মঙ্গলবার, ২৯ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

রাজকোষে সম্পদ বৃদ্ধি, কার কৃতিত্ব?

ড. ইফতেখার হোসেন

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয়  কোষাগারে ডলারের পরিমাণ ২৮ বিলিয়ন ছাড়িয়ে গেল। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলের অহংবোধের কমতি নেই। রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা ফরেন রিজার্ভের পরিমাণ বৃদ্ধিতে সবাই এর কৃতিত্ব নেওয়ার প্রতিযোগিতায় উঠেপড়ে লেগেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদায়ী গভর্নর এটাকেই তার সর্বোচ্চ কৃতিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। রাজনৈতিক মহলের উচ্চ পর্যায়ের নেতারাও এ সাফল্যের কৃতিত্বের দাবিদার হতে উদগ্রীব। সম্প্রতি এ রাজকোষের ৮ কোটি ডলার ফিলিপাইনের জুয়ার আসর ঘুরে কর্পূরের মতো উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সময় এসেছে বিষয়টি একটু খতিয়ে দেখার।

প্রথমেই প্রশ্ন জাগে রাজকোষ স্ফীত হওয়াটা আদৌ কোনো গৌরবের ব্যাপার কিনা। অর্থনীতির ভাষায় বৈদেশিক মুদ্রার রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে বলা হয় ‘উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অর্থ (হাই পাওয়ার্ড মানি)’, এ কারণে যে এর বিনিময়ে এই অর্থের সমপরিমাণের চেয়েও কয়েক গুণ বেশি মুদ্রা দেশীয় বাজারে সরবরাহ করার সুযোগ থাকে। বাংলাদেশের রাজকোষের সম্পদ মূলত ডলারে দেশ-বিদেশের ভল্টে বা অ্যাকাউন্টে জমা থাকে। এটি অলস অর্থ, অলস অর্থের বিনিয়োগপ্রাপ্তি স্বল্প। এ অর্থ বিদেশেও উত্পাদন খাতে বিনিয়োগের প্রচলন নেই। প্রশ্ন জাগতে পারে অলস অর্থ সচল বা উত্পাদনে বিনিয়োগকৃত অর্থের চেয়ে মূল্যবান হতে পারে কী করে? প্রশ্নটি সংগত। পকেটভারী কাউকে দেখলেই কি ধরে নিতে হবে লোকটি বিত্তবান? বিত্তবান মানুষের পকেট তো সংগত কারণেই হালকা থাকে, তার পুঁজির বেশির ভাগটাই সচল থাকে বিনিয়োগে! নাদুসনুদুস আলালের ঘরের নন্দলাল দুলাল হলেই যে তার ‘স্বাস্থ্য’ গরিব ঘরের লিকলিকে ছেলেটির চেয়ে ভালো হবে তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই! দেশীয় অর্থনীতির স্বাস্থ্যের পরিমাপ রাজকোষের সম্পদ দিয়ে করার চেষ্টাটা ভ্রান্তিপ্রসূত। বাংলাদেশের রাজকোষের মূল উৎস কী? বাংলাদেশ ব্যাংক কি নিজ থেকে ডলার ছাপিয়ে এটা তৈরি করেছে? তার তো কোনো সুযোগ নেই। রিজার্ভের মূল উৎস অভিবাসী শ্রমিকের কষ্টার্জিত অর্থ। সমাজ-সংসার দূরে রেখে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যারা মরুভূমির কড়া রোদে অর্থ উপার্জন করছেন, জীবন বাজি রেখে ইউরোপ-এশিয়ার সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কর্মসংস্থান খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তারাই দেশে অর্থ পাঠান; ফেলে যাওয়া পরিবার-পরিজনের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করার প্রত্যাশায়, অনিশ্চিত ভবিষ্যতে সামান্য নিশ্চয়তার হাতছানিতে। ২০১৫ সালে প্রবাসী শ্রমিকদের দেশে পাঠানো অর্থের পরিমাণ ছিল ১৫ বিলিয়ন ডলারেরও অধিক। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অন্য অংশ আসে পোশাকশ্রমিকদের হাড়ভাঙা খাটনিকে পুঁজি করে বিদেশে যে পোশাক রপ্তানি করা হয় তা থেকে। পোশাক খাতের নারী শ্রমিকরা স্বল্প বেতনের শ্রমিকই রয়ে যান, অপুষ্টিতে ভোগেন। এদের তৈরি উদ্বৃত্ত মূল্যের বদৌলতে দেশি-বিদেশি পুঁজিপতি-বণিকরা গড়েন সম্পদের পাহাড়। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা ডলার, ইউরো, রিয়াল আসে বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে। প্রথমত এসব ব্যাংককে সংগৃহীত বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগই জমা দিতে হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে, দেশীয় মুদ্রার বিনিময়ে। এভাবেই স্ফীত হতে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রাষ্ট্রীয় কোষাগার। বাদবাকি অংশের বড় এক পরিমাণও কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে কিনে নেয়। তহবিল হয় অধিকতর স্ফীত। রাজকোষ স্ফীত হওয়ায় সুফলের সঙ্গে আসে কুফল। এটি সমৃদ্ধ হলে বৃদ্ধি পায় দেশের মুদ্রা সরবরাহ। দেখা দেয় মূল্যস্ফীতি। পকেট ভারী হতে থাকলে কেনাবেচা বাড়বে, মূল্য বৃদ্ধি ঘটবে, এটা তো স্বাভাবিক। বাংলাদেশের স্ফীত তহবিলের পেছনে কাজ করছে বৈশ্বিক অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি। বাজারে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিম্নমুখী, জ্বালানি তেলের বাজারদর এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। এতে আমদানি ব্যয় কমেছে অস্বাভাবিক মাত্রায়। দেশীয় অর্থনীতিতে বিনিয়োগ স্থবিরতা দেখা দেওয়ায় মূলধনী কলকব্জার আমদানি কমেছে, এতেও সাশ্রয়ী হয়েছে আমদানি ব্যয়। অন্য পক্ষে স্বল্প মজুরির সুবিধা কাজে লাগিয়ে বেড়ে চলেছে পোশাক খাতের রপ্তানি। আমদানি-রপ্তানির এই ঘাটতির সুবাদে স্ফীত হয়ে চলেছে রাজকোষ। রাজকোষ বৃদ্ধি পেলে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়, মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা থাকে। মুদ্রাবাজারে ডলারের আধিক্য দেশীয় মুদ্রার মূল্যমানে ঊর্ধ্বমুখী চাপ সৃষ্টি করে। এতে ব্যাহত হয় রপ্তানি বাণিজ্য, এমনকি প্রবৃদ্ধি। এ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ডলার কিনে নিতে থাকে, দেশীয় মুদ্রা এরই ধারাতে অমূল্যায়িত হতে থাকে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক অভ্যন্তরীণ মুদ্রাবাজার থেকে ডলার কিনেছে আড়াই বিলিয়ন, আমাদের হিসাবে আড়াইশ কোটি ডলার। এটাই প্রথা, ইংরেজিতে এ প্রক্রিয়াকে বলে স্টেরিলাইজেশন। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এ প্রথাগত ‘নিষ্ক্রিয়করণের’ কাজটাই করে এসেছে। অথচ বাগাড়ম্বরের অন্ত নেই এই বলে যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকার মূল্যমান অটুট রেখেছে। এখানেও কৃতিত্ব নেওয়ার অহেতুক প্রতিযোগিতা! রাজকোষে সম্পদ বৃদ্ধির কারণে দেশীয় অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে গেলে সেটা নিয়ন্ত্রণে রাখার একটি পন্থা হলো জনগণের সঞ্চয় থেকে রাষ্ট্রীয় ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া। নানাবিধ বন্ড কিংবা সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে তা করা যেতে পারে। এ দেশেও চড়া সুদের বিনিময়ে সেটাই করা হয়েছে। এতে বাণিজ্যিক খাতে বেড়ে গেছে সুদের হার। ব্যাহত হয়েছে দেশীয় বিনিয়োগ। বিদায়ী গভর্নর মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাটাকেও তার অন্যতম কৃতিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কূপমণ্ডূকরা তাকে এর কৃতিত্ব দিতে দ্বিধা করবে না। কিন্তু  কুয়া থেকে মাথা তুললেই ব্যাপারটা খোলাসা হয়ে যাবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বিবেচনা করি। মালদ্বীপ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভারত, ভুটান— প্রতিটি দেশেই বর্তমান মুদ্রাস্ফীতি বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতির চেয়ে কম! বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারকদের পৃথক দক্ষতাটা তাহলে কোথায় থাকছে? মোদ্দা কথা, রাজকোষ ভারী থাকার অর্থ যে অর্থনীতিতে রমরমা অবস্থা, সে রকমটি নয়। আর আমাদের রাজকোষ বৃদ্ধির কৃতিত্বের দাবি নিয়ে যে প্রতিযোগিতা চলছে সেটাও হাস্যকর। কৃতিত্ব দাবি করছে সবাই অথচ প্রকৃত দাবিদাররাই আলোচনায় রয়েছেন অনুপস্থিত! পোশাক খাতের বঞ্চিত শ্রমিক আর অভিবাসী বাঙালিরাই এর আসল দাবিদার। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে কবিগুরুর বিখ্যাত সেই দুই পঙিক্ত, ‘রথ বলে আমি দেব, পথ বলে আমি, মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসে অন্তর্যামী’।

লেখক : জাতিসংঘের সাবেক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ

সর্বশেষ খবর