মঙ্গলবার, ৩ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

দেশ শাসনে জনগণের অংশগ্রহণ দরকার

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

দেশ শাসনে জনগণের অংশগ্রহণ দরকার

আজ সুপ্রিমকোর্টে কালিহাতী উপ-নির্বাচনের মামলা। শুরু হয়েছিল গত বছর ২১ অক্টোবর মহামান্য হাইকোর্টে মনোনয়ন বৈধ করা নিয়ে। এর আগে কখনো শুনিনি, কোনো আদালত আপিল করে। মনোনয়নপত্রের বৈধতা নিয়ে আদালত হিসেবে আমি নির্বাচন কমিশনে গিয়েছিলাম। রিটার্নিং অফিসারের মতো তারাও আমাদের কাগজপত্র দেখেনি, কথা শুনেনি তাই প্রতিকার পেতে হাইকোর্টে গিয়েছিলাম। হাইকোর্টে প্রতিকার পেয়ে আল্লাহকে শুকরিয়া জানিয়ে ২২ অক্টোবর রিটার্নিং অফিসারের কাছ থেকে প্রতীক পেয়েছিলাম। কোনো নির্বাচনে প্রতীক বরাদ্দের পর ভোট গ্রহণ এবং ফলাফল ঘোষণার আগে আর কারও কিছু করার থাকে না— এটাই চিরাচরিত নিয়ম। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে কেন যেন সে নিয়ম চলেনি। আমি নির্বাচন করি মনে হয় নির্বাচন কমিশন তা চায় না। তাই ৭ দিন পর সুপ্রিমকোর্টে আপিল করেছিল, যা তাদের করার এখতিয়ার ছিল না। সুপ্রিমকোর্ট পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচারের জন্য আবার হাইকোর্টের একটি নির্দিষ্ট বেঞ্চে পাঠান। তারা অনেক দিন সময় নিয়ে কোনো বিচার বিবেচনা না করে বলেছিলেন রিটটি মেইনটেনেবল না। বিচার প্রার্থী নির্বাচনের পর ট্রাইব্যুনালে যেতে পারে। মহামান্য আদালতকে কোনো মতেই বোঝানো যায়নি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার কোনো পথ নেই। আমরা আবার আপিল করেছিলাম। অনেক হাটঘাট ঘুরে মহামান্য সুপ্রিমকোর্টে মাননীয় প্রধান বিচারপতির আদালতে আজ বিষয়টি উঠবে। মামলাটি উঠুক, কাগজপত্র দেখে বিচার হোক— যা রায় হবে মেনে নেব। কারণ আমি আমার বিবেকের কাছে পরিষ্কার।

গত পরশু ছিল শ্রমজীবী মানুষের প্রিয় দিন পয়লা মে। আগের দিন এলেঙ্গাতে এক জনসভায় গিয়েছিলাম। এই তীব্র গরমে সভায় অকল্পনীয় লোক হয়েছিল। তাদের দাবি একটাই— ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব। কোনো শয়তানকে দিতে দেব না।’ ‘আমার ভোট আমি দেব, তোমার ভোটও আমি দেব’— সরকারের এমন বাসনায় মনে হয় কালিহাতীতেই কবর রচনা হবে।

মানুষের জীবনের কি ভরসা? ৩০ এপ্রিল শনিবার ১২টা পর্যন্ত গোপালপুর ডুবাইল বাজারের নিখিল চন্দ্র জোয়ারদার নিত্যদিনের মতো কাজ করেছে। অথচ পয়লা মে রবিবার দুপুরে আমি যখন তার বাড়ি যাই, তখন সে ছিল না, পরপারে চলে গেছে। সেখান থেকে আর ফিরবে না। অনেক দিন থেকে শুনছি, সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য এসব পরিকল্পিত হত্যা। নিখিল চন্দ্রের হত্যার ঘটনায় সরকারের কথাতেই আমার বিশ্বাস জন্মেছে। তা না হলে একেবারে হতদরিদ্র সাধারণ একজন দর্জির কাজ করে সংসার চালানো একজনকে ওভাবে হত্যা করতে হবে কেন? প্রথম শুনেছিলাম, গোপালপুরে হিন্দু ব্যবসায়ী নিহত। কিন্তু নিখিল চন্দ্র কিসের ব্যবসায়ী। একা একটি সেলাই মেশিন চালায়। আশপাশে কারও সঙ্গে কোনো ঝগড়া-ফ্যাসাদ ছিল না। ৪-৫ বছর আগে কোনো আসরে ইসলাম এবং মুসলমান নিয়ে, রসুল নিয়ে তর্কবিতর্ক করেছিল। সে জন্য সে জেলও খেটেছে। জেল থেকে ফিরে বাড়ির পাশে মসজিদে সবার কাছে মাফও চেয়েছে। বলেছে, ‘আমি মূর্খ মানুষ। তেমন কিছু না জেনে তর্ক করেছি। দরকার পড়লে জুতা মারেন। কিন্তু মাফ করে দেন।’ সেখানকার মানুষ মাফ করে দিয়েছে। দেখলাম কারওই তার প্রতি কোনো ক্ষোভ ছিল না। যদি ধর্ম নিয়ে তর্ক করায় কাউকে মরতে হয়, তাহলে তো ১-২ কোটি মুসলমানকেও মরতে হয়। তাই এটা কোনো সমাধান নয়। আর সরকারের দারোগা পুলিশ র‌্যাব বিডিআর দিয়ে এসব বন্ধ করা যাবে না। সাধারণ মানুষকে সক্রিয় ও সচেতন করতে হবে। দুর্ভাগ্য আমাদের, বর্তমান সরকার যত কিছুই করুক, দেশ যে মানুষের, তাদেরও যে কিছু করার আছে এটা ভুলিয়ে ফেলেছেন। তাই সাধারণ মানুষের হাত-পা ধরে সরকার যদি তাদের সক্রিয় করতে না পারে তাহলে এসবের প্রতিকার সুদূরপরাহত।

সাহিত্য পত্রিকা ‘কাশবন’-এর সম্পাদক গোপালগঞ্জের মিন্টু হক নির্মলেন্দু গুণের ওপর এক বিশেষ সংখ্যা নিয়ে এসেছিল। তার ইচ্ছা কবি রফিক আজাদকে নিয়ে ওরকম একটি সংখ্যা করার। যেহেতু কবি রফিক আজাদ মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীতে ছিলেন, যেহেতু এখনো আমি বেঁচে আছি, তাই কবি সম্পর্কে আমার কোনো লেখা বা সাক্ষাৎকার পেলে সে ধন্য হয়। ভদ্রলোকের সঙ্গে অনেক সময় নিয়ে কথা হয়। ওরকম বয়স এবং অবস্থানের মানুষের সাহস বা স্বপ্ন থাকে দুর্বার। তার মধ্যেও তা দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি। তাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, ২-১ সপ্তাহের মধ্যে তার আশা পূরণ করব। তিনি কখন সাক্ষাৎকার নেবেন জানতে চাইলে বলেছিলাম, কোনো সাক্ষাৎকার নয়, একটি আস্ত লেখাই দেব।

‘কাশবন’ নির্মলেন্দু গুণ সংখ্যা নেড়েচেড়ে দেখেছি, বেশ কিছুটা পড়েছিও। লেখাগুলো সবই পড়ার মতো। যেখানেই চোখ বুলিয়েছি শেষ না করে ফেরাতে পারিনি। নির্মলেন্দু গুণের মেয়ে ম্যাট্রিক পাস করে ভারতের বাঙ্গালোরে কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে চাচ্ছিল। ‘কবি আমার বাবা’- মৃত্তিকা গুণ এক শ্বাসে পড়েছি। বেশ ভালো লেগেছে।

কবির মেয়ে কবি হবে না, তো কি হবে? মৃত্তিকা গুণ প্রথম কবিতার বই বাবার হাতে দিলে বাবা নাকি বলেছিলেন, ‘কবিদের জীবন বড় দুঃখের। আমি তোর জীবনে দুঃখ দেখতে চাই না।’ সত্য কথা, অনেক কবির জীবনেই খুব একটা সুখ হয় না। কবিতাই তাদের সুখ, কবিতাই তাদের হাসি-কান্না-দুঃখ-বেদনা। নির্মলেন্দু গুণ, কবি রফিক আজাদ কেউ এসবের ব্যতিক্রম নয়। গুণের মেয়ে এক জায়গায় লেখেছে, ‘আমিও কি কারণে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাবা আমাকে এসএসসি পাস করা উপলক্ষে কম্পিউটার কিনে দেন। বাবার অ্যাকাউন্টে তখন মোট ৬০ হাজার টাকা ছিল। সেখান থেকে ৫০ হাজার দিয়ে আমাকে কম্পিউটার কিনে দিয়েছিল। এটা বোধহয় একজন কবি বাবার পক্ষেই সম্ভব।’ আসলে শুধু কবি বাবা নর, বাবার মতো গাধা বড় ভাইয়েরাও অনেক সময় অমনটা করে। আমি এখন টাঙ্গাইলে যে বাড়িতে থাকি, বাড়িটি ছিল টাঙ্গাইল মহকুমা মোক্তার বার। আমার বাবাও ছিলেন সে বারের সদস্য। স্বাধীনতার আগেই মোক্তার বার চলে যায় জেলা সদরে। জমির উকিলের ছেলে শামসুদ্দিন আহমেদ বালু মোক্তার সে সময় আমার ব্যক্তিগত সহকারী। তিনিও বারের সদস্য। একজন মোক্তারের ছেলে বলে বারের সবার আমি ভাতিজা। সে হিসেবে একদিন তারা দল বেঁধে এসে প্রস্তাব দিলেন, ‘বাবা, জেলা সদরে একটা ঘর করতে চাই। তাই মোক্তার বারটা বেচে ফেলব। তুমি যদি নাও মনে হবে ওটা আমাদেরই রইল।’ ভবনটা ৮০-৯০ হাজারের উপরে পছন্দ হচ্ছিল না। আর ৫০-৬০ হাজারের বেশি টাকা দেওয়ার ক্ষমতা আমার ছিল না। একদিন শাহ সাহেব মানে বালু মোক্তার বললেন, ‘১০ ডিসিমল জায়গাসহ বারের দাম সবাই মিলে ঠিক করেছে এক লাখ ৫০ হাজার।’ পরদিন বাবাকে বললাম। বাবা বললেন, ‘বারের অনেকেই তোর মুরব্বি। ছোট বেলায় তারা তোকে কত চা মিষ্টি খাইয়েছে। তাদের সঙ্গে দামাদামি করবি? যদি নিতে পারিস ওই দামেই নিয়ে নে।’ বাবার কথা ফেলি কি করে? তখন দেড় লাখ চাট্টিখানি কথা নয়। আমার কাছে আছে ৫০-৬০ হাজার। ব্যাপারটা বড় ভাইকে বললাম। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী বললেন, ‘আচ্ছা দেখি। ২-৩ দিন পর দিতে পারব।’ কাকে যেন পাঠিয়েছিলাম, ১০০ টাকার নোটের এক ব্যাগ টাকা দিয়েছিলেন। ঠিক মনে নেই, তবে ৮০-৯০ হাজারের কম হবে না। বাবার মতো বড় ভাই ছোট ভাইকে টাকাটা মনে হয় গুনে দেননি।

’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ঘাতকের হাতে নিহত হলে আমার পরিবার ভেঙে তছনছ হয়ে যায়, আমরা হয়ে যাই সর্বহারা। প্রতিবাদ-প্রতিরোধে জীবনবাজি রেখে আমি রাস্তায় বেরুই। বাবা-মা, ভাই-ভাবী সবাই নিঃস্ব রিক্ত। কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা বা গানের মতো, ‘সকাল বেলার আমির রে ভাই, ফকির সন্ধ্যা বেলা।’ প্রায় এক বছর ছোটাছুটির পর অনেক কষ্ট দুর্ভোগ সহ্য করে আবার একত্র হই। আমি মেঘালয়ের তুরায়, বাবা-মা, ভাই-ভাবী পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে। দিন কাটতে থাকে। কংগ্রেস সরকারের পতন হয়। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে আসে জনতা পার্টি। প্রধানমন্ত্রী হন শ্রী মোরারজি দেশাই। মোরারজি দেশাই ইন্দিরা গান্ধীকে পরাজিত করে ক্ষমতায় এসেছিলেন। তাই ইন্দিরাজীকে দুই চোখে দেখতে পেতেন না। সেই না দেখার তোপে পড়ি আমি। শুনেছিলাম, রাক্ষসে মানুষ খায়। মনে হচ্ছিল পারলে মোরারজি দেশাই আমাকে খেয়ে ফেলেন। আল্লাহর অশেষ দয়া আর জনতা পার্টির প্রাণপুরুষ ভারতের দ্বিতীয় গান্ধী সর্বোদয় নেতা শ্রী জয় প্রকাশ নারায়ণের সহযোগিতায় খেতে পারেননি। তাই এখনো বেঁচে আছি। তখন আমার যেমন দুর্দিন, জননেত্রী শেখ হাসিনারও একই রকম দুর্দিন। আমি থাকি বর্ধমানে এবং দিল্লিতে কাকা নগরে, জননেত্রী শেখ হাসিনা থাকেন খান মার্কেটের কাছে পান্ডারা রোডে। ’৮০ সালের দিকে আস্তে আস্তে সবাই চলে আসে। প্রথমে বাবা, তারপর বড় ভাই, বছরের মাঝামাঝি জননেত্রী শেখ হাসিনা। পড়ে থাকি একা আমি। এক সময় সবাই ছিলাম রসুনের কোয়ার মতো। বাবা দেশে ফিরে জেলে যান, তারপর বড় ভাই। ’৮০-র আগেই বেল্লাল চলে এসেছিল। ’৮২-’৮৩-র দিকে আজাদ চলে এসে স্কুলে ভর্তি হয়। শুধু থেকে যায় মুরাদ। সে তখন বর্ধমান রাজ কলেজে পড়ে। সেও দেশে চলে আসতে চায়। একদিন খাওয়ার টেবিলে মাকে বলল, ‘আমি ঢাকায় যেতে চাই। কিছু টাকা হলে ভালো হয়।’ ওর আগে ছোট বোন শাহানার বর আরিফ আহমেদ দুলাল ঢাকা আসা-যাওয়া শুরু করেছিল। তাকে দেওয়া হয়েছিল ১০ হাজার। মুরাদ দেশে আসবে কি করা যায়? ওইদিনই মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মা, তোমার কাছে ক’টাকা আছে?’ মা বলল, ‘হিসাব না করে বলতে পারব না।’ একটু পর শাড়ির ভাঁজ, কৌটার ভিতর, বালিশের নিচ থেকে বের করে হিসাব করলেন সর্বমোট ২২ হাজার। টাকা-পয়সা মার কাছেই থাকত। আমার কাছে দুই-একশ। এটাই ছিল আমাদের বাড়ির আজীবনের নিয়ম। ২২ হাজার থেকে মা মুরাদকে ২০ হাজার দিয়ে দিলেন। তখন আমাদের মাস চলতে ৫-৬ হাজার লাগত। মুরাদ সেটা শিয়ালদা থেকে বদল করে বাংলাদেশের ৩০-৩৫ হাজার টাকা নিয়ে ঢাকায় আসে। নির্মলেন্দু গুণের মেয়ে মৃত্তিকার কম্পিউটার কেনার কথা পড়ে আমার সেই পুরনো কথা হঠাৎই মনে পড়ল, তাই লিখলাম।

অনেকগুলো পুরনো বই ছিঁড়ে যাওয়ায় সুন্দর করে বাঁধাই করেছিলাম। সেও আবার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর কল্যাণে। তার নাকি বই বাঁধাই করার কারখানা আছে। যদিও আমি দেখিনি। তার বাঁধাই কারখানায় ৫০০-৬০০ বই দিয়েছিলাম। যদিও একই রঙে বইগুলো বাঁধিয়েছেন খুব একটা দর্শনীয় না হলেও বেশ ভালো টেকসই হয়েছে। সেই বাঁধানো বই খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎই হাতে পড়ে খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের ‘প্রসঙ্গ শেখ মুজিব’ নাড়াচাড়া করতে করতে দেখি বইটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া, ‘স্নেহের বজ্রকে শুভেচ্ছাসহ- আপা। ১১/০২/৮৮।’ বইটিতে অবিভক্ত বাংলা নিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শরৎ বসু, আবুল হাসেম ও অন্যদের চেষ্টা, অন্যদিকে খাজা নাজিম উদ্দিন, আবুল কালাম আজাদ ও অন্যদের শুধু ক্ষমতায় জাঁকিয়ে বসার বাসনার চমৎকার ছবি তুলে ধরেছেন। বইটি এক শ্বাসে শেষ করার মতো। বইটি যখন পড়ছিলাম তখনই ‘কাশবন’ এর নির্মলেন্দু গুণ সংখ্যা হাতে আসে। ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও বাড়া ভানে’। ছেলেবেলায় লেখাপড়া করিনি বলে এখন কোনো কিছু পেলেই পড়তে ইচ্ছে করে। তাই ‘কাশবন’ও এপাতা ওপাতা উলট-পালট করছিলাম। হঠাৎ দেখি নির্মলেন্দুর লেখা শেখ হাসিনার চিঠি। চিঠিটি পড়ে ভীষণ ভালো লাগে, অভিভূত হই। খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের ‘প্রসঙ্গ শেখ মুজিব’ আর নির্মলেন্দু গুণের কাছে হাসিনার চিঠি দুটোই দেখি ’৮৮ সালের। এ এক অতুলনীয় অসাধারণ চিঠি। তাই তুলে দিলাম—

“বন্ধুবরেষু গুণ,

আপনার অনুরোধে কিছু ছবি পাঠালাম। তবে আমার একটা অনুরোধ রাখবেন। ‘ত্রাণ বিতরণ করছি’ এ ধরনের কোনো ছবি ছাপাবেন না। মানুষের দুর্দশার ছবি যত পারেন ছাপান। আমার ধারণা এ ধরনের অর্থাৎ ত্রাণ বিতরণের ছবি টেলিভিশন ও খবরের কাগজে দেখে দেখে মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছে।

ওরা গরিব, কিন্তু সেটা কি ওদের অপরাধ? একশ্রেণি যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ না করত তাহলে এরা কি গরিব হতো? কার ধন কাকে বিলাচ্ছে? যা কিছু আছে সকলে মিলে ভাগ করে ভোগ করলে একের কাছে অপরের হাত পাতার প্রয়োজন হতো না, ওদেরই সম্পদ লুট করে সম্পদশালী হয়ে আবার ওদেরই দুর্দশার সুযোগ নিয়ে সাহায্য দানের নামে হাতে তুলে দিয়ে ছবি ছাপিয়ে ব্যক্তিগত ইমেজ অথবা প্রতিষ্ঠা লাভের প্রয়াস আমি মানসিকভাবে কিছুতেই মেনে নিতে পারি না, আমার বিবেকে বাধে। তবুও অনেক সময় পারিপার্শ্বিক চাপে পড়ে অনেক কিছুই করতে হয়। আমিও করি। বিবেকের টুঁটি চেপে ধরে অনেক সময় সমাজ রক্ষার তাগিদে, সাথীদের অনুরোধ বা অপরের মান রক্ষার জন্য এ ধরনের কাজ বা ছবি তুলতে হয় বৈকি। তবে যে যাই দান করুক না কেন, বিলি করুক না কেন, এটা তো ওই গরিব মানুষগুলোর অধিকার, তাদেরই প্রাপ্য। ক্ষমতার দাপটে কেড়ে নেওয়া ওদেরই সম্পদ অথবা ওদের পেটের ক্ষুধা দেখিয়ে দেশ-বিদেশ থেকে ভিক্ষে এনে এদের দান করা। এখানে ‘ক্রেডিট’ নেওয়ার সুযোগ কোথায়? এই ‘ক্রেডিট’ নিতে যাওয়াটা কি দুর্বলতা নয়? আত্মপ্রবঞ্চনা নয়? কতকাল আর বিবেককে ফাঁকি দেবে? এই গরিব মানুষগুলোর মুখের গ্রাস কেড়ে খেয়ে আবার এদেরই হাতে ভিক্ষে তুলে দিয়ে ছবি ছাপিয়ে ইমেজ তৈরির পদ্ধতি আমি পছন্দ করি না। আমি মনে করি যা দান করব তা নীরবে করব, গোপনে করব। কারণ এটা লজ্জার ব্যাপার, গর্ব করার ব্যাপার মোটেই নয়। গর্ব করার মতো কাজ হতো যদি এই সমাজটাকে ভেঙে নতুন সমাজ গড়া যেত। গর্ব করার মতো হতো যদি একখানা কাঙালের হাতও সাহায্যের জন্য বাড়িয়ে না দিত। ফুটপাথে কঙ্কালসার দেহ নিয়ে ভিক্ষের হাত না বাড়াতে সেটাই গর্ব করার মতো হতো।

যে স্বপ্ন আমার বাবা দেখেছিলেন, সে দিন কবে আসবে?

আমার অনুরোধ আপনার কাছে, সেই ছবি ছাপাবেন না যে ছবি হাত বাড়িয়েছে সাহায্য চেয়ে আর সেই হাতে কিছু তুলে দিচ্ছি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে। অনেকেই তুলে থাকেন। আমার বড় অপরাধী মনে হয় নিজেকে। লজ্জা হয় গরিব মানুষদের কাছে মুখ দেখাতে। আমরা সমাজে বাস করি। দুবেলা পেট পুরে খেতে পারি। ভালোভাবে বাঁচতে পারি। কিন্তু ওরা কি পাচ্ছে? ওদের নিয়ে এ ধরনের উপহাস করা কেন? ওরা বরদাশত করবে না একদিন জেগে উঠবেই— সেদিন কেউ রেহাই পাবে না।

আমার অনুরোধ আশা করি রাখবেন।

শুভেচ্ছান্তে—

শেখ হাসিনা

৯.১০.৮৮”

কি চমৎকার চিঠি! একটা মানুষ মানুষকে কত ভালোবাসলে এভাবে হৃদয় উজাড় করে কাউকে লিখতে পারেন। এমন অসাধারণ চিঠি লিখতে বা অভিব্যাপ্তি ব্যক্ত করতে শতজনমের সাধনার প্রয়োজন। মোহাম্মদ ইলিয়াসের বই দিয়েছিলেন ১১/০২/৮৮ সালে, কবি নির্মলেন্দু গুণকে লিখেছেন ৯/১০/৮৮। ওই সময় এ ধরনের বহু অসাধারণ চিঠি তিনি আমায় লিখেছেন।

আবার কি কখনো আমরা ’৮৮ সালের মন-মানসিকতা, চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণার জননেত্রী শেখ হাসিনাকে পাব, নাকি প্রধানমন্ত্রী আর বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা এক নন? আমি তো কায়মনে সেই একই মানুষ দেখতে চাই। তেমন হলে কতই না ভালো হয়।

     লেখক : রাজনীতিক।

সর্বশেষ খবর