বুধবার, ২৩ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

সব অর্জন বন্দরে বিসর্জন

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

সব অর্জন বন্দরে বিসর্জন

নিম্ন, মধ্য বা উচ্চ আয়ের যে কোনো দেশই হোক না কেন, তার আর্থিক উন্নতিতে বিশাল ভূমিকা রাখে দেশের সমুদ্র, স্থল এবং বিমানবন্দর। ভৌগোলিক বিবেচনায় বাংলাদেশ এশীয় অঞ্চলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ। আমাদের যেমন রয়েছে বিশ্বে অতি পরিচিত সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও মংলা তেমনি রয়েছে আমাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। যেহেতু ১৯৭০ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত আমি চট্টগ্রামে ছিলাম, তাই চট্টগ্রাম বন্দর সম্বন্ধে আমার অনেক মৌখিক, গাল্পিক এবং মুখরোচক ধারণা রয়েছে। আমার অনেক আত্মীয়স্বজন যেমন চট্টগ্রামে আছে, তেমনি কুমিল্লার জনগোষ্ঠী অবস্থানের দিক দিয়ে নোয়াখালীর পরে। তারপরে ছিল পাবনার জনগণ।  জানি না বর্তমানে নাগরিক বিন্যাস জেলাওয়ারি কি হবে?

১৯৭০ সালে প্রথম বর্ষ এমবিবিএসের ছাত্র। আমার এক আত্মীয় হোস্টেলে এলেন, তার মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ দিতে। মেয়েটা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। যে ছেলের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে, সে কী করে জিজ্ঞেস করলে মেয়ের বাবার জবাব, বন্দরে কাজ করে। বিশদ জিজ্ঞেস করলে বললেন কোনো সরকারি চাকরি না। তবে এমনিতে কাজ করে। মাসে এক হাজার টাকার উপরে আয়। তখন একজন ডাক্তারের বেতন ৩৭০ টাকা আমি যেমনি অবাক হলাম, তেমনি চিন্তিত। বিয়ের পরে জামাইবাবু প্রায়ই আমার হোস্টেলে আসতেন, আলাপ-আলোচনায় যা বুঝলাম অনেক দুনম্বরি থেকে শুরু, দশ নম্বরি কাজ পর্যন্ত চলে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাষ্ট্র অথবা আমদানি বা রপ্তানিকারকরা।

এই সমুদ্র বন্দরটি অনেক সময় সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। যা দেশ এবং জনগণের জন্য দুর্নাম শুধু ডেকে আনেনি, বিপর্যয়ও এনেছে। একাত্তরে যুদ্ধজাহাজ, বাবরের অস্ত্র খালাস, যা জনগণ প্রতিরোধ করেছিলেন শুরুতে। সুনাম শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় হয়েছিল যখন নৌ কমান্ডোরা একের পর এক পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজগুলোকে মাইন দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিল। তারপরে যতবারই শিরোনাম হয়েছে, তা শুধু দুর্নাম বয়ে এনেছে। মাদক পাচারের শিরোনাম হয়েছে। তেজস্ক্রিয় দুধ আমদানির শিরোনাম হয়েছে। সর্বশেষ কোকেন পাচারের ঘটনা জাতিকে বেদনাহত করেছে। প্রতিবেশীকে আহত করেছে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে ভারতীয় মুদ্রা পাচারের ঘটনা। এমনকি দশ ট্রাক অস্ত্র পাচারও। এই বন্দর দিয়ে মাদক পাচারও একটা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনার পরে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তো গরুর দুধ পান সম্পূর্ণ বর্জন করা হয়েছিল। তাদের প্রচেষ্টা ছিল, দুধকে গুঁড়ো দুধে রূপান্তরিত করে যদি তেজস্ক্রিয়তা কমানো যায়, না সর্বশেষ তাও হলো না। দেখা গেল প্রায় সমপরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা গুঁড়ো দুধেও রয়ে গেছে। তারপর ৫০ থেকে ১০০ ফিট মাটির গর্তের নিচে পুঁতে রেখে দেখা গেল তার নিকটবর্তী জলাশয়ে একই পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা বিদ্যমান। গভীর সমুদ্রে ফেলে দিয়ে বিশ্বব্যাপী দুর্যোগ আনতে তাদের বিবেক সায় দিল না। ইতিমধ্যে তৃতীয় বিশ্বের কিছু হৃদয়বান ধনাঢ্য ব্যক্তির সহানুভূতি তাদের বিপদের হাত থেকে রক্ষা করল। তৃতীয় বিশ্বের সেই হৃদয়বান ব্যক্তিরা ওই গুঁড়ো দুধ বিনা পয়সায় আমদানি করলেন। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে আসার পরে যখন তা শনাক্ত হলো, তখন কিছু দিন সংবাদপত্রে আলোচিত এবং জনগণ আলোড়িত হলেন। অবশেষে সবাই নিশ্চুপ। আমার প্রশ্ন, ওই গুঁড়ো দুধ কোথায় গেল। সবই আমাদের দেশে বাজারজাত হলো। উপহার দিয়ে বিক্রি হলো অর্থাৎ ১ প্যাকেট কিনলে বাটি পাবেন, ২ প্যাকেটে জগ ইত্যাদি। যারা আমদানি করেছেন তাদের ধারণা, তাদের পরিবার যেহেতু এসব ভোগ করবেন না বা খাবেন না, সুতরাং তাদের কিছুই হবে না। তারা জানেন না! এসব দুধ আমরা যারা খেয়ে পায়খানা প্রস্রাব করব, সেখানেও তেজস্ক্রিয়তা নিঃস্বরিত হবে এবং সেই মাটির উৎপাদিত শস্য এবং জলাশয়ে মিশে যাওয়া পানি যতই Filter বা বোতলজাত করি না কেন, তাতেও আপনারা রেহাই পাবেন না। যার ফলাফল আমি একজন ক্ষুদ্র চিকিৎসক হিসেবে এখনই দেখতে পাচ্ছি। যা হলো থাইরয়েড গ্রন্থির দুরারোগ্য ক্যান্সার। তেজস্ক্রিয় পদার্থের সঙ্গে এই ক্যান্সারের আছে নিবিড় সম্পর্ক।

এবার ফিরে আসি বিমানবন্দরের দিকে। দেশের সেরা আউলিয়ার নামে নামাঙ্কিত আমাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। একে নিয়ে সোনা চোরাচালান, মুদ্রা পাচার, ওষুধ চোরাচালান ছাড়াও যাত্রী হয়রানি, ব্যাগেজ কাটা বা চুরির অনেক অভিযোগ আছে। দেশ-বিদেশ থেকে আগত সব যাত্রীর একটাই অভিযোগ, লাগেজ নির্দিষ্ট Belt-এ আসতে কখনো দুই ঘণ্টার অধিক সময় লাগে।

বাস্তবে তার প্রমাণ পেলাম ২৬ ডিসেম্বর সকালে সস্ত্রীক কক্সবাজার থেকে ফিরে এসে ১১টায় বিমানবন্দরে নেমে। ছোট একটি বিমানের ফ্লাইটে যে অল্পস্বল্প লাগেজ তা আসতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগল। বিমানের লোকজন এসে সংযোগ ফ্লাইটে অন্যত্র বিশেষ করে সিলেট যাবেন এক ভদ্রলোকের রোষানলে পড়লেন। তিনি যতই অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেন ঠিক ততই ওই লোকটি ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন, কারণ তিনি সিলেটগামী ফ্লাইট মিস করতে চলছেন। বিমানবন্দরের নাম নিয়েও তিনি ক্ষোভ ঝাড়লেন, কটাক্ষ করলেন। পীর আউলিয়ার পরিবর্তে অন্য কোনো নাম রাখার পরামর্শ দিলেন। ভদ্রলোকের কোনো দোষ আছে বলে আমার মনে হয়নি। বিমানের ট্রাফিক, ফ্লাইটে চলমান অবস্থার সেবা প্রদান, খাবারের গুণগতমান কোনোটাই আমার কাছে খারাপ তো মনে হয়নি বরং অন্যান্য অনেক এয়ারলাইন্সের চেয়েও অতি উত্তম। শুধু Luggage handling মানুষের যন্ত্রণা ও বিড়ম্বনার কারণ।

দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা হলো, আমার কন্যা, নাতি-নাতনিসহ বাংলাদেশ বিমানে সিঙ্গাপুর থেকে গত ২ জানুয়ারি ২০১৬ সন্ধ্যা ৬-১৫ দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামলো। সাধারণত আমি ভিআইপি ব্যবহার করি না। আমার মেয়েও আমাকে আনতে যেতে বলে না। যেহেতু সে নিজে এবং বাচ্চা দুটো অসুস্থ, তাই আমাকে যেতে বলল। আমি যথারীতি শনিবারের চেম্বার সংক্ষিপ্ত করে ঠিক সময়ের আগেই সেখানে পৌঁছলাম। ইতিমধ্যে আমার দুজন অতি আপনজন তাদের আনার জন্য হাজির হলেন। তাদের গ্রহণ করার পরে দেখলাম সত্যিই অসুস্থ, তাই গাড়িতে তাদের পাঠিয়ে দিয়ে আমি লাগেজ সংগ্রহের জন্য অপেক্ষারত ছিলাম। আড়াই ঘণ্টা পরে লাগেজ নিয়ে যখন সালাহউদ্দীন আসল তখন একটি গাড়িতে করে রওনা দিলাম। রাস্তার যানজটের জন্য আমি বারিধারায় নেমে গেলে মালামাল মেয়ের ধানমন্ডির বাসায় পৌঁছে রাত্র সাড়ে ১১টায়। এই বিড়ম্বনার কি সমাধান নেই?

বিমানবন্দর বা সমুদ্রবন্দর এই দুই জায়গাতে কিন্তু ছাত্রলীগ বা যুবলীগ কাজ করে না। এসব সংরক্ষিত এলাকায় কারও প্রবেশ নেই। সুযোগ পেলে এখানেও ঢালাওভাবে ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে দায়ী করা হতো। আমি বলছি না এরা ধোয়া তুলসীপাতা। যেই কর্মচারীরা এই দুই জায়গায় কাজ করেন তারা কি এদেশের নাগরিক নয়? তাদের কি আইনের আওতায় আনা যায় না? দরকার হলে তাদের স্থলে সেনাবাহিনীর একটি করে প্লাটুন (বদলিযোগ্য) এসব জায়গায় পদায়ন করা যেতে পারে। আমার বিশ্বাস তখনই এ বিড়ম্বনার সমাধান মিলবে এবং দেশি-বিদেশি সব যাত্রীর কাছে আমাদের সম্মান বাড়বে। অতি সম্প্রতি অত্যাধুনিক সেরা দুটি বিমান আমাদের জাতীয় বিমান বহরে যোগ হলো।  এখনো যদি আমরা নিজেদের সুনাম তুলে ধরতে না পারি, তাহলে আর কি করলে পারা যাবে? পাঠক আমি জানতে চাই। বিমানের খাবার মান, ক্রু সেবা (অর্থাৎ উড্ডয়নকালীন বিমানের সেবা) অন্যান্য সব দিক দিয়ে আমরা পেছনে নই, শুধু ব্যাগেজ হ্যান্ডেলিং একটা বড় যন্ত্রণা।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর