শুক্রবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

কলিযুগের ফেরাউনের কীর্তিগাথা!

গোলাম মাওলা রনি

কলিযুগের ফেরাউনের কীর্তিগাথা!

তাকে বলা হয় আধুনিক মিসরের জনক। দেশবাসী বড়ই ভক্তি-শ্রদ্ধা এবং আবেগ নিয়ে তার উপাধি নির্ধারণ করেছে জনগণের ফেরাউন নামে। পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষ, তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্যপীড়িত জনগণ এবং আরব জাহানের অধিবাসীদের হৃদয়ে তিনি একজন স্বপ্নের রাজকুমার। খুব অল্প সময় তিনি পৃথিবীতে ছিলেন। ৫৮ বছরের জীবনকাল, ১৪ বছরের শাসনকাল এবং অনেক যুদ্ধ  তাকে কিংবদন্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে। মিসরের ৭ হাজার বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে তার মতো অন্য কোনো শাসক এতটা জনপ্রিয় হতে পারেনি। তার কথায় জনগণ হেসেছে আবার তার কথায় জনগণ অশ্রুবর্ষণ করেছে। তার হুকুমে নিরস্ত্র জনতা বিশ্বের দুই পরাশক্তি ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের সুসজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। আবার তার নেতৃত্বে ইসরায়েলের কাছে শোচনীয় পরাজয় এবং অপমানজনক চুক্তির পরও জনগণ তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। তার মৃত্যুর পর কম করে হলেও কায়রো নগরীতে ৫০ লাখ লোক রাস্তায় নেমে শোকের মাতমে অংশগ্রহণ করেছিল। মিসরবাসী, আরববাসীর সঙ্গে তামাম দুনিয়া আজও পরম শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় যে ব্যক্তিটিকে স্মরণ করেন তার প্রকৃত নাম গামাল আবদেল নাসের।

মিসরীয় সভ্যতার ইতিহাসের বেশির ভাগ অংশই লিখিত রয়েছে। এমনকি ৭ হাজার বছরের আগেকার রাজকীয় ফরমান, ব্যবহৃত তৈজসপত্র এবং যুদ্ধাস্ত্র অবিকৃত অবস্থায় আজও সংরক্ষিত রয়েছে। মিসরকে বলা হয় নীল নদের দান। পৃথিবীর বৃহত্তম নদীটি যেমন মিসরকে সুজলা-সুফলা এবং মনুষ্য বসতির উপযোগী করেছে তেমনি দেশটির ভৌগোলিক অবস্থার কারণে সেই আদিকাল থেকেই ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকার প্রধান গেটওয়ে হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। মিসরের ক্ষমতাবান ফেরাউনরা একসময় দুনিয়া শাসন করেছে, অন্যদিকে দুনিয়ার সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষমতাবানরা মিসর দখল না করা পর্যন্ত নিজেদের ক্ষমতাকে সার্বভৌম এবং সার্থক বলে মনে করতেন না। দেশটির একদিকে লোহিত সাগর এবং অন্যদিকে ভূমধ্যসাগর বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য যেমনি গুরুত্বপূর্ণ তারচেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সামরিক কারণে। দেশটির ভূখণ্ড এমন এক অবস্থানে রয়েছে যেখান থেকে সমগ্র আরব উপদ্বীপ, উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম ইউরোপ এবং এশিয়ার বৃহৎ অংশ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এসব কারণে সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই তাবৎ দুনিয়ার কাছে মিসর একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ দেশ বলে বিবেচিত হয়ে আসছে।

ভৌগোলিক এবং পরিবেশগত কারণে মিসরবাসীর চিন্তা-চেতনা, আভিজাত্য এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা অপরিসীম। পৃথিবীর অন্য কোনো অঞ্চলের লোকজনের সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে মিসরবাসীর কোনো তুলনাই করা যায় না। বর্ণমালা এবং লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার, চাকার আবিষ্কার এবং ব্যবহার, অংক, জ্যামিতি, ভূগোল এবং তামার ব্যবহার শুরু করে তারা এমন এক সভ্যতার সূচনা করেছিল যার জন্য আধুনিক সভ্যতা কিয়ামত পর্যন্ত তাদের কাছে ঋণী এবং কৃতজ্ঞ থাকতে বাধ্য। আজ থকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বছর আগে তারা চিকিৎসাবিজ্ঞান, সুউচ্চ বিল্ডিং নির্মাণ, সেচ ব্যবস্থা প্রচলন ইত্যাদিতে যে নৈপুণ্য দেখিয়েছিল তা আধুনিককালের বিজ্ঞান কল্পনাও করতে পারে না। মৃত মানুষের দেহকে মমি বানানোর কৌশল এবং পিরামিড বানানোর কৌশল যেমন আধুনিক সভ্যতা আজও আবিষ্কার করতে পারেনি তেমনি বিশ্বের বাঘা বাঘা সব ইঞ্জিনিয়ার ভেবে কূলকিনারা করতে পারে না যে কী করে একজন ফেরাউন প্রায় ৫ হাজার বছর আগে সুয়েজ ক্যানাল খনন করেছিলেন?

এশিয়ার মুসলমানরা ফেরাউন নামটিকে ঘৃণা করে মূলত পবিত্র আল কোরআনে বর্ণিত হজরত মুসা (আ.)-এর জমানার ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিসের খোদাদ্রোহী কর্মকাণ্ডের জন্য। কিন্তু মিসরবাসীর কাছে ফেরাউন শব্দটি অত্যন্ত মর্যাদাকর, গৌরবময় এবং সম্মানীত একটি পদবি। প্রায় তিন হাজার বছর ধরে ফেরাউনরা মিসর শাসন করেছেন। ঠিক এই সময়টাতে মিসর ছিল প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন এবং সার্বভৌম। আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী এবং ধনশালী একটি রাষ্ট্রের অধিবাসী হিসেবে তিন হাজার বছর ধরে একাদিক্রমে মিসরবাসী সারা দুনিয়ার মানুষের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিল ফেরাউনদের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সামরিক প্রতিভা, উন্নত শাসন, ন্যায়বিচার এবং জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য। অন্তত ২০-২৫ জন ফেরাউন ছিলেন যাদের মেধা, যোগ্যতা, উন্নত শাসন পদ্ধতি, সাম্রাজ্য পরিচালনার শ্রেষ্ঠত্ব এবং ভালো মানুষীর সঙ্গে পৃথিবীর অন্য কোনো মহান রাজনীতিবিদদের তুলনা পর্যন্ত করা যায় না। রাজনীতি, বিচারব্যবস্থা, আইন প্রণয়ন, সুশাসন এবং জনকল্যাণের উন্নত পদ্ধতি জানার জন্য সর্বকালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ফেরাউনদের জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। আর এসব কারণেই ফেরাউন শব্দটি মিসর দেশে অত্যন্ত সম্মান এবং মর্যাদার সঙ্গে উচ্চারিত হয়।

মিসরবাসী প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা হারায় ৫২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। মিসরবাসীর সর্বশেষ ফেরাউনকে পরাজিত করে পারস্য সম্রাট দ্বিতীয় ক্যামবিসেস মিসর দখল করে নেন। পরবর্তীতে আলেকজান্ডার মিসর দখল করেন পারস্য সম্রাটকে পরাজিত করে। আলেকজান্ডারের সেনাপতি টমেমি এবং তার বংশের শেষ সম্রাজ্ঞী ক্লিওপেট্রা সবাই মিলে মিসর শাসন করেন প্রায় পৌনে তিনশত বছর। এরপর রোমান, আরবীয় মুসলমান, তুর্কি এবং ব্রিটিশরা মিসর শাসন করেন।  সম্রাট নেপোলিয়নের সময়কালে ফ্রান্সও কিছু দিন মিসর শাসন করে। ফলে ৫২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৯৫৬ সাল অবধি মিসর কখনো প্রত্যক্ষভাবে নয়তো পরোক্ষভাবে পরাধীন ছিল। এ অবস্থায় মিসরীয় সেনাবাহিনীর একজন লে. কর্নেল হিসেবে গামাল আবদেল নাসের পশ্চিমাদের পুতুল বলে পরিচিত বাদশাহ ফারুখের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দিলেন ১৯৫২ সালে যখন তার বয়স মাত্র ৩৪ বছর। পরবর্তী চারটি বছর তিনি কেবল দ্বিধা করতে করতে পার করলেন। ৩৪ বছর বয়স্ক এক যুবক, তাও আবার কোনো অভিজাত পরিবার থেকে নয়— গ্রামের সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে যার আগমন ঘটেছে, যিনি মিসরের মতো একটি দেশের বৃহৎ সেনাবাহিনীর লে. কর্নেল পদের একজন জুনিয়র কর্মকর্তা, তিনি কী করে দেশটির প্রেসিডেন্ট হবেন— এমনতর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থেকে বিপ্লবের প্রধান নায়ক হওয়া সত্ত্বেও নাসের সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙে রাতারাতি সর্বময় ক্ষমতা দখল করলেন না।

মিসরে সেনাঅভ্যুত্থান হয়েছিল ১৯৫২ সালের ২৩ জুলাই। সেনাবাহিনীর মধ্যে ফ্রি অফিসার নামে একটি গোপন জাতীয়তাবাদী সংগঠন গড়ে তোলা হয় ১৯৪৫ সালে মূলত মুসলিম ব্রাদারহুড নামের একটি রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ মদদে। সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসারদের মুসলিম ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ এবং পশ্চিমা শক্তির তাঁবেদার বাদশাহ ফারুখের সরকারকে উচ্ছেদ করার জন্য মুসলিম ব্রাদারহুড অতি গোপনে সেনাবাহিনীর মধ্যে ফ্রি অফিসার নামের সংগঠনটি গড়ে তোলেন। ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় মিসরীয় সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ফ্রি আর্মি অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ঠিক এই সময়টায় গামাল আবদেল নাসের সংগঠনটির সঙ্গে জড়িয়ে যান এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে নেতৃত্বের শীর্ষে পৌঁছে যান।

সেনাঅভ্যুত্থানের পর নাসেরের সামনে কয়েকটি সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। মুসলিম ব্রাদারহুড এবং তাদের মদদপুষ্ট ফ্রি আর্মির সদস্যরা বাদশাহ ফারুখকে ক্ষমতাচ্যুত করে বিচারের আওতায় আনার জন্য চাপ দিতে লাগল। অন্যদিকে রাজতন্ত্রের পরিবর্তে কি পদ্ধতির গণতন্ত্র হবে, কে হবেন সেনাপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি— এসব নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো বাদশাহ ফারুখের পক্ষে অবস্থান নিল এবং তাকে নিরাপদে দেশ ত্যাগের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে লাগল। মিসরের এই জাতীয় সমস্যা এবং ঐতিহাসিক সংকটের সন্ধিক্ষণে একজন জুনিয়র অফিসার হওয়া সত্ত্বেও নাসের সব দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়ে একটার পর একটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিতে থাকলেন। তিনি পশ্চিমাদের দাবি মেনে নিয়ে বাদশাহ ফারুখকে দেশত্যাগে অনুমতি দিলেন। সেনাপ্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোহাম্মদ নাগিবকে নিয়োগ দিলেন। বাদশাহ ফারুখ চলে যাওয়ার পর ১৯৫৩ সালের ১৮ জুন মিসরকে রিপাবলিক হিসেবে ঘোষণা করলেন এবং নাগিবকে মিসরের ইতিহাসের প্রথম প্রেসিডেন্ট বানিয়ে নিজে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন। অভ্যুত্থানের বহু আগ থেকেই নাসের একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী মিসরের স্বপ্ন দেখতেন। মিসরীয় জাতীয়তাবাদ, আরব জাতীয়তাবাদ, আফ্রিকার জাতি রাষ্ট্রসমূহের ঐক্য নিয়ে তিনি বিস্তর চিন্তাভাবনা শুরু করেন। একজন সামরিক কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভূমিহীন কৃষক এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষুধা এবং দরিদ্রতার বেদনা হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেন। তিনি চমৎকারভাবে কথা বলতেন এবং মুখে সর্বদা এমন একটি হাসি ধরে রাখতেন যা দেখে সাধারণ মানুষ তাদের সব কষ্ট ভুলে যেতেন। ক্ষমতা লাভের পর তিনি অতি দ্রুত মিসরে ভূমি সংস্কার আইন চালুর মাধ্যমে দরিদ্র কৃষক এবং সাধারণ মানুষের ভূমির ওপর অধিকার দিয়ে দেন যা বিগত শত শত বছর ধরে মিসরের সাধারণ মানুষের প্রাণের দাবি ছিল। এই একটি আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে নাসেরের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে পৌঁছে। লোকজন পঙ্গপালের মতো নাসেরকে দেখার জন্য, তার কথা শোনার জন্য এবং তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ছুটতে থাকে। নাসেরও জনগণের ভালোবাসার আহ্বানে ছুটতে থাকেন পথে-প্রান্তরে, গ্রাম-গ্রামান্তরে— দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ধরে।

নাসেরের অব্যাহত তুমুল জনপ্রিয়তা এবং তার গৃহীত পদক্ষেপসমূহ নিয়ে মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে মতবিরোধ শুরু হয়। এরই মধ্যে একটি জনসভায় নাসেরের ওপর প্রকাশ্যে গুলি চালায় আততায়ী। এ ঘটনার জন্য মুসলিম ব্রাদারহুডকে দায়ী করে নাসের সর্বশক্তি নিয়োগ করে দলটিকে নিঃশেষ করে দেন। তাদের শীর্ষ নেতারা এবং আধ্যাত্মিক নেতা সৈয়দ কুতুবও রক্ষা পাননি। নাসের ইতিমধ্যে নিজের অবস্থান যথেষ্ট পাকাপোক্ত করে ফেলেন এবং চূড়ান্ত ক্ষমতা গ্রহণের দিকে এগোতে থাকেন। অভ্যুত্থানের পরবর্তী সরকারে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। পরের বছর তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন এবং ১৯৫৬ সালের ২৩ জুন মিসরের রাষ্ট্রপতি হিসেবে সর্বময় ক্ষমতা অধিকার করেন। এ ঘটনার মাত্র চার মাসের মাথায় তিনি ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ঝুঁকিটি গ্রহণ করেন। ব্রিটিশ এবং ফ্রান্সের যৌথ মালিকানাধীন সুয়েজ খালকে তিনি জাতীয়করণ করেন। মিসরবাসী তো বটেই সমগ্র আরব ভূমিতে খুশির বন্যা বয়ে যায়। লাখো কোটি মানুষ আনন্দ প্রকাশের জন্য রাস্তায় নেমে আসে। নাসেরের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হয়ে পড়ে।

সুয়েজকে কেন্দ্র করে আরও একটি যুদ্ধ বেধে যায়। ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং ইসরায়েল একসঙ্গে মিসর আক্রমণ করে। নাসের বিষয়টি নিয়ে দ্রুত জাতিসংঘে যান। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মিসরের পক্ষে আনতে সমর্থ হন। ফলে জাতিসংঘ সুয়েজের মালিকানা মিসরের বলে ঘোষণা দেয় এবং ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং ইসরায়েলকে মিসর থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে চাপ প্রয়োগ করে। মিসরের আপামর জনগণ নাসেরের পক্ষে রাস্তায় নেমে আসে। এ অবস্থায় আক্রমণকারীরা সৈন্য প্রত্যাহারে বাধ্য হয় এবং নাসেরের সৌভাগ্যকে তুঙ্গে পৌঁছে দেয়। নাসের তার সুসময়কে চমৎকারভাবে কাজে লাগান দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিত্য-নতুন, অভিনব এবং সাহসী জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। তিনি আরবলীগ, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, আফ্রিকা ইউনিয়ন যা অর্গানাইজেশন অব আফ্রিকান ইউনিটিতে নিজেকে অন্যতম প্রধান নীতিনির্ধারক রূপে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন। যুগোশ্লাভিয়ার মার্শাল টিটো, ভারতের জওহার লাল নেহেরু, ইন্দোনেশিয়ার ড. সুকর্নো, রাশিয়ার নিকিদা ক্রুশেভ, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো প্রমুখ বিশ্ব নেতা নাসেরের সঙ্গে গভীর ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। তারা নাসেরের ব্যক্তিত্ব, আরব জাতীয়তাবোধ এবং পশ্চিমা শক্তি মোকাবিলায় আর পরিকল্পনাসমূহ দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়েন। নাসের ১৯৫৬ থেকে ৬০ সাল পর্যন্ত তার বন্ধু রাষ্ট্রসমূহ ভ্রমণ করেন। তিনি যেখানে যেতেন সেখানকার জনগণ তাকে সম্মান জানানোর জন্য রাস্তায় নেমে আসত। বিশেষ করে আরব দেশসমূহে নাসেরকে নিয়ে রীতিমতো উন্মাদনা শুরু হয়ে যায়। সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন প্রভৃতি দেশের জনগণ এবং রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়ে মিসরের সঙ্গে একীভূত হওয়ার জন্য নাসেরকে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। মানব জাতির ইতিহাসে এমন ঘটনা কোনোকালে ঘটেনি।

গামাল আবদেল নাসের কেবল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিসরকে প্রতিষ্ঠিত করেননি। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, অর্থনীতি, কৃষি, শিল্পবাণিজ্য, অবকাঠামো নির্মাণ, সামাজিক সাম্যতা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তিনি এমন সফলতা দেখান যা মিসরবাসী হাজার বছর ধরে বংশপরম্পরায় স্বপ্ন দেখে আসছিল। সুয়েজ খাল জাতীয়করণের স্বপ্ন ছিল প্রায় শত বছরের পুরনো। অন্যদিকে আসোয়ান বাঁধ নির্মাণ এবং ভূমি সংস্কার আইনের স্বপ্ন ছিল হাজার বছরের পুরনো। তিনি আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিকায়ন এবং সেটিকে কেন্দ্র করে বিশ্ব মুসলিম উম্মার চিন্তা-চেতনা এবং আত্মিক উন্নয়নের বৈশ্বিক কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। বিশ্ব পরাশক্তির বিরুদ্ধে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, আফ্রিকার দেশগুলোর ঐক্য এবং খ্রিস্ট ও ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে আরব লীগকে শক্তিশালী করার প্রধান প্রাণপুরুষ ছিলেন মিসরবাসীর কলিকালের জননন্দিত ফেরাউন গামাল আবদেল নাসের। তার বিরুদ্ধবাদীদের সংখ্যাও কম ছিল না এবং এসব বিরুদ্ধবাদীর এন্তার অভিযোগ বিশ্ব ইতিহাসে সর্বজনীন বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি।

এখন প্রশ্ন হলো— মাত্র ১৪ বছর সময়কালে নাসের এত কিছু কীভাবে করলেন! বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, তিনি খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন এবং নির্ভুলভাবে পরিস্থিতি বিবেচনা করতে পারতেন। তিনি ছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা পরিকল্পনাবিদ, বাস্তবায়নকারী শাসক এবং ন্যায়বিচারক। তিনি জনগণকে ভালোবাসতেন হৃদয় দিয়ে, তাদের জন্য কল্যাণ করতেন মস্তিষ্ক দিয়ে এবং তার ও জনগণের শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন খোলা তরবারি হাতে।

ঘটনাটি ১৯৫৪ সালের ২৬ অক্টোবর তারিখের। নাসের তখন রাষ্ট্রের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদের অধিকারী।  ঘটনার দিন আলেকজান্দ্রিয়া নগরীতে তিনি লাখো লোকের সমাবেশে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। মিসরসহ আরব বিশ্বের সব রেডিও সেদিনের বক্তৃতা লাইভ প্রচার করছিল। আততায়ী মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য মোহাম্মদ আবদুল লতিফ মাত্র ২৫ ফুট দূর থেকে নাসেরকে উদ্দেশ করে পর পর ৮টি গুলি ছুড়ল। সব গুলি ব্যর্থ হলো। তবে একটি গুলি নাসেরের হাতে লেগে রক্ত ঝরতে লাগল। উপস্থিত লাখো জনতা প্রচণ্ড ভয় এবং আতঙ্কে দৌড়াদৌড়ি শুরু করল। এই অবস্থায় নাসের স্থির হয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা চালিয়ে গেলেন। তিনি আবেগঘন কণ্ঠে বললেন, আমার প্রাণপ্রিয় দেশবাসী! ওরা আমাকে গুলি করেছে, আপনাদের নয়। এই দেখুন আমার রক্ত ঝরছে কিন্তু আমি আপনাদের ছেড়ে যাইনি— আপনারা দাঁড়ান, স্থির হন, আমাকে ছেড়ে যাবেন না। আমার শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে বের হওয়া রক্ত আপনাদের জন্য এবং মিসরের জন্য উৎসর্গ করলাম। আমি আপনাদের জন্য বেঁচে থাকব এবং আপনাদের সম্মান এবং স্বাধীনতার জন্য মরে যাব। তারা আমাকে মেরে ফেলুক, এটা নিয়ে আমি চিন্তিত নই, কারণ আমি আপনাদের হৃদয়ে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, সম্মানবোধ এবং গর্বের বীজ বপন করতে পেরেছি।  যদি গামাল আবদেল নাসের মারা যায়, তবে আপনারা সবাই হবেন একজন গামাল আবদেল নাসের... গামাল আবদেল নাসের আপনাদের লোক, আপনাদের মধ্য থেকে পয়দা হয়েছে এবং সে তার জীবনটি মিসরবাসীর জন্য উৎসর্গ করতে চায়।

লেখক : কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর