বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

মানুষের শুভবুদ্ধির ওপর আস্থা রাখতে হবে

আনোয়ারা সৈয়দ হক

মানুষের শুভবুদ্ধির ওপর আস্থা রাখতে হবে

পৃথিবীতে মানুষের জন্ম একটি নিষ্পাপ ঘটনা। সে হিসেবে মৃত্যুও তাই। মানুষ মূলত নিষ্পাপ হয়ে জন্মায়। এবং নিষ্পাপ হয়ে মরে। কিন্তু পরিবেশ এবং ভুল শিক্ষা তাকে যাপিত জীবনে অমানুষ করে তোলে। গত বছর পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে যে নারী নির্যাতন এবং নারীর প্রতি অবমাননা ঘটে গেছে সেটা কখনো কোনো জাতির জীবনে কাম্য হতে পারে না। কিন্তু কতিপয় ভ্রান্ত যুবকের ব্যবহারে রাষ্ট্র যখন নিজেদের জাতীয় জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ উদযাপনকে সংকুচিত করে ফেলে তখন সেটা একটি ভীষণ উদ্বিগ্ন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তখন কতিপয় নষ্ট চরিত্রের মানুষের সঙ্গে রাষ্ট্রের অনিচ্ছাকৃত হাত মেলানো চোখে দেখা যায়। এর ফলে দুর্বৃত্তরা এ খারাপ কর্মটিকে তাদের নষ্টামির বিজয় বলে মনে করে।

আমি অনেক মানুষের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কথা বলি। প্রায় প্রতিদিন কথা বলি। আমার ডাক্তারি জীবনে তাদের কেউ কেউ আমার রোগী হলেও মূলত তাদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেই আমার কথাবার্তা বেশি হয়। এবং এই মানসিক ব্যাধির স্পেশালাইজেশনে এটিই স্বাভাবিক একটি নিয়ম। কারণ রোগী বিশেষ কিছু নিজের হয়ে বলতে পারেন না।

সেখানে আমি একটি জিনিস বিশেষ খেয়াল করে দেখেছি যে, কোনো রোগী যদি কোনো তরুণ পুরুষের মা হন, এবং সেই মা যদি অসুস্থ হন, তাহলে তার প্রতি সন্তানের ভালোবাসার যে বহিঃপ্রকাশ সেটি আর পৃথিবীর আর কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনীয় হতে দেখা যায় না। প্রতিটি সন্তান একজন মায়ের নাড়িছেঁড়া ধন। কিন্তু একজন পুরুষ তরুণ সন্তানের তার মায়ের নিরাময়ের জন্য যে ব্যাকুলতা, যে দীর্ঘনিঃশ্বাস, যে দৌড়ঝাঁপ, সেটা দেখে আমি ব্যস্ততার ভিতরেও মনে মনে অবাক না হয়ে পারি না।

এমনকি এজন্য আমি মাঝে মাঝে বিরক্তও হই। কিন্তু আমার বিরক্তিকে সন্তানেরা কোনো ধরনের গুরুত্ব না দিয়ে ক্রমাগতভাবে তাদের মায়ের সুচিকিৎসা কীসে হবে, কত কত জায়গায় নিয়ে গেলে তার মাকে ভালোভাবে দেখবে, ভালো ইনভেস্টিগেশন কোথায় হবে, তার মা কীভাবে রাতে ভালোভাবে ঘুমোবেন, কীভাবে তার খাবার তৈরি করতে হবে, ডায়াবেটিস হলে কোন ডাক্তারের কাছে নিলে সবচেয়ে ভালো হবে, চিকিৎসার শেষে আবার তাদের মা আগের মতো ভালো হয়ে উঠবেন কিনা, আবার তিনি সংসারের ভালো-মন্দে নিজেকে জড়াতে পারবেন কিনা, আবার তিনি তাদের ধমক দিয়ে কথা বলতে পারবেন কিনা; এমনকি মায়ের ধমক খাবার জন্যও তাদের প্রাণের আকুলি বিকুলি আমাকে বিস্মিত করে, কারণ মায়ের বকুনি খেয়েই তরুণটি সারা জীবন বড় হয়ে উঠেছেন! সেই মা যখন অসুখজনিত কারণে আর বকা দিতে পারেন না, কণ্ঠস্বরে ক্ষীণতা এসে জড়ো হয়, মায়ের সেই ম্রিয়মান কণ্ঠস্বর তরুণটিকে চোখের জলে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, কারণ তার মা তো এই কিছুদিন আগেও এরকম ছিলেন না। কোনো কোনো মধ্যবয়স্ক পুরুষের মা ডিমেনসিয়ায় ভোগেন। ডিমেনসিয়া হচ্ছে স্মৃতিভ্রষ্টজনিত অসুখ। এ অসুখে মানুষ বর্তমান ভুলে যায়। ক্রমে ক্রমে অতীতও ভুলতে থাকে। এসব ডিমেনসিয়া মায়েদের নিয়ে সেসব মধ্যবয়স্ক পুরুষ সন্তানেরা আসেন। তারা ক্রমাগতভাবে আমাকে অনুরোধ করেন তাদের মাকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। ব্রেনের ক্ষয়জনিত কারণে তাদের মাকে যে আর ভালো করা যাবে না, এটা বোঝালেও তারা বুঝতে চান না। ক্রমাগত অনুরোধ করেন, তাদের মা কি আর তাদের চিনতে পারবেন না? আর তাদের নাম ধরে ডাকবেন না? কেন, কেন ডাকবেন না?

কোনো কোনো তরুণ জোর গলায় বলেন, না, ডাক্তার ম্যাডাম, আপনি ঠিক করে বলেন, এই তো সেদিনই মা তাকে কাছে ডেকে কত বকাঝকা করেছেন, যেহেতু তিনি সিগারেট ছাড়তে পারছেন না বলে, এখনো লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খান বলে, সেই মা আর কি তাকে বকাঝকা দিতে পারবেন না? এরকম আপন মনে চুপ করে শূন্যে দৃষ্টি মেলে বসে থাকবেন?

আমি আমার নিজের ব্যস্ততার জন্য তাদের এসব কথার ভালো জবাব দিতে পারিনে, কখনোবা তাড়াহুড়ো করে জবাব দিই, কিন্তু তাদের প্রাণের ব্যাকুলতাটুকু বুঝতে পারি, তখন আমার মনে হয় এ পৃথিবীতে একবার যদি আমাদের মা হারিয়ে যান, তাহলে আর কোনো দিন আমরা আমাদের মাকে খুঁজে পাব না। এ হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কেউ আমাদের কিছু না বললেও একজন উন্মাদ মানুষও বোঝে এ পৃথিবীতে মা’ই তার সবচেয়ে আপন। এ মায়ের ওপরেই তার যত রাগঝাগ হম্বিতম্বি। আবার এ মায়ের কোলেই সে তার বিপদের সময় মাথাটি নিশ্চিন্তে রাখতে পারে। একজন সন্ত্রাসীকেও তার মায়ের অসুখের সময় পাগলামি করতে দেখেছি। মা, মা, মাগো বলে হাসপাতালের করিডোরে ছোটাছুটি করতে দেখেছি। অথচ তার মা তখন মারা গেছেন। সুতরাং আমাদের এখন সবকিছু ভেবে দেখতে হবে। সময় এখন একটা অবক্ষয়ের ভিতর দিয়ে চলছে। সেই অবক্ষয়ের মূল কারণ হচ্ছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক। গত পয়লা বৈশাখে যে বা যারা দেশের নারীদের অপমান করেছে, তাদের সবার ঘরেই বোনেরা আছেন, সেসব বোনের প্রতিও তাদের যে ভালোবাসা চোখে দেখেছি, সেটাও লিখে রাখার মতো একেকটি ঘটনা। যে চরিত্র সন্ত্রাসী নিজের বোনটিকে এত মায়া করেন, এত মমতা দিয়ে বড় করে তুলছেন, সেই সন্ত্রাসী যখন অন্য বাড়ির মেয়ের গায়ে হাত দেন, তাকে লোক সমক্ষে নগ্ন করেন, কখনো না কখনো কথাটা ভেবে তাদের বিবেকে দংশন হবেই। মানুষ তো আর পশু নয়, যদিও ইচ্ছা হলে পশুর চেয়ে খারাপ ব্যবহার সে করতে পারে। সে ইচ্ছাটাও তাদের আগে থেকেই পরিকল্পিত। সে ইচ্ছাটাও তাদের তৈরি করে দেওয়া হয় পরিকল্পিতভাবে। কিন্তু তারা যেহেতু মানুষ, তাই সরকার বা উদ্দিষ্ট কাউকে অপদস্থ করার তরিকা থেকে নারী অপমান বা অবমাননা থেকে তাদের নিজেদের বিচ্যুত রাখতে হবে। এ অবমাননা আসলে তো তাদেরই আত্মার অবক্ষয়। মানুষের ওপর থেকে তাই এ কারণেই বিশ্বাস হারালে চলবে না। তাহলে আমাদের জাতীয় জীবনে ধস নেমে আসবে।

তাই পয়লা বৈশাখকে পয়লা বৈশাখের মতো চলতে দেওয়াটা হবে সহজ এবং স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। মনে নেই, কিছু বছর আগে যখন পয়লা বৈশাখে রমনার বটমূলে বোমা ফেলে মানুষ মারা হয়েছিল, তার পরের বছর কত ভিড় হয়েছিল আবারও? মানুষ কি বোমার ভয়ে বটমূলে আসা ছেড়ে দিয়েছিল? না। এ কথাটা হয়তো আমাদের মনে রাখতে হবে যে বাঙালিরা জাতি হিসেবে এখনো নিজেদের ভিতরে কনসিসটেন্ট হতে পারেনি, এই কনসিসটেন্সির জন্য মুক্ত স্বচ্ছ স্বাধীন চিন্তা চেতনা, সময় এবং সহনশীলতার প্রয়োজন। জাতি হিসেবে এখনো আমরা সেটা অর্জন করতে পারিনি— তবে হবে, অর্জন অবশ্যই হবে, সেজন্যই সব বৈরিতাকে তুচ্ছজ্ঞান করে পয়লা বৈশাখকে যতদূর সম্ভব স্বাভাবিকভাবে উদযাপন করতে দিতে হবে। মানুষের শুভবুদ্ধির ওপর আস্থা রাখতে হবে। পুলিশের ব্যূহের ভিতরে বসে পয়লা বৈশাখ উদযাপন করাটা হবে আত্মঘাতী একটি কাজ। তাই বিকাল ৫টায় উৎসব শেষ নয়, বিকাল ৫টায় উৎসব হবে কনটিনিউয়াস।

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর