রবিবার, ১ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হোক

প্রভাষ আমিন

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হোক

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়, বেড়ে যায় যানবাহনের ভাড়াও। কারণটা খুব স্বাভাবিক। পণ্য, যাত্রী পরিবহনসহ সব ধরনের যানবাহন চালাতে তেল লাগে। তাই তেলের দাম বাড়লে সরাসরি প্রভাব পড়ে যানবাহনে। বগুড়া থেকে যে ট্রাক চাল বা সবজি নিয়ে ঢাকায় আসবে তার খরচ বেড়ে যাবে, ফলে ভাড়া বেড়ে যাবে। এ কারণে সেই সবজি বা চালের দাম বেড়ে যাবে। জ্বালানি তেলের দাম যাই হোক, পরিবহন মালিকরা তো আর চাইলেই ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়াতে পারেন না। ভাড়া বাড়ানোর জন্য তো সরকারের সিদ্ধান্ত লাগবে, নিয়ম মানতে হবে। কিন্তু পরিবহন মালিকদের মোটেই তর সয় না। সরকারি সিদ্ধান্ত আসার আগেই তারা ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে দেন। রাজপথে চলে একধরনের নৈরাজ্য। যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের ঝগড়া হয়, মারামারি হয়। সরকার ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেও সে নৈরাজ্য পুরোপুরি নিরসন হয় না।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে ভাড়া বাড়ানোটা যদি স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী হয়; মালিকরা যদি সরকারি সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা না করে ভাড়া বাড়িয়ে দেন; তাহলে তেলের দাম কমলে তো উল্টাটা হওয়ার কথা, মানে ভাড়া কমার কথা, নিত্যপণ্যের দাম কমার কথা। জ্বালানি তেলের দাম কমেছে সপ্তাহ পেরিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত যানবাহনে বা বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। মালিকরা বাড়ানোর সময় নিজ দায়িত্বে করলেও, কমানোর প্রশ্নে গাইগুই। সরকার এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। পত্র-পত্রিকায় দেখেছি, সরকার ভাড়া পুনঃনির্ধারণে ব্যয় বিশ্লেষণ করছে। দেখুন আমি কিন্তু ‘ভাড়া কমানো’ লিখিনি ‘ভাড়া পুনঃনির্ধারণ’ লিখেছি। কারণ আমার শঙ্কা, যানবাহন মালিকরা ভাড়া কমানো তো দূরের কথা, বাড়ানোর দাবি করতে পারে। পত্রিকায় দেখলাম, যানবাহন ব্যবসার সঙ্গে ২২টি উপকরণ সংশ্লিষ্ট। তার মধ্যে মাত্র একটি, মানে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে, বাকি সবকিছুর দাম নাকি বেড়েছে। তাই তাদের ব্যয় বেড়েছে। তা ছাড়া সর্বশেষ ২০১৩ সালে যানবাহন ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল। এতদিনে সবকিছুর দাম বেড়েছে, টাকার দাম কমেছে। আর সবকিছুর দাম বছর বছর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লে যানবাহনের ভাড়া কেন তিন বছর স্থির থাকবে। ফিসফাঁস যা শুনছি, তাতে সরকার ডাকলে পরিবহন মালিকরা ভাড়া বাড়ানোর দাবি তুলবেন। সাধারণ মানুষ দাবি তুলতে পারে, ভিক্ষা চাই না, কুত্তা সামলাও।

তবে এই জটিল পরিস্থিতির জন্য যানবাহন মালিকদের যতটা দায়, তার চেয়ে অনেক বেশি দায় সরকারের অবিমৃষ্যকারী সিদ্ধান্তের। ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি জ্বালানি তেল বিক্রি করে সরকারের লস হয়। গরিব মানুষের স্বার্থে সরকার ডিজেল-কেরোসিন বিক্রি করে ভর্তুকি দিয়ে। এই খাতে সরকারের হাজার হাজার কোটি লস। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যায় তেলের দাম। মনে আছে, বাংলাদেশে যখন প্রথম বোতলজাত মিনারেল ওয়াটার বাজারে এলো, তখন এক লিটার পানির দাম এক লিটার অকটেনের চেয়ে বেশি ছিল। আমরা তখন হাসাহাসি করতাম, এত দাম দিয়ে কেউ পানি কিনে খাবে! আমাদের থোঁতা মুখ ভোঁতা করে পানির ব্যবসা এখন জমজমাট। তবে পানির দাম নাগালে থাকলেও, অকটেনের দাম নাগাল ছাড়িয়েছে অনেক আগেই।

তবে বছরখানেক ধরেই আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে। এতদিন যে খাতে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা লস হতো, সেখানে লাভ হতে থাকল। কিন্তু সরকার তো আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়। তাদের দায়িত্ব জনগণের সেবা করা, ব্যবসা করা নয়। তাই সবাই দাবি করছিল, তেলের দাম কমানোর। আগের লস পোষানোর দোহাই দিয়ে সরকার অনেক দিন ধরেই কম দামে কিনে বেশি দামে তেল বিক্রি করছিল। বাংলাদেশে সাধারণত জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, কমে না। শেষ পর্যন্ত সবার দাবির মুখে হলেও সরকার তেলের দাম কমিয়ে একটা নজির সৃষ্টি করল। তবে তারপরও সরকারের লাভ থাকবে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অনেক কম। কিন্তু বাংলাদেশে যেভাবে তেলের দাম কমানো হয়েছে তাতে সরকারের লাভ কম হবে, জনগণেরও কোনো লাভ হবে না। এই অদ্ভুত জটিল পরিস্থিতি একটু ব্যাখ্যা দাবি করে। সবচেয়ে বেশি কমেছে ফার্নেস অয়েলের দাম, লিটারে ১২ টাকা। কিন্তু ফার্নেস অয়েলের সাধারণ ব্যবহার নেই। কেনা তো দূরের কথা, আমি আপনি কোনোদিন ফার্নেস অয়েল চোখেও দেখব না। কারণ আমাদের কখনো বিদ্যুেকন্দ্র হবে না। শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজেই ফার্নেস অয়েল ব্যবহৃত হয়। এখন ফার্নেস অয়েলের দাম কমালে যদি বিদ্যুতের দাম কমে, তাহলেই শুধু এই দাম কমানো জনগণের কাজে আসবে। কিন্তু আপনারা কেউ কী বিশ্বাস করেন, বিদ্যুতের দাম কমবে? আমি করি না। আমার না করার কারণ হলো খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসিতে বিদ্যুতের দাম কমানোর কোনো প্রস্তাব নেই, বরং দাম বাড়ানোর একাধিক প্রস্তাব ঝুলে আছে। তার মানে ফার্নেস অয়েলের দাম কমায় সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট কয়েকজন বিদ্যুেকন্দ্রের মালিক ছাড়া আর কারও কোনো উপকার হবে না।

সাধারণ মানুষ সরাসরি কেনে বা ব্যাপক মানুষের জীবনমানে ভূমিকা রাখে কেরোসিন ও ডিজেল। এই দুই তেলের দামই কমানো হয়েছে সবচেয়ে কম, লিটারপ্রতি মাত্র তিন টাকা। গ্রামবাংলার বিশাল জনগোষ্ঠী এখন বিদ্যুতের সুবিধাবঞ্চিত। তাদের জীবনে আলোর প্রধান উৎস কেরোসিন। আমরাও ছেলেবেলায় সন্ধ্যা হলেই কুপি-হারিকেন পরিষ্কার করে তৈরি হতাম পড়ার টেবিলে বসার জন্য। এখনো গ্রামে অনেক পরিবার আছে যারা খরচ বাঁচাতে সন্ধ্যায় অল্প সময়ের জন্য কুপি জ্বালায়। তেমন পরিবারে এক লিটার কেরোসিনে হয়তো ১০ দিন চলে যায়। তার মানে সেই পরিবারের দিনে সাশ্রয় ৩০ পয়সা। হাঁ হাঁ হাঁ। যে দেশে ১০ টাকার নিচে ভিক্ষা দিলে ভিক্ষুক অবজ্ঞাভরে বাঁকা চোখে তাকায়, সে দেশে ৩০ পয়সা সাশ্রয় আসলে মশকারা।

সবচেয়ে বেশি মানুষের জীবনচাকা ঘোরায় ডিজেল। বাস, ট্রাক, লঞ্চ, ট্রেন— সব ধরনের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চলে ডিজেলে। যে কৃষকরা আমাদের খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন তাদের অতি প্রয়োজনীয় সেচপাম্প চলে ডিজেলে। সেই ডিজেলও যেন কেরোসিনের মতো দুয়োরানী, তার দামও কমেছে লিটারে তিন টাকা। তাই ডিজেলের দাম কমলে সেচপাম্প মালিকের লাভ হবে, কৃষকের নয়। কোনো দয়ালু পাম্প মালিক সেচের দাম কমালেও তা হবে নেহায়েতই অনুল্লেখ্য।

পরিবহন মালিকদের আমরা যতই দোষ দেই, লিটারে তিন টাকা কমলে সেটা হিসাব করে ভাড়া কমানো সত্যি বিব্রতকর হবে। হয়তো মিরপুর থেকে মতিঝিলের ভাড়া কমবে ৫০ পয়সা। বেসরকারি পরিবহনের কথা বাদ দেন, সরকারি লঞ্চ-ট্রেনের ভাড়া কি কমবে? আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি কমবে না। চাহিদা-জনপ্রিয়তা সব থাকার পরও বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি শ্বেতহস্তী। নিজেদের দুর্নীতি আর অদক্ষতার দায় জনগণের ওপর চাপাতে মাত্র কদিন আগে রেলের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এক্ষুণি আবার তারা ভাড়া কমাবে, মনে হয় না।

রইল বাকি দুই— অকটেন আর পেট্রল, অনেকটা ফার্নেস অয়েলের মতো সুয়োরানী। এ দুটির দাম কমেছে লিটারে ১০ টাকা। এ দুটিই সচ্ছল মানুষেরা ব্যবহার করে এবং দুটিরই মূল ব্যবহার ব্যক্তিগত গাড়িতে। পেট্রলের মূল ক্রেতা মোটরসাইকেল চালকরা। অনেক ভারতীয় মোটরসাইকেল আছে লিটারে ৫০ কিলোমিটারের বেশি চলে। একজন সাধারণ বাইকারের জন্য দিনে দুই লিটার পেট্রল যথেষ্টরও বেশি। তার মানে তার সাশ্রয় হবে দিনে সর্বোচ্চ ২০ টাকা। ফু। বাইকাররা কি খুশি?

এবার আসি অভিজাত জ্বালানি অকটেনের কথায়। লাইনটি লিখেই নিজেকে অভিজাত অভিজাত লাগছে। কারণ আমিও অকটেনের একজন ক্রেতা। তবে আমার মাসে ১০ লিটারের বেশি লাগে না। সিএনজি প্রচলনের পর ঢাকার রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি বেড়েছে, যানজট বেড়েছে। জ্বালানি খরচ কম হওয়ায় অনেক মধ্যবিত্তও লোনটোন করে একটা গাড়ি কিনে ফেলেন। অফিসের দেওয়া আমার গাড়িটিও সিএনজি কনভার্ট করা। তবে ইঞ্জিন ভালো রাখার জন্য মাসে ১০ লিটারের মতো অকটেন ব্যবহার করতে হয়। তার মানে মাসে আমার সাশ্রয় হবে ১০০ টাকা। সরকার বাহাদুরকে ধন্যবাদ। ভাবছি এ মাস থেকে কোনো একটা ব্যাংকে ১০০ টাকার একটা ডিপিএস খুলে ফেলব। সরকারের জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সিদ্ধান্তে ২০/৩০ বছর পর আমি লাখ টাকার মালিক হয়ে যাব। অবশ্য দুটো শর্ত আছে। যদি এখন কোনো ব্যাংকে ১০০ টাকার ডিপিএস খোলার সুযোগ থাকে এবং যদি ততদিন বেঁচে থাকি। নইলে ডিপিএস-এর টাকায় আমার কবরে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের লোগো দিয়ে একটা স্মৃতিস্তম্ভ বানিয়ে দেওয়া যেতে পারে। ঢাকার যানজট নিরসনে আমার অনেক প্রস্তাবের প্রথমটি হলো, ব্যক্তিগত গাড়িতে সিএনজি কনভারসন বন্ধ করে দেওয়া এবং অকটেনের দাম দ্বিগুণ করে দেওয়া। তাতেই নাটকীয়ভাবে যান কমে যাবে, জটও কমে যাবে। গাড়িওয়ালারাই যদি মাসে ১০ লিটার অকটেন কেনে, তাহলে অকটেনের মূল ক্রেতা কারা? এবার আসুন আসল পয়েন্টে। যারা জানেন সিএনজি কনভার্ট করলে ইঞ্জিনের ক্ষতি, গাড়ির পারফরম্যান্স খারাপ হয়ে যায়; তারা এই সামান্য তেল খরচ বাঁচাতে গাড়ি কনভার্ট করেন না। কোটি টাকা দামের বিলাসবহুল গাড়ির জন্য যাদের অনেক মায়া, তারাই অকটেনের একচেটিয়া গ্রাহক। তারা ট্যাংকি ভরে ভরে অকটেন কেনেন। হয়তো মাসে তাদের ১০ হাজার টাকার কম তেল খরচ হবে, কিন্তু সে হিসাব করার সময় নেই তাদের। আর তাদের কাছে ১০ হাজার টাকা আর আমাদের কাছে ১০০ টাকা সমান।

তার মানে জ্বালানি তেলের সুফল যাবে শতকরা হিসাবে ভগ্নাংশেরও কম মানুষের পকেটে। আর তেলের দাম না বাড়ানো হলে সরকারের লাভ হবে হাজার কোটি টাকা। জনগণের দাবি মেনে তেলের দাম কমিয়েছি, সরকারের এটুকু আত্মপ্রসাদের চেয়ে সরকারের লাভটা আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রিজার্ভ রেকর্ড ছাড়ালে আমরা গর্বিত হই, রিজার্ভ চুরি হলে ক্ষুব্ধ হই। সরকারের আয় বাড়লে ঘুরেফিরে সেটা মাথাপিছু আয়ের ভার্চুয়াল হিসেবে হলেও আমার মাথায় কিছুটা পড়বে। আমার আশঙ্কা, জ্বালানি তেলের কম লাভ পোষাতে বাজেটে অন্য কোনো খাতে কিছু একটা চাপিয়ে দেবে। তার চেয়ে হয় কেরোসিন-ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ২০ টাকা কমানো হোক, নইলে দাম কমানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হোক।

পুনশ্চ: অবশ্য যারা জায়গামতো তেল দিতে পারেন তাদের এসব জ্বালানি তেলের দাম বাড়া-কমায় কিচ্ছু যায় আসে না। একটু হাত কচলানো, একটু তেলতেলে কথা, মোক্ষম প্রশংসা, একটু আনুগত্যে কত হাজার লিটার তেলের ব্যবস্থা হয়ে যায়। তারাই সুখে আছেন। আমরা এসব ৩ টাকা, ১০ টাকা, ১২ টাকা নিয়ে কচলাকচলি করি।

লেখক : সাংবাদিক

[email protected]

সর্বশেষ খবর