সোমবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

ধর্ম ও মতাদর্শ প্রসঙ্গে

আবুল কাসেম ফজলুল হক

ধর্ম ও মতাদর্শ প্রসঙ্গে

প্রথম কিস্তি

জানা ইতিহাসের সবটা জুড়েই মানুষকে দেখা যায় যৌথ জীবনধারী, বুদ্ধিমান, চিন্তাশীল, ভালো-মন্দ বোধসম্পন্ন প্রাণী। ভালো ও মন্দ দুই রকম কাজই মানুষ করে। মানবিক গুণাবলির কারণে মানুষ অন্য সব প্রাণী থেকে আলাদা। সেসব গুণই মানবিক গুণ যেগুলো মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীতে নেই। মানুষের সত্তায় মানবীয় গুণাবলি যেমন দেখা যায়, তেমনি দেখা যায়, জন্তু-জানোয়ারের বৈশিষ্ট্যও। বিকাশশীল প্রকৃতির মধ্যে মানুষ ও মানুষের সব বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলিও বিকাশশীল। মানুষের বিকাশ ঘটে সমাজের পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিসমূহের বিরোধ ও জয়-পরাজয়ের মধ্যে জীবনযাপনের ধারায়। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, ন্যাটো, জি সেভেন, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশ্বায়নের নামে বিশ্বব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে যেভাবে পুনর্গঠন করছে, তাতে মানুষ মানবিক গুণাবলি হারিয়ে চলছে। বিবিসি রেডিও ১৯৮০ সাল থেকে ‘মৌলবাদ’ নামক একটি কল্পিত ধারণা নিয়ে যে আন্দোলন পরিচালনা করেছে, তার প্রতিক্রিয়ায় নানারকম অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে চলছে। তার ওপর আছে গণতন্ত্রের ব্যর্থতা, রাষ্ট্রীয় অপব্যবস্থা ও দুর্নীতি। এ অবস্থায় ধর্ম ও আদর্শ সম্পর্কে আমাদের ধারণার পুনর্গঠন দরকার। অবস্থার উন্নতির জন্য দূরদর্শিতার সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে অনেক কিছু করতে হবে। সে বিষয়টিকে বিবেচনায় আনার সামান্য প্রয়াস আছে এই লেখায়। একজনের কাজ নয়, সত্যের সন্ধানে অনেককে চিন্তায় ও আলোচনা-সমালোচনায় এগিয়ে আসতে হবে।

ইতিহাসে দেখা যায়, প্রত্যেক ধর্মের উদ্ভব ও প্রত্যেক ধর্মপ্রবর্তকের আত্মপ্রকাশ প্রত্যক্ষ সামাজিক চাহিদার কারণে। প্রত্যেক ধর্মের ইতিহাসেই এর প্রমাণ রয়েছে। প্রত্যেক ধর্মের পটভূমিতেই আছে নির্দিষ্ট ভৌগোলিক, আর্থ-সামাজিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা। তবে প্রত্যেক ধর্মেই অনেক অলৌকিক বিষয়ও বর্ণিত আছে— যেগুলোর অস্তিত্ব ইন্দ্রিয় দিয়ে, কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে, কিংবা বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্রমাণ করা যায় না। অলৌকিক বিষয় ছাড়া প্রত্যেক ধর্মে আছে, ধর্ম প্রবর্তকদের প্রচার অনুযায়ী মানুষের সবচেয়ে ভালো জীবনযাপনের উপায় সম্পর্কে নীতি-নির্দেশ। এটাই ধর্মের পার্থিব দিক— নৈতিক দিক। আজকের দিনেও অনেক লোকেই মনে করেন, ধর্ম ছাড়লে মানুষ ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে নৈতিক অবলম্বন হারাবে এবং তাতে মানুষ বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে যাবে— মানবিক গুণাবলি হারিয়ে মানুষ জন্তু-জানোয়ারের পর্যায়ে নেমে যাবে।

গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীদের থেকে বিজ্ঞানসম্মত কার্যকর কোনো নৈতিক অবলম্বন সাধারণ মানুষের সামনে উপস্থাপন করা হয়নি বলে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে লোকে ধর্মের সর্বাঙ্গীণ বিকল্প রূপে পায় না। আর সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত লোকে গণতন্ত্রী বলে আত্মপরিচয়দানকারীদের দেখতে পায় প্রধানত যুদ্ধবাজ ও দুর্নীতিবাজ রূপে।

বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এখন বাধ্যতামূলক আছে নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী ধর্মীয় নীতিশিক্ষা— মুসলমান শিক্ষার্থীদের জন্য ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা, হিন্দু শিক্ষার্থীদের জন্য হিন্দু ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, বৌদ্ধ শিক্ষার্থীদের জন্য বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, খ্রিস্টান শিক্ষার্থীদের জন্য খ্রিস্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা। কিন্তু গণতন্ত্র ও নৈতিক শিক্ষা, সমাজতন্ত্র ও নৈতিক শিক্ষা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও নৈতিক শিক্ষা জাতীয়তাবাদ ও নৈতিক শিক্ষা পাঠ্যতালিকায় নেই। অথচ সংবিধানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদও বর্ণিত আছে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, গণতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী ও জাতীয়তাবাদীদের নৈতিক শিক্ষার দরকার নেই? বিজ্ঞানসম্মত জীবনবিধান রচনা করা কি সম্ভব নয়?

রাষ্ট্রীয় আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক বিধিবিধান মানুষের নৈতিক ক্ষুধাকে যথেষ্ট পরিতৃপ্ত করে না। তা ছাড়া আছে, ন্যায়স্বার্থ ও হীনস্বার্থের দ্বন্দ্ব। প্রবল ক্ষমতালিপ্সু, সম্পত্তিলিপ্সু, ভোগলিপ্সু কায়েমি-স্বার্থবাদীদের সাধারণত নৈতিক ক্ষুধা থাকে না। যে কোনো উপায়ে তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে নেয়। জনগণের জন্য তারা বিপজ্জনক। সামাজিক জীবনে মানুষের আছে দুর্নীতির সমস্যা। ন্যায়নীতি অবলম্বন করে, দুর্নীতির সমস্যার সমাধান করে, সমাজে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্প্রীতির মধ্যে মানুষ কীভাবে সবচেয়ে ভালো জীবনযাপন করতে পারবে, তার নির্দেশ বিপুল-অধিকাংশ লোকে আজও খোঁজ করে কেবল ধর্মে। জীবনযাত্রার জন্য কার্যকর কোনো নীতি-নির্দেশ মানুষ গণতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের থেকে পায় না। প্রত্যেক ধর্মে পরধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নির্দেশ আছে, জীবন-জীবিকা ও আর্থ-সামাজিক সমস্যার সমাধান সম্পর্কেও নীতি-নির্দেশ আছে। ন্যায়নীতি অবলম্বন করে জীবনযাপনে মানুষ অনেক সময় ব্যর্থ হয়, কিন্তু তার পরেও ন্যায়নীতির প্রতি মানুষ শ্রদ্ধাশীল থাকে। স্মরণীয় যে, ‘মানুষ স্বভাবে সুন্দর না হলেও স্বভাবের সৌন্দর্যকে ভালোবাসে।’ গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীরা কি মানবস্বভাবের এসব বৈশিষ্ট্যের প্রতি মনোযোগী হতে পারেন না?

যে ধর্ম যে দেশ-কালে প্রবর্তিত হয় সেই ধর্মের নীতি-বিধিতে সেই দেশ-কালের অন্তরগরজ এবং অগ্রসর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার পরিচয় থাকে। দেশ-কাল বদলে গেলে উক্ত নীতি-বিধি সেকেলে হয়ে পড়ে এবং উপযোগিতা হারায়। তখন সেগুলো আর জনজীবনের চাহিদা মেটাতে পারে না। এ কারণেই কালে কালে নতুন নতুন ধর্মের উদ্ভব ঘটেছে এবং আত্মপ্রকাশ করেছেন নতুন নতুন ধর্মপ্রবর্তক। প্রত্যেক সমাজেই নতুন-পুরাতনের বিরোধ চলমান থাকে, কখনো কখনো এ বিরোধ তীব্র হয়ে ওঠে। কোরআনে এক লাখ চব্বিশ হাজার মতান্তরে দুই লাখ চব্বিশ হাজার, পয়গম্বরের কথা উল্লেখ আছে। ধর্মের অলৌকিক বিষয় বাদ দিয়ে নৈতিক বিষয়সমূহের শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সম্ভব। তবে প্রত্যেক ধর্মই তার নীতি-বিধিকে চিরন্তন, শাশ্বত, সনাতন বা অবিনশ্বর বলে দাবি করে এবং দেশ-কালের সীমাবদ্ধতার কথা অস্বীকার করে। ধর্মের এই দাবি বাস্তবসম্মত বা বিজ্ঞানসম্মত নয়। যে কোনো ধর্মের ইতিহাসেই দেখা যায়, উদ্ভব ও বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে তার অবস্থা ও তার অনুসারীদের ভূমিকা এক রকম থাকে না। বিভিন্ন ঐতিহাসিক পর্যায়ে প্রত্যেক ধর্মের অনুসারী বিভিন্ন গ্রুপের ভূমিকা প্রগতিশীল, কিংবা রক্ষণশীল, কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে থাকে। কোনো ধর্মেরই উপলব্ধি সেই ধর্মের অনুসারী সবার এক রকম হয় না। ধর্মসংস্কারের আন্দোলনও আছে। ধর্মে বর্ণিত স্রষ্টা বা ঈশ্বরের অস্তিত্বও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্রমাণ করা যায় না। প্রত্যেক ধর্মেই মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের বা পরকালের কথা আছে। বিজ্ঞানে এর স্বীকৃতি নেই। ধর্মের স্বরূপ অনুধাবন করলে দেখা যায়, প্রত্যেক ধর্মের জাগতিক দিক পরজাগতিক দিকের সঙ্গে যুক্ত। প্রত্যেক ধর্মই নিজ নিজ মত অনুযায়ী মৃত্যু-পরবর্তী জীবন, জন্মান্তর বেহেশত, দোজখ, স্বর্গ, নরক, মোক্ষ, পরমার্থ, মুক্তি, নির্বাণ ইত্যাদির সঙ্গে শর্তযুক্ত করে পৃথিবীতে মানুষের ভালো জীবনযাপনের শ্রেষ্ঠ উপায় নির্দেশ করে। ধর্ম, পাপ-পুণ্যের, পরলোকের, কিংবা জন্মান্তরের ধারণা দিয়ে পৃথিবীতে মানুষকে খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকা ও ভালো কাজ করার প্রণোদনা দেয়। ধর্মের মতে, ধর্ম মানুষের জন্য সর্বাঙ্গীণ বা সার্বিক জীবনবিধান প্রদান করে। নৈতিক প্রশ্নে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের অনাগ্রহী দেখা যায়।

যারা বিজ্ঞানের অনুসারী তারা ধর্মের দাবিকে সমালোচনা দ্বারা নাকচ করে দিয়ে বিজ্ঞানসম্মত উন্নততর কোনো সর্বাঙ্গীণ বা সার্বিক জীবনবিধান উপস্থাপন করার কথা ভাবেন না। সাধারণ মানুষ জীবনযাত্রার জন্য জীবনবিধান চায়। অনেকে চায় সর্বাঙ্গীণ জীবনবিধান। জীবনবিধান হিসেবে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের ধারণা খুবই অপূর্ণ। গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্র নিয়ে সাধারণ মানুষ দুর্নীতি ও জুলুম-জবরদস্তির সমস্যার সমাধান পায় না। গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীরা কোনো রকম নৈতিক বিবেচনা ও নৈতিক অনুশীলনকেই গুরুত্ব দেয় না। দুর্নীতি দমন ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ওপর মানুষ আস্থাশীল নয়। ‘ধর্মের জয় অবশ্যম্ভাবী’— এ বিশ্বাস দীর্ঘকাল মানুষের সমাজে ছিল, এখনো অনেকের মনে দৃঢ়ভাবে তা বহাল আছে। এতে ধর্ম বলে বোঝানো হতো ঈশ্বর, কিংবা সর্বজনীন পরম কল্যাণ, কিংবা সর্বজনীন পরম ন্যায়।

ধর্মের বিরোধিতাকারীদের মধ্যে কাউকে কাউকে সমাজে ধর্মের প্রতি অবিশ্বাস সৃষ্টিতে ভীষণভাবে তত্পর দেখা যায়, কিন্তু অবিশ্বাসের পরে কী— সে প্রশ্নে নিস্পৃহ দেখা যায়। তারা শূন্যবাদী কিংবা অবিশ্বাস্যবাদী কিংবা নৈরাজ্যবাদী। চিন্তা ও কর্মের ক্ষেত্রে তাদের নেতৃত্বকে সাধারণ লোক বিপজ্জনক ভাবে। বাস্তবে যখন মানুষ গণতন্ত্রের নামে জুলুম-জবরদস্তি ও শোষণ-পীড়ন-প্রতারণা দেখতে পায় তখন লোকে কথিত গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের সঙ্গে কথিত ধর্মপন্থি নেতৃত্বের তুলনা করে। অনেকেই ধর্মপন্থিদের মধ্যে অসততা তুলনামূলকভাবে কম বলে মনে করে। বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা কখনো কখনো নিজেদের জনগণের কাছে ধার্মিকরূপে প্রদর্শন করেও জনসমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু গণতন্ত্রের মান উন্নত করার কথা তারা ভাবেন না। গণতন্ত্রের নামে তাদের আগ্রহ কেবল নির্বাচন ও ক্ষমতা দখলে।

ধর্মপ্রবর্তকদের জীবন ও দেশ কাল সম্পর্কে জানতে গেলেই দেখা যায়, প্রত্যেক ধর্মপ্রবর্তকই ছিলেন কোনো না কোনো জনগোষ্ঠীর বা সমাজের বা দেশের নেতা। অসাধারণ জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাদের মতোই ছিলেন অসাধারণ জনপ্রিয় ধর্মপ্রবর্তকরা। সম্মোহন শক্তির অধিকারী ছিলেন তারা। একালের রাজনৈতিক নেতারা জনজীবনে যে ভূমিকা পালন করেন, সেকালের ধর্মপ্রবর্তকরা ও ধর্মনেতারা জনজীবনে সেই  ভূমিকাই পালন করেছেন। রাজনৈতিক নেতারা কেবল ইহকালের কথা বলেন, ধর্মপ্রবর্তকরা ইহকালের সঙ্গে পরকালের কথাও বলেছেন, সেই সঙ্গে নির্দেশ করেছেন পার্থিব জীবনে মানুষের করণীয়-অকরণীয়। ইতিহাসের ধারায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে রাজারা রাজ্য পরিচালনায় ধর্মকে কাজে লাগিয়েছেন। রোমান দার্শনিক সেনেকা খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতেই উল্লেখ করেছিলেন— Religion is regarded by the common people as true, by the wise as false and by the rulers as useful.ইতিহাসে ও বাস্তবে ধর্মের যেমন অপব্যবহার দেখা যায়, তেমনি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রেরও অপব্যবহার দেখা যায়। সাধারণ মানুষ চতুষ্পার্শ্বের ব্যাপারগুলোকে তুলনামূলকভাবে বিচার করে। অবশ্য জুলুম জবরদস্তির মধ্যে লোকে  বিচারক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ কমই পায়। আজকের পৃথিবীতে ধর্মের নামে যে অপকর্ম করা হচ্ছে, গণতন্ত্রের নামে অপকর্ম তার চেয়ে কম না বেশি হচ্ছে— সে প্রশ্ন আছে। পরাজিত পুরাতন সংস্কার বিশ্বাসের আর মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের উত্থান কী কারণে কীভাবে ঘটেছে তা তলিয়ে দেখা দরকার। তালেবান, আল-কায়দা, আইএস কি শুধুই বেহেশতে যাওয়ার লক্ষ্যেই সশস্ত্র কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে? ধর্মীয় কারণ ছাড়া আর কোনো কারণই কি নেই? তাদের মধ্যে কি কোনো জাতীয় চেতনা বা জাতীয় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নেই? বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, সিএনএন, স্কাই নিউজ কি সত্য কথা বলছে? প্রচারকার্যে কী তাদের উদ্দেশ্য?

রেনেসাঁস ও শিল্প বিপ্লবের ধারা ধরে বিভিন্ন জাতি গণতন্ত্রের যুগে প্রবেশ করেছে। বিভিন্ন জাতির জীবনে রেনেসাঁস ও শিল্প বিপ্লব এক সময়ে আরম্ভ হয়নি এবং গণতন্ত্র যুগের সূচনাও এক সময় হয়নি। বিভিন্ন জাতির মধ্যে রেনেসাঁস ও গণতন্ত্রের রূপ ও প্রকৃতি সম্পূর্ণ এক রকম দেখা যায় না। প্রত্যেক জাতির বিশিষ্টতা আছে। গণতন্ত্র-যুগের আগে গিয়েছে সুদীর্ঘ রাজতন্ত্র যুগ। রাজতন্ত্র যুগে রাজনীতি ও সব মানবীয় কর্মকাণ্ড ধর্ম অবলম্বন করে কিংবা ধর্মের নামে পরিচালিত হয়েছে। হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, ইহুদিধর্ম, খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম এই পাঁচটি প্রধান ধর্ম। এই ধর্মগুলোর ইতিহাস রাজতন্ত্র ও রাজনীতিকে বাদ দিয়ে রচনা করা যায় না। এগুলো ছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতি বা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর  মধ্যে আরও অনেক ধর্ম আছে। সভ্যতার বিকাশে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদের যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রিস্টান, ইসলাম প্রভৃতি ধর্মেরও। সভ্যতা কী— এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের সন্ধান করা দরকার। সব ধর্মেরই উদ্ভব ঘটেছিল শোষিত বঞ্চিত নির্জিত জনগণের মুক্তিসাধনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে।

ধর্ম ও আদর্শের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস বিচার করলে প্রচলিত ধারণা বদলে যাবে। তাতে উত্তেজনার অবসান ঘটার কথা। সভ্যতার বিকাশে ধর্মের অবদানকে সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার করা অপরিহার্য।

লেখক : বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, প্রাক্তন অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর