শিরোনাম
বুধবার, ৪ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

গণতন্ত্র এবং আজকের বিএনপি

আবু হেনা

গণতন্ত্র এবং আজকের বিএনপি

দীর্ঘ ৪৫ বছর পর আমরা আজও যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি তা এক কথায় গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। আজ এ কথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি রচনা করেছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এক মহৎ আকাঙ্ক্ষা। ১৯৪৭-পরবর্তী পাকিস্তান রাষ্ট্রে যে স্বৈরতান্ত্রিক কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর শাসন গণতন্ত্রকে শৃঙ্খলিত করে বাংলাদেশকে অন্তর্লীন উপনিবেশে পরিণত করেছিল তার বিরুদ্ধে অবিরাম গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিয়ে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল এদেশের অগণিত মানুষ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত পথ ধরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়েই চুয়ান্নর নির্বাচনে জাতি যুক্তফ্রন্টকে জয়যুক্ত করে। কিন্তু গোষ্ঠীস্বার্থে অন্ধ পাকিস্তানি শাসকচক্রের বিরোধিতার কারণে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকার সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়, এর কারণ একটাই— গণতান্ত্রিক সংসদীয় পদ্ধতিতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন কায়েম হলে বাংলাদেশের মানুষ তাদের সমঅধিকার এবং সমমর্যাদা পাবে এবং তাতে পাকিস্তানি সিভিল-মিলিটারি আমলাদের আধিপত্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। গণতন্ত্রকে প্রতিহত করার জন্যই ১৯৫৮ সালে আইউব খানের সামরিক জান্তা পাকিস্তানি সিএসপি অফিসারদের সঙ্গে ক্ষমতার অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে অশুভ আঁতাত করে সামরিক শাসন জারি করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল পরিকল্পিতভাবে গণতন্ত্রের চিরায়ত ধারণাকে মানুষের মন থেকে মুছে ফেলে মৌলিক গণতন্ত্রের নামে রাষ্ট্রপতি নিয়ন্ত্রিত বিকৃত গণতন্ত্র চালু করা। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠরা সংখ্যালঘুদের শাসনাধীন হবে এবং পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থবাদ অক্ষুণ্ন থাকবে। এটা করতে আইয়ুব খান প্রতি জেলায় ডেপুটি কমিশনার পদ সৃষ্টি করে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাদের সর্বময় ক্ষমতাশালী শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বিলুপ্ত হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলে সৃষ্ট নির্বাচিত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের পদ। রাজনীতিবিদদের ওপরে নেমে এসেছিল নির্যাতন আর নিবর্তনের খড়গ। অগ্রভাবে চলে এসেছিল সরকারি মদদপুষ্ট ‘বেসিক ডেমোক্র্যাট’।

এই প্রেক্ষাপটেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন-সংগ্রামে নেমে আসে এদেশের ছাত্র-কৃষক, শ্রমিক-জনতা, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরে বাংলা ফজলুল হক এবং আরও অনেক নেতা। আইয়ুব শাহীর উদ্দেশ্য ছিল গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বদলিয়ে দিয়ে সামরিক জান্তা কর্তৃক প্রবর্তিত ‘মৌলিক গণতন্ত্র’কেই আসল গণতন্ত্র বলে চালিয়ে দেওয়া। এটা করতে গিয়ে তারা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ধাঁচে গড়া জেলা প্রশাসককে ব্যবহার করেছিল।

স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্রকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। এই সুযোগটি এসেছিল ১৯৭০-৭১-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এই নির্বাচনের অপরিসীম গুরুত্বের কথা তিনি ছাড়া আর কেউ গভীরভাবে অনুভব করেনি। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ষাট দশকের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিবর্তনের ফলে পাকিস্তানি রাষ্ট্র ব্যবস্থা ভেঙে ফেলে বাংলাদেশি নতুন রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামো গড়ার প্রেরণা তখন অপ্রতিরোধ্য। এই নির্বাচনে অংশ নিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতি স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়, এদেশের মানুষ খুঁজে পায় একজন বিশ্বাসযোগ্য নেতাকে আর বঙ্গবন্ধুও খুঁজে পান আত্মদানে প্রস্তুত স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ একটি ঐক্যবদ্ধ দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ জনশক্তিকে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যা কোনো দিন কল্পনা করেনি নির্বাচনের মাধ্যমে এদেশের জনগণ সেই অকল্পনীয় ঘটনাটিই ঘটিয়ে দিল। পাকিস্তানি জাতীয় সংসদে ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয়যুক্ত করে এদেশের মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রায় দিল। গণরায়ের কাছে নতি স্বীকার করে ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় সংসদ অধিবেশন আহ্বান করল। তার পরিকল্পনা ছিল রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থেকে সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নামসর্বস্ব প্রধানমন্ত্রী রেখে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। কিন্তু তার সব আশা ধুলায় মিলিয়ে গেল ১ মার্চ ১৯৭১-এর প্রথম প্রহরেই। দিনের শুরুতে আওয়ামী লীগ দলীয় সব জাতীয় সংসদ সদস্য (এমএনএ) এবং প্রাদেশিক আইন পরিষদ সদস্যরা পূর্বাণী হোটেলে মিলিত হয়ে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি গঠন করে। তারপর সেই পার্লামেন্টারি পার্টি শেখ মুজিবুুর রহমানকে পার্লামেন্টারি পার্টির সভাপতি এবং সংসদ নেতা নির্বাচিত করে। ফলে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে তিনি অঘোষিতভাবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হয়ে যান। সংসদীয় পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি সংসদ নেতাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ পড়াতে বাধ্য। একই সঙ্গে একই পার্লামেন্টারি পার্টিকে সংবিধান রচনার ক্ষমতা দিয়ে কনসটিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে রূপান্তরিত করা হলো। পার্লামেন্টারি পার্টির চিফ হুইপ হলেন প্রফেসর ইউসুফ আলী আর হুইপ নির্বাচিত হলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। এরপর ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করা হলো। সংসদীয় গণতন্ত্রের পৃথিবীব্যাপী প্রচলিত বিধিনিয়মের জালে আটকা পড়ে ইয়াহিয়া খান উপায়ান্তর না দেখে ৩ মার্চ সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করল। আর এরই সঙ্গে শুরু হলো স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া। পার্লামেন্টারি পার্টি বঙ্গবন্ধুকে সর্বোচ্চ নেতা ঘোষণা করে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তার হাতে অর্পণ করল। তিনি বাংলাদেশে তার শাসন জারি করে রাষ্ট্রীয় কাজে পাকিস্তানি জান্তার সঙ্গে এদেশের মানুষের সব সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। সেই নির্দেশ মান্য করে হাইকোর্টের চিফ জাস্টিস বিএ সিদ্দিকী সামরিক আইন প্রশাসক ও গভর্নর হিসেবে জেনারেল টিক্কা খানকে শপথ পড়াতে অপারগতা জানালেন। দেশব্যাপী অসহযোগ শুরু হলো। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা, মুক্তি সংগ্রামের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন। একই সঙ্গে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ প্রত্যাখ্যান করলেন। প্রবল আন্দোলনের স্রোতে সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, মজদুর জনতা পাকিস্তানি রাষ্ট্র কাঠামোর কৃত্রিম ভিত ভেঙে চুরমার করে দিল। দিশেহারা পাক হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞ চালালো ঢাকাজুড়ে। একই সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরনগরীতে আর একটি নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছিল। চট্টগ্রাম বন্দরে ‘সোয়াত’ জাহাজ থেকে অস্ত্র-গোলাবারুদ খালাস করার জন্য অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবদুর রশীদ জানজুয়া ক্যাপ্টেন চৌধুরী খালেকুজ্জামানকে আদেশ দেন। পরে মত বদলিয়ে রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমানকে বললেন, ‘জিয়া তুমি প্রথমে যাও। খালেক তোমাকে ফলো করবে।’ যেহেতু আর্মিতে আদেশ অমান্য করা যাবে না, তাই জিয়া গাড়িতে উঠলেন। সঙ্গে দুজন পাকিস্তানি অফিসার। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের ভাষ্য অনুযায়ী মেজর জিয়া তাকে পাশে ডেকে নিয়ে বললেন, কোনো খবর থাকলে জানাবে। তিনি বুঝতে পারলেন জিয়া তাকে কি মেসেজ দিলেন। তার কিছুক্ষণ পরই ঢাকা থেকে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের সিনিয়র ভিপি আবদুল কাদের তাকে ফোনে জানালেন ঢাকায় গোলাগুলি চলছে, পিলখানা, ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস, রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার আক্রান্ত হয়েছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন ‘তোমরা কি করছ?’ ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান পরক্ষণেই একটি পিকআপ নিয়ে মেজর জিয়ার কাছে ছুটে গেলেন। খবর শুনে বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক জিয়াউর রহমান বেঙ্গল রেজিমেন্টের নেতৃত্ব নিজ হাতে তুলে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন অষ্টম বেঙ্গল বিদ্রোহ করবে। তার নেতৃত্বে ২৫ মার্চের মধ্যরাতে অষ্টম বেঙ্গলের বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করলেন। পাকিস্তানি অফিসার ও জোয়ানদের লাইন করে ব্রাশফায়ার করা হলো। মেজর জিয়া কর্নেল জানজুয়াকে নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করে চট্টগাম শহরসহ কালুরঘাট এলাকা পর্যন্ত অষ্টম বেঙ্গলের দখলে নেন। পরে তিনি কালুরঘাট রেডিও ট্রান্সমিটার সেন্টারটি বাঙ্কার দিয়ে সুরক্ষিত করে প্রথম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করেন এবং সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণাটি ছিল চট্টগ্রামস্থ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অধিনায়কের পক্ষ থেকে। সেই কারণেই এই বার্তাটি বেতারে প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার খবর ছড়িয়ে পড়ে এবং সমগ্র জাতি স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পূর্বাণী হোটেলে যে পার্লামেন্টারি পার্টি গঠিত হয়েছিল তার সদস্যরা পাকিস্তান জাতীয় সংসদে এমএনএ এবং পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে এমএলএ হিসেবে এদেশের জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন, পাকিস্তানের সংবিধান রচনা এবং কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার গঠন করার জন্য। সেদিন এই পার্লামেন্টারি পার্টি শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সংসদ নেতা, অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে চিফ হুইপ এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে হুইপ নির্বাচিত করেছিল। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ একই ব্যক্তি হুইপ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ রচনা করেন এবং চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ পাঠ করেন।

পাকিস্তান জাতীয় সংসদের সংসদ নেতা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা দেন। ১৯৭১ সালের মার্চের ১ তারিখ আওয়ামী লীগ পার্টি ছয় দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করেছিল। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের একই জনপ্রতিনিধিরা স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করেন। জনগণের দ্বারা তাদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত প্রকৃত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতার কোনো পরিমাপ এবং কার্যপরিধির কোনো সীমারেখা নেই। ইতিহাসের চোখে তারা চিরদিনই ‘জনপ্রতিনিধি’, ‘পার্লামেন্টারি পার্টির’ সদস্য। যারা তাদের নির্বাচিত করেন এরা তাদেরই ইচ্ছায় চলেন, তাদেরই আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেন। বিএনপি শাসনামলে ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিএনপি ২০৭টি আসনে জয়ী হয়ে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। আওয়ামী লীগে তখন দুই ভাগ আবদুল মালেক উকিলের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ ৩৯টি আসনে জয়ী হয়। অন্যদিকে মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে অন্য গ্রুপটি দুটি আসন পায়। ফলে আওয়ামী লীগ (মালেক) মূলধারার আওয়ামী লীগ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যায়। এই সংসদ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে সে সময় অবধি জারি হওয়া সব আদেশ বৈধকরণ করে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জিয়াউর রহমান বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করেন। তিনি নিজে চেয়ারম্যান এবং অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে দলের মহাসচিব করে ১২ সদস্যের স্থায়ী কমিটি গঠন করেন। মহাসচিব নিযুক্ত হওয়ার পর ২৩ আগস্ট, ১৯৭৯ বদরুদ্দোজা চৌধুরী মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এই সংসদ ছিল বাংলাদেশের তৃতীয় সংসদ। এর উপনেতা ছিলেন তৎকালীন উপ-প্রধানমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। পদত্যাগের আগে বি চৌধুরী উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। এর আগে তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়ার উপদেষ্টাও ছিলেন। ১৯৯১-এ সংসদ উপনেতা ছিলেন।

প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুর পর ১৫ নভেম্বর ১৯৮১ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়। সংবিধানের ৫০ (খ) এর ৬৬(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উপ-রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ার যোগ্য ছিলেন না। ১৯৮০ সালের ১০ জুলাই সংবিধানের ষষ্ঠ সংশোধনীর মাধ্যমে বিএনপি পার্লামেন্টারি পার্টি তাকে নির্বাচনের যোগ্য করে তোলে। বিএনপি এই নির্বাচনে ১৯ দফার পক্ষে ভোট চায়। বিপরীতে আওয়ামী লীগ ১৭ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে, ফলাফলে বিএনপি প্রার্থী বিচারপতি সাত্তার শতকরা ৬৫ দশমিক ৮০ ভাগ ভোট পেয়ে জয়ী হন।

গণঅভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর দেশে ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাকে বিএনপি ১৪০টি আসনে জয়ী হয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সংরক্ষিত মহিলা আসনের ৩০টির মধ্যে ২৮টি। আওয়ামী লীগ ৮৮টি আসনে জয়ী হয়। বিএনপি পার্লামেন্টারি পার্টি বেগম জিয়াকে পার্লামেন্টারি পার্টির চেয়ারপারসন এবং সংসদ নেতা নির্বাচিত করলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি তাকে ২০ মার্চ প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন।

কিছুদিন না যেতেই সংসদীয় গণতন্ত্রের আকাশে আবার কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা দেয়। ১৯৯৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর এবার আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানায়। এ জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া বিরোধী দলের অসাংবিধানিক বলে প্রত্যাখ্যান করেন। ২৮ ডিসেম্বর ১৯৯৪ আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সদস্যরা পদত্যাগ করেন। এরপর সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭২ থেকে ৯৬ ঘণ্টা হরতাল, অবরোধ উপেক্ষা করে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে আন্দোলন আরও তীব্রতর হলে ২৬ মার্চ ১৯৯৬ গভীর রাতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বিল পাসের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা স্থগিত হয়। পরবর্তী ১৯৯৬ সালের ১২ জুন নির্বাচনে বিএনপি ১১৬ আসনে জয়ী হয়। দীর্ঘ ৫ বছর আন্দোলন সংগ্রামের পর চারদলীয় জোট গঠন করে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ১৯৩টি আসনে জয়ী হয়। এ সময় পর্যন্ত বিএনপি পার্লামেন্টারি পার্টি সংসদীয় গণতন্ত্রে এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ২০০১-এর বিশাল বিজয়ের পর বিএনপি পার্লামেন্টারি পার্টি বাস্তবে তথাকথিত ‘হাওয়া ভবনের’ আজ্ঞাবহ একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। বিএনপির পার্লামেন্টারি পার্টির দুদিনব্যাপী এক বৈঠকে হাওয়া ভবনের কয়েকজন তরুণ সংসদ সদস্যের কারণে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পদত্যাগ দাবি করা হয়। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব এভাবেই দল থেকে বিদায় নেন। সংসদীয় গণতন্ত্রে এটা একটি নিকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এ সময় বিচারপতি কে এম হাসানকে পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার জন্য সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী ও বিএনপি পার্লামেন্টারি পার্টির সিদ্ধান্ত ছিল না। এই সিদ্ধান্তও চাপিয়ে দেওয়া হয়। তারেক রহমানকে নিয়ে দলের ভিতরে ও বাহিরে অনেক আলোচনা-সমালোচনা ছিল। হাওয়া ভবনে বসে তারেক রহমান বিকল্প সরকার চালাতেন, এটাই সবাই বিশ্বাস করতেন। সব মিলিয়ে সময়টা ছিল বিএনপির জন্য ‘পড়ন্ত বেলা’। এরপর বিএনপি আর নতুন সূর্যের মুখ দেখেনি। বিএনপি এখন সংসদে অস্তিত্বহীন। উপজেলা, পৌরসভা নির্বাচন হওয়ার পর এখন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে লজ্জাজনক অবস্থানে চলে গেছে এই দল। এর জন্য দায়ী বর্তমান গুলশান ভবন এবং নয়াপল্টন ভবন। পদ, পদবি, মনোনয়ন সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ এখন এই দুই অফিস থেকে। চলছে সর্বত্র টাকার ছড়াছড়ি। এখানে নির্বাচনের চর্চা হয় না। মনোনয়ন আর কমিটি বাণিজ্য হয়। নতুন নতুন অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। বিএনপির নয়াপল্টন ও গুলশান অফিসের কর্মচারীরা এই ব্যবসা বাণিজ্য তদারকি করছেন। এখানে নির্বাচিতরা উপেক্ষিত। ১৯৭৯ সাল থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ১০৫০টি সংসদীয় আসনে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্যরা আসন গ্রহণ করেছেন। এদের মধ্যে শতাধিক মহিলা সংরক্ষিত আসন বাদ দিলে বাকি সবাই জনগণের ভোটে সরাসরি নির্বাচিত। আজ গুলশান, নয়াপল্টন অফিসে এদের কোনো স্থান নেই। গুলশান ও নয়াপল্টন অফিস কর্তৃক জারিকৃত আদেশের বলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে পরাজিত ২৭০ জন তৃতীয় শ্রেণির বিএনপি দলীয় প্রার্থী প্রতি নির্বাচনী এলাকার দেদার মনোনয়ন বাণিজ্য চালাচ্ছে। ফলে আগামীতে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, ইউপি চেয়ারম্যান দেখতে হলে নয়াপল্টন ও গুলশান অফিসের ‘জাদুঘর’-এর জন্য টিকিট কাটতে হবে। এখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটিই পথ— এসব ভবনে তালা মেরে দিয়ে মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ করে নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক ত্যাগী নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। বিএনপি পার্লামেন্টারি পার্টিকে এতে নেতৃত্ব নিতে হবে। তবেই মুক্তি। না হলে ধ্বংস অনিবার্য।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর