মঙ্গলবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

মুক্তিযোদ্ধারা রিকশা চালায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা গাড়ি চড়ে

মেজর জিল্লুর রহমান (অব.)

মুক্তিযোদ্ধারা রিকশা চালায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা গাড়ি চড়ে

কয়েক দিন আগে আরটিভি সংবাদে সোনারগাঁয়ের ঊনসত্তর বছর বয়সী গোলাম মোস্তফাকে রিকশা চালাতে দেখে আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। স্বাধীন দেশে এমন হওয়ার কথা ছিল না। আমরা তো অকৃতজ্ঞ জাতি নই। গত ৪৫ বছরে দেশের অনেক উন্নতি হয়েছে। এ উন্নতির বুনিয়াদ মুক্তিযোদ্ধারাই সৃষ্টি করেছেন। তাদের কল্যাণেই আমাদের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। অভাব দূর হয়েছে। মঙ্গা, অভাব, মহাজনী দাদনের ব্যবসা প্রায় বিলুপ্ত। পোশাক-আশাক, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি— সব ক্ষেত্রে আমরা অভাবনীয় উন্নতি করেছি গত কয়েক বছরে। দেশ স্বাধীন করে এমন চাঁদের হাট যারা বসিয়েছেন সেই একাত্তরের একজন মুক্তিযোদ্ধাকে রিকশা চালাতে হবে, এর চেয়ে অপমান আর কী থাকতে পারে। বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার আমার এক প্রিয় জ্যেষ্ঠ সহকর্মী। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে তিনি অসাধারণ মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন পদে পদে। পাকিস্তানিদেরও বুঝিয়ে দিয়েছেন তার প্রতিভা, মেধা, যোগ্যতা অসাধারণ। পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে তিনি মেধা তালিকায় স্থান করে নিয়ে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা তার দৃষ্টি এড়ানোর কথা নয়। তিনি নিশ্চয়ই নিজেকে জিজ্ঞাসা করবেন তার দায়িত্ব এখানে কী, এ সংসদ কি শুধু মাতব্বরি করার জন্য, না অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য আছে। গোলাম মোস্তফার এমন দারিদ্র্য কশাঘাতে জর্জরিত জীবনের খবর নেওয়ার কি কেউ নেই? ওই এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার যিনি, তিনি এ ব্যাপারে কী দায়িত্ব পালন করেছেন তাও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা কুড়িগ্রামের জালাল উদ্দিন। আরও করুণ দশা। তার মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। বয়স হয়েছে। কামলা দিয়ে তিন সন্তানের সংসার চালাতে পারেন না। কখনো খেয়ে, কখনো না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। আঞ্চলিক এক কমান্ডারকে দেখলাম নাদুসনুদুস চেহারায় টাই-সুট পরে সাক্ষাৎ দিলেন। বললেন, ‘জালালের নিজস্ব জমি নেই, তাই বাড়িঘর করে দিতে পারিনি। ও খুব কষ্টে আছে।’ তবে কমান্ডারকে দেখে মনে হলো তার কষ্টের বিনিময়ে তিনি দিব্যি ভালো আছেন। মনে হলো তিনি এসব নিয়ে তেমন গরজ দেখানোর সময় পাননি। মন্ত্রী মহোদয়কে নিয়ে নিশ্চিয়ই তার সময় কাটে। যাদের ত্যাগে এই চেয়ারে, তাদের অবজ্ঞা করা আর যাই হোক দায়িত্ববোধের পরিচয় বহন করে না। গোলাম মোস্তফা ও জালাল উদ্দিনের মতো মুক্তিযোদ্ধারা তাদের যৌবনের সোনালি দিনগুলোয় অস্ত্র নিয়ে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। বীরের বেশে ঘরে ফিরেছেন। সেই জাতীয় বীরেরা তাদের স্বাধীন করা দেশে জীবনযুদ্ধে পরাজয়বরণ করবেন, তা কাম্য হতে পারে না। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা পঞ্চম বাহিনীর সদস্য তারা নানা কৌশলে সব সুযোগ-সুবিধা নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, চাকরির কোটা করে চৌদ্দপুরুষ বংশানুক্রমে সরকারি চাকরি নিশ্চিত করছে। সরকারের বড় অফিসাররা, ভুয়া সনদ নিয়ে চাকরির মেয়াদ বাড়িয়েছেন। কিয়ামত পর্যন্ত বেতন বাড়িয়েছেন। স্বঘোষিত পদোন্নতি বাগিয়ে নিয়েছেন। তেলা মাথায় তেল দেওয়া জরুরি নয়। যার মাথায় তেল নেই তাকে দেওয়া জরুরি।

যুদ্ধের সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোর কথা এখনকার উঠতি হাইব্রিড নেতাদের মাথায় আসবে না। একাত্তরের ওই দিনগুলো মনে পড়লে আঁতকে উঠি! বেদেদের মতো আজ এ বাড়ি, কাল ও বাড়ি, পরশু মামাবাড়ি পরিবারসমেত কেমন করে জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি, আমরা জানি আর আল্লাহ জানেন।  যে মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের জন্য স্বস্তিদায়ক জীবন এনে দিয়েছেন সে মুক্তিযোদ্ধারা আজ উপেক্ষিত। আমার বড় মামা প্রয়াত আবুল বাশার মোড়ল প্রখর বুদ্ধিমান ও সফল সংগঠক ছিলেন। আমার এলাকার প্রয়াত কুবের বিশ্বাস, প্রয়াত শেখ জলিল প্রিন্সিপাল, আবু একসঙ্গে রাজনীতি করতেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সরাসরি তাদের যোগাযোগ ছিল। আমার মামারা সে সময় কেউ স্বাধীনতার সংগঠক, কেউ রণাঙ্গনে মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত। মামাবাড়ি ছিল আর এক মরণফাঁদ। কয়েকবার বাড়িঘর লুট, খড়ের গাদা পর্যন্ত জালিয়ে দিয়েছে রাজাকাররা। আব্বা বিয়ের সময় মাকে একটা লেদার সুটকেস দিয়েছিলেন, চকলেট কালার। সেটাই আমাদের জীবনের চরম বিপদের সাথী ছিল। যেখানে পালাতে যেতাম ওটা আমি বহন করতাম। স্বাধীনতার কথা ভাবলে অনেক স্মৃতিজড়িত ওই ফুটো সুটকেস আমাকে আকর্ষণ করে, অনেক ঘটনার সাক্ষী ওই সুটকেস। সুটকেসের মধ্যে গহনা, পুরনো বিয়ের শাড়ি, কিছু হাতখরচ রাখতেন মা। আব্বা কোথায় কেমন আছেন অনেক দিন জানতাম না। সবাই জান বাঁচানোর ফরজ কাজে ব্যস্ত। মামাবাড়ির সামনের ঘরের বারান্দায় বসে থাকতাম। কখনো মানুষজনের কাছে খবর পেতাম রাজাকাররা এদিক আসছে। আমি ওই সুটকেস নিয়ে মা, ভাই-বোন, মামাতো ভাই, খালাতো ভাই-বোনদের সঙ্গে দৌড়ে মামাবাড়ির পেছনে যে বিশাল বাগান ছিল, সেই বাগানের শেষ মাথায় বাড়ির কাজের লোকের কুঁড়েঘরে আশ্রয় নিতাম।

মৃত্যুভয়ে হৃৎপণ্ড ধকধক করে কাঁপত। মামাদের গ্রামে রাজাকারদের অত্যাচার বেড়ে গেল। আমার নানী মাকে বললেন, ‘তুই এখান থেকে চলে যা, আর খায়েরকে নিয়ে যা।’ খায়ের আমার খালাতো ভাই। খায়ের ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তা ছাড়া  ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে এসেছে এবং মামাবাড়ি আশ্রয় নিয়েছে— এমন খবর রাজাকাররা পেয়ে মামাবাড়িতে প্রায়ই অপারেশন চালাত। আমার মা খুব ধৈর্যশীলা ঠাণ্ডা মাথার মানুষ, মা রাজি হলেন। আমরা মামাবাড়ির পেছনের বাগানের ভিতর দিয়ে খালে বাঁধা নৌকায় উঠে লুকিয়ে আমাদের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম।

এমন সময় পেছন থেকে ‘হল্ট’ শব্দ শুনি। খায়ের ভাই দৌড় শুরু করেছে আঁকাবাঁকা মিলিটারি প্রশিক্ষণের ড্রিল, তখন আমি মিলিটারি বুঝি না পেছনে রাজাকার ছুটছে। শুনলাম মা চিৎকার করে বলছে, ‘তোর গায়ের চাদর ফেলে দে।’ খায়ের ভাই চাদর ফেলে দিল। পেছন থেকে গুলি ছুড়ল। লক্ষ্যহীন গুলি, জীবন রক্ষা পেল। আমরা অনেক রাতে আমাদের বাড়িতে এলাম। খাবার নেই, টাকা নেই সবার মুখে কী এক অজানা আতঙ্ক। কেউ জিজ্ঞাসা করছে কেন এলে, দূরে ছিলে ভালো ছিলে।

কর্মজীবনে আমি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হয়েছি। জাতি, দেশ আমাকে অনেক দিয়েছে। কোনো অভাব রাখেনি আমার। আমি জাতির কাছে কৃতজ্ঞ। আজকের আমিও দাঁড়িয়ে আছি মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত, সাহস আর দেশপ্রেমের ওপর। অথচ তারা অবহেলিত থাকবে তাতে আমি কোনোভাবেই সম্মানিত হতে পারি না। সরকারের পক্ষে ঘরে ঘরে খোঁজ নেওয়া মুশকিল বটে কিন্তু  মুক্তিযোদ্ধারাই তো ভুক্তভোগীর পাশে দাঁড়াতে পারে। জাতির  শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সহায়তা শুধু সরকার নয়, যাদের সামর্থ্য আছে তাদের সবার এগিয়ে আসা উচিত। নিজের পকেট ভরার নীতি বাদ দিয়ে সবাই সবার তরে এই নীতিতে চললে এ করুণ সংবাদ জাতিকে দেখতে হতো না। যারা ময়দানে যুদ্ধ করছে তাদের পরিবারের ওপর একাত্তরে নেমে এসেছিল শতাব্দীর ভয়াবহ নির্মম নির্যাতন। এখনো তারা ভোগান্তিতে থাকবে, এটা কি কোনো সভ্য দেশের কৃষ্টি হতে পারে!

মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দিতে হবে একাত্তরের সাহসী ভূমিকার কথা মাথায় রেখে। এখন কে কী করে, কোন দল, কোন মত, কোন পথ— তা বিবেচনার বিষয় হতে পারে না। অন্য দল করলে মুক্তিযোদ্ধা তাকে বলা যাবে না, মুত্তিযোদ্ধারা আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য দল করতে পারে না, এমন চাটুকারী মনস্তাত্ত্বিক ধ্যান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। স্মরণ করাতে চাই রাজনীতিকদের চেয়ে গ্রামের অরুণ তরুণ যুবক  কৃষক খেটে খাওয়া মানুষ বেশিসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ছিল। অনেক মুক্তিযোদ্ধা আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন আর কোনো দিন তাদের স্বাধীন দেশে রিকশা চালাতে আসবে না। সব জীবিত মুক্তিযোদ্ধার জীবনের সূর্য আজ অস্তগামী। যারা বেঁচে আছে তাদের কোনো দলীয় রাজনীতির নিক্তিতে না মেপে প্রাপ্য সম্মান দেওয়াই প্রধান কাজ। যে জাতি তার বীরদের সম্মান দিতে জানে না সে জাতির ঘরে বীর জন্মায় না। মুখ চাপলে দুধ বের হয় সরকারি দলের এমন হঠাৎ নেতারা খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদেরও নব্য রাজাকার বলে গালি দিয়ে অসম্মান করার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছেন, যা কোনোভাবেই গ্রহণীয় নয়। বাপ-দাদা রাজাকার থাকলেও তাদের সন্তানরা রকেটগতিতে প্রগতিশীল হয়ে লোকাল লীগ নেতা বনেছেন। আর এসব কারসাজির পেছনে স্থানীয় বড় নেতার কৌশল থাকে, তার ভোটের সুবিধার জন্য। মুক্তিযোদ্ধাদের কোনোভাবেই হেয় করা যাবে না। তাদের আর্থিক-সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া উচিত। তাতে নতুন প্রজন্ম ভালো কাজে, দেশের কাজে ত্যাগী হতে, জীবন উৎসর্গ করতে উৎসাহিত হবে। আশা করি আর কোনো গোলাম মোস্তফা-জালালের দুঃখী জীবনকাহিনী যেন জাতিকে দেখতে না হয় সংশ্লিষ্ট সব মহল দ্রুত সেই ব্যবস্থা নেবেন।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক

[email protected]

সর্বশেষ খবর