্চিন্তা বা উদ্বেল নিতান্ত অমূলক। জোট হচ্ছেই এবং এই জোট হবে বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে। জোটের সেই ভিত্তি ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে আছে। দুই পক্ষের নেতারা সেই ভিত্তির কথা মোটামুটি জানেন এবং অবাস্তব-অযৌক্তিক জায়গা ছেড়ে সেই বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েই তারা অঙ্ক কষছেন। একে একে দেখে নেওয়া যাক জোটের সেই বাস্তব ভিত্তিটা ঠিক কী?

 ১৯৮৭ সালে মোটামুটি সবাই ধরে নিয়েছিলেন এবার বামফ্রন্ট গেল। রাজীব গান্ধীও স্থির নিশ্চিত ছিলেন রাজ্যে বামেদের এবার ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে। কিন্তু তৎকালীন অবিভক্ত কংগ্রেস হাজার চেষ্টার করেও ৮৬টির বেশি আসন জোটাতে পারেনি। বাম আমলে কংগ্রেসের সেটাই সর্বোচ্চ প্রাপ্তি। ২০০১-এ তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে কংগ্রেস জোট করেও সেই সংখ্যা ছুঁতে পারেনি। অতএব ধরে নেওয়া যায় সর্বশক্তি দিয়ে কংগ্রেস লড়াই করলেও এর বেশি আসনে লড়াইয়ের দাবি তারা করতে পারেন না। যদিওবা দাবি করেন তবুও আলোচনায় সংখ্যাটা এর বেশি তোলার পক্ষে কোনো যুক্তি খাড়া করা কঠিন।

বামফ্রন্টের স্বর্ণযুগের কথা না হয় বাদ দিলাম, গত লোকসভা নির্বাচনে এককভাবে লড়াই করে কংগ্রেস জিতেছিল ২৮টি বিধানসভা আসনে। বামফ্রন্টও সমসংখ্যক আসন পেয়েছিল কিন্তু বামফ্রন্টের প্রাপ্ত ভোট ছিল কংগ্রেসের তিনগুণ ২৯.৮ শতাংশ। শুধু তাই নয়, অধিকাংশ আসনে বামফ্রন্টই ছিল দ্বিতীয় স্থানে। সংখ্যাটি দ্বিশতাধিক। পক্ষান্তরে কংগ্রেস দ্বিতীয় স্থানে ছিল মাত্র ১৬টি আসনে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক নম্বরে ছিল বামেরা। অর্থাৎ শক্তি ভারসাম্যের তুলনা করলে বোঝা যাবে উত্তর দিনাজপুর, মালদা ও মুর্শিদাবাদের আসন বাদ দিলে রাজ্যের অন্যত্র কংগ্রেসের শক্তি খুবই সীমিত। দক্ষিণবঙ্গের কোনো জেলাতেই কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোট ১০ শতাংশ ছুঁতে পারেনি। কাজেই জোটের আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে কংগ্রেস অবশ্যই প্রাপ্ত ভোটের শতাংশের হিসাব ভুলে যেতেই চাইবে। ভুলে যেতে চাইবে এগিয়ে থাকা আসন আর দ্বিতীয় স্থানে থাকা আসনের যোগফল, কারণ সংখ্যাটা ৫০-এও ছোঁবে না। থমকে দাঁড়াবে ৪৪-এ। তাহলে আসন বণ্টনের বাস্তব ভিত্তি কী হতে পারে? সেটা হলো জেলায় বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের মোট প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে আসন সংখ্যা নির্দিষ্ট করা।

জেলাওয়ারি এই সূত্রের পাশাপাশি কংগ্রেসের কিছু বাড়তি দাবি থাকবেই। সেটা আশ্চর্যেরও নয়। সবাই চাইবে এই পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ আসন বের করে নিতে। সেটা মাথায় রেখে কংগ্রেসের চাহিদা দাঁড়াচ্ছে ৯০ থেকে ১০০টি আসন। জেলাওয়ারি প্রাপ্ত ভোটের শতাংশের কথা বাদ রেখে কংগ্রেস বাড়তি কিছু আসন চাইতে পারে। তবে তা নিয়ে বাড়তি জেদ করতে কংগ্রেস নেতৃত্ব রাজি নয়। কারণ তারা বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে যথেষ্টই ওয়াকিবহাল।

গোড়ায় সিপিআই (এম) নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করেছে। পরে সমগ্র বামফ্রন্টেও জোটের আসন সংখ্যা নির্ণয়ের বাস্তবভিত্তি নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা হয়েছে। তাতে জেলাওয়ারি তথ্যের বিচারে কংগ্রেসের জন্য আসন নির্দিষ্ট করা হয়েছে ৬৫টি।

এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি আসন উত্তর দিনাজপুর, মালদা ও মুর্শিদাবাদ জেলায়। বাকি জেলাগুলোতে প্রাপ্ত ভোটের শতাংশের নিরিখে আসন দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। যেমন কলকাতার ১১টি আসনের মধ্যে কংগ্রেসের জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে দুটি। সেগুলো হলো— চৌরঙ্গি ও কলকাতা বন্দর। কংগ্রেস রাজি। তবে তারা বাড়তি হিসেবে বালিগঞ্জ কেন্দ্রটিও চাইছে।

জোটের এই বাস্তব ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে দুপক্ষই ১০০ শতাংশ বিশ্বাস করেন— শেষ পর্যন্ত দরকষাকষির কোনো প্রয়োজনই পড়বে না। অযৌক্তিক দাবি পেশ করে কেউ পাকা ঘুঁটি কাঁচিয়ে দেওয়ার পরিস্থিতিতে নেই, তার কারণ কে কোন প্রতীকে জিতছে সেটা বড় কথা নয়। আসল কথা হলো— তৃণমূল কংগ্রেসকে হারাও। রাজ্যে রাজ্যে নির্বাচনী জোট গড়ার ক্ষেত্রে মাঝেমধ্যে দেখা যায় কিছু আসনে বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই হচ্ছে। এবার কিন্তু সে সুযোগও কেউ দেবেন না। কংগ্রেস বা বামফ্রন্ট চাইছে জোট নিয়ে যেন সাধারণ মানুষের মধ্যে ধোঁয়াশা সৃষ্টি না হয়। সবার মধ্যে যেন সদর্থক বার্তা যায়।

নিন্দুকের বাহানার কোনো শেষ নেই। এখনো জোট ঘোষণা হলো না, নির্বাচনের ফলাফল বের হলো না, এর মধ্যে অনেকে বলতে শুরু করেছেন জিতলেই হলো? বামেরা কিছুতেই কংগ্রেসের সঙ্গে মন্ত্রিসভায় যাবে না। তাহলে একসঙ্গে নির্বাচনে লড়ে কি লাভ?

কংগ্রেসের নেতৃত্ব বেশ ভালোমতো বুঝে গেছেন বামেরা আর যাই হোক তৃণমূলের মতো কংগ্রেসকে গ্রাস করে শক্তিশালী হওয়ার চেষ্টা করবে না। ফলে যৌথ মন্ত্রিসভা গঠিত হলে পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝির কোনো জায়গা থাকবে না। দ্বিতীয়ত, দুই পক্ষই জানে, জোটকে দীর্ঘমেয়াদি না করলে তার থেকে ফায়দা তোলা মুশকিল। কংগ্রেস জানে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একা চললে তাদের কোনো স্থান হবে না। আবার বামেরাও বোঝে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা কীভাবে চালাতে হয়। এ রাজ্যে দু-দুবার তারাই কংগ্রেসী ঘরানার নেতা অজয় মুখোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রী করে সরকার চালিয়েছে। কেরলে এলডিএফ সরকারেও বহু জাতীয়তাবাদী শক্তিকে শরিক করেছে। দুই পক্ষের এই বোধ থাকায় জোট এবং সরকার শক্তিশালী হতে বাধ্য।  কোয়ালিশন ক্ষমতায় এলে কংগ্রেস চিরকালের মতো বুঝে যাবে বামেরাই তাদের অপরিহার্য বন্ধু। কারণ দল ভাঙানোর খেলাটা তাদের জানা নেই।

     লেখক : প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর