বুধবার, ৪ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

মিসরের সেই রাজপুত্র ও নীরব এক ঘাতক

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

মিসরের সেই রাজপুত্র ও নীরব এক ঘাতক

শব্দদূষণ শব্দটি ইদানীং বেশ প্রচলিত। শব্দ এমন একটি জিনিস যা না থাকলে মানুষের শ্রবণেন্দ্রিয় বিকশিত হতো না। এমনকি শব্দ না থাকলে আমরা কথা বলা শিখতে পারতাম না। শব্দ যে মানুষের কথা বলা শেখার জন্য একটা সুনির্দিষ্ট প্রমাণ তা আমরা যুগে যুগে প্রমাণ করতে পেরেছি। সেই প্রমাণ প্রথম হয়েছিল মিসরে যখন এক রাজার সন্তান কথা বলছিল না, কেন সে কথা বলে না, সে জন্য চিকিৎসকদের ডাকা হলে কেউ কোনো জবাব দিতে পারেননি। একজন রাখাল বালক বলেছিল, সে কানে শোনে না। রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে প্রমাণ করতে বলাতে সে বলেছিল যে, আপনি যে কোনো একটা বাচ্চাকে জন্মের তিন-চার মাস পরে আমাকে দিয়ে দেন আমি যেখানে পশু লালন-পালন করি তাকে নিয়ে চলে যাব সেখানে। ওকে তাদের সঙ্গে রাখব এবং দুবছর পরে দেখবেন যে শিশুটি কোনো কথা বলছে না। সত্যি সত্যিই দুবছর পরে অর্থাৎ আড়াই বছর বয়সে যখন তাকে রাজ দরবারে ফেরত নিয়ে আসা হলো এবং দেখা গেল সে শুধু দুটো শব্দ করতে শিখেছে তার একটি হলো, মেষ চালক যে আওয়াজ করে সন্ধ্যার দিকে মেষগুলোকে তাদের থাকার জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতেন সেই আওয়াজটি আর মেষগুলো যে আওয়াজ করে সেই আওয়াজ। তাত্ত্বিকভাবে আদিকালে প্রথম প্রমাণিত হয় মানুষ কানে না শুনলে কথা বলে না এবং যা শুনে তাই বলার চেষ্টা করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে এই শব্দই আবার দূষণের মাত্রাও ছাড়িয়ে যায়। সাধারণত আমরা যখন ফিস ফিস করে কথা বলি তখন শব্দের মাত্রা থাকে ৩০ ডেসিবেলের কাছাকাছি। আমরা যখন ঘরে বসে, ডাইনিং রুমে বসে, ড্রইং রুমে বসে, আত্মীয় পরিজন বা পরিবার পরিজন পরিবেষ্টিত হয়ে কথা বলি তখন সে স্পিকিং ভয়েজের উচ্চতা থাকে ৫০-৭০ ডেসিবেলের মধ্যে। আর এই শব্দমাত্রা যদি ৮৫ ডেসিবেলের ঊর্ধ্বে চলে যায় তখনই কিন্তু সে শব্দদূষণের মাত্রা অতিক্রম করে যায়। শব্দদূষণ মানুষের শুধু শ্রবণেন্দ্রিয়ের ক্ষতি করে তা নয় এ শব্দদূষণ মানুষের এ ছাড়াও আরও অনেক ক্ষতি করে থাকে যার প্রথমটি হলো মানুষকে স্নায়ুবিক ইরিটেশন করার ফলে মানুষ অল্পতেই রেগে যায় এবং ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। দ্বিতীয়ত, শব্দদূষণ হলে মানুষের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। তৃতীয়ত, শব্দদূষণ হলে আপনি যেভাবে কাজ করা উচিত ঠিক সেভাবে কাজ করতে পারেন না অর্থাৎ ওয়ার্ক স্ট্রেচ হয়। ওয়ার্ক স্ট্রেচ ঘুম না হওয়া দুটো মিলে মানুষের যে ক্ষতি হচ্ছে সেটা হলো তার বুকে ধড়ফড়ানি হতে পারে। রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে এবং রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার ফলে যে রকম হৃদরোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যেতে থাকে তেমনি স্ট্রোক ঘটে যেতে পারে অর্থাৎ ব্রেইনের হেমারেজ। অন্যদিকে শব্দদূষণের মধ্যে যে কোনো কাজই মনোনিবেশ করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে অর্থাৎ কনসেনট্রেশনের অভাব। আর শব্দদূষণের ফলে যোগাযোগেরও ব্যাঘাত ঘটে অর্থাৎ লেক অব কমিউনিকেশন এবং এই Lack of concentration and Lack of communication-এর ফলে সার্বিক অগ্রগতির যেমনি ব্যাঘাত ঘটে, তেমনি যে কোনো কাজে অসংখ্য ভুল থাকে। বেবি কটের উপরে বিভিন্ন রকমের আওয়াজ করে খেলনা ঝুলিয়ে রাখা হয় এবং দেখা যায় যখনই শিশুটি কাঁদে তখনই কেউ বা কারা সেই বেবি কটের যে খেলনাগুলো আছে সেগুলোকে যদি নাড়িয়ে দেয় তাহলে তার কান্না থেমে যায়। অর্থাৎ সে শব্দটা শোনে, শোনার পরে তার হয়তোবা মনস্তাত্ত্বিকভাবে এমন একটা পরিবেশের সৃষ্টি হয় সে আশ্বস্ত হয় তাকে দেখার জন্য কেউ কাছে আছে অথবা তাকে আদর করে সেই শব্দগুলো করা হচ্ছে।  লক্ষণীয় যে আদিকাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত অনেক রঙিন রঙিন খেলনা বা রঙিন ফুল ঠিক কপাল বা চোখের উপরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। যাতে করে শিশুটি ওই রঙিন ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে। এ যে শুধু রঙিন ফুলের দিকে তাকিয়ে শান্তি পাচ্ছে তা নয়। রঙিন ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকার জন্য তার কালার ভিশন অর্থাৎ রং আইডেনটিফাই করার চোখের যে শক্তিটুকু আছে সেটাও অনেকাংশে ভালোভাবে বৃদ্ধি পায়।

যে শব্দদূষণের মাত্রার কথা আমি বলছিলাম, শব্দদূষণের মাত্রা ৮৫ ডেসিবেলের উপরে হলেই সে দূষণসীমার মধ্যে পড়ে যায় এবং শ্রমিকদের জন্য বিশ্ব শ্রম সংস্থা স্বীকৃত একটি আইন রয়েছে যে আইনটির ব্যাখ্যা হলো একজন শ্রমিক ৮৫ বা ৯০ ডেসিবেলে শুধু আট ঘণ্টায় নিজেকে কর্মব্যস্ত রাখতে পারবে এবং যদি পাঁচ ডেসি বেড়ে যায় তাহলে তার কাজের ব্যাপ্তি অর্ধেক কমে যাবে। অর্থাৎ ৯০ ডেসিবেলে আট ঘণ্টা হলে ৯৫ ডেসিবেলে চার ঘণ্টা, ১০০ ডেসিবেলে দুই ঘণ্টা, ১০৫ ডেসিবেলে এক ঘণ্টা, ১১০ ডেসিবেলে মাত্র আধা ঘণ্টা এবং ১১৫ ডেসিবেলে বেড়ে গেলে সে শুধু ১৫ মিনিট কাজ করতে পারবে। আমাদের পরিবেশের আশপাশে যেসব যন্ত্রদানব রয়ে গেছে তাদের এ যান্ত্রিক যুগে যে পরিমাণ শব্দের সৃষ্টি করে থাকে সেগুলোর একটা তালিকা জনসাধারণের অবগতির জন্য পরিবেশ অধিদফতরের পক্ষ থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া উচিত এবং সেই তালিকাগুলো দেখেই আমরা বুঝতে পারব সহজে, কীভাবে, কী পরিমাণ শব্দদূষণ হচ্ছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে কোনো বিনোদনমূলক কনসার্টে যেখানে শব্দমাত্রা ন্যূনতম ১১৫ ডেসিবেল সেখানে দর্শক, স্রোতার সর্বোচ্চ ১৫ মি. অবস্থান করার কথা। আমরা কি তা করি? যেসব জায়গা থেকে স্পেস সাটল অর্থাৎ মহাশূন্যে খেয়াযান নিক্ষেপ করা হয় যেখানে শব্দ ১৮০ ডেসিবেল বা তারও উপরে সেখানে দুই কিলোমিটার রেডিয়াসের ভিতরে যদি কোনো পশুপাখি, জীবজন্তু, এমনকি কোনো মানবদেহের কোনো ক্ষতি হয় তাহলে তার জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও ব্যবস্থা আছে। অর্থাৎ যে সংস্থা মহাশূন্যে গবেষণা করে সেই সংস্থা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকে। তবে এখনো ব্যতিক্রম রয়ে গেছে দুটো, সেটা হলো বিমান এবং রেলগাড়ির শব্দকে। শব্দদূষণের মাত্রা অতিক্রান্ত করে থাকলেও তার জন্য কোনো জরিমানা গুনতে হচ্ছে না। তাদের সেখান থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কেননা পাইলট ইচ্ছা করলেই বিমানের শব্দ কমাতে পারবেন না আর রেলগাড়ির চালক ইচ্ছা করলেও আর রেলগাড়ির শব্দ কমাতে পারবেন না। সুতরাং প্রযুক্তি যদিও সেরকম কোনো কিছু আবিষ্কার করে তাহলে হয়তো ইচ্ছাকৃত শব্দের জন্য তাদের জরিমানা গুনতে হতে পারে।

শব্দদূষণের মাত্রা বিভিন্ন সময়ে স্থানভেদে বিভিন্ন রকম হতে পারে। শব্দদূষণ পরিমাপের জন্য আমরা দিনকে ধরি সাধারণত সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। আর রাত ধরি ৯টার পর থেকে ভোর ৭টা পর্যন্ত। আবার শব্দদূষণের জন্য একটা শহরের বিভিন্ন জায়গাকে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করে থাকি। যেমন আবাসিক এলাকা, স্কুল-কলেজ, হাসপাতালসংলগ্ন এলাকা, ট্রাফিক ব্যস্ত এলাকা অর্থাৎ যান চলাচল ব্যস্ত এলাকা। শিল্প কলকারখানা এলাকা ইত্যাদি। শব্দদূষণ সাধারণত আমরা বলে থাকি সে শব্দকে যে শব্দ অর্থহীন, যে শব্দ অযাচিত এবং যে শব্দ মানুষের মস্তিষ্ক বা দেহের অপূরণীয় ক্ষতের সৃষ্টি করে। শব্দদূষণ বা নয়েজ পলিউশন মাত্রাতিরিক্ত হওয়াটা পানিদূষণ বা বায়ুদূষণের মতোই একটা পরিবেশ দূষণের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সুতরাং পানিদূষণ এবং বায়ুদূষণে যেভাবে পরিবেশের বিঘ্ন ঘটাচ্ছে শব্দদূষণ ঠিক একইভাবে পরিবেশের দূষণ করছে। অনেকেই হয়তো অবগত আছেন যারা পদার্থবিদ্যার ছাত্র, শব্দদূষণ ছাড়াও শব্দের কিন্তু কিছু গুণগত বৈশিষ্ট্য আছে। যে গুণগত বৈশিষ্ট্যগুলো হলো চারটি, তার মধ্যে Pitch, Timbre, Duration ‰es Loudness। শব্দকে যে মাপা যায় সেটা হলো শব্দের গতিবেগ। শব্দের ইনটেনসিটি বা শব্দের উচ্চতা বা শব্দমাত্রা এবং শব্দ তরঙ্গ বা শব্দের ফ্রিকোয়েন্সি। বর্তমান যুগে শব্দের গতিবেগ, শব্দের ইনটেনসিটি এবং শব্দের ফ্রিকোয়েন্সি বা শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করেই মানুষ মহাশূন্য জয় করছে এবং করবে। সমরাস্ত্রের গতিবেগ কীভাবে বৃদ্ধি পাবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

সভ্য দেশগুলোতে আপনি কখনো হর্নের আওয়াজ শুনবেন না। যদি কখনো শোনেন তাহলে ধরে নিতে হবে সাংঘাতিক কিছু ঘটে গেছে। পক্ষান্তরে আমাদের দেশে হর্ন বাজানোটা যেন বাচ্চাদের খেলনা বাজানোর মতো ঘটনা। শব্দদূষণের কারণে অনেক শারীরিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে। বিভিন্ন মাত্রার শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া, মানসিক অশান্তি বা বিরক্তি, রক্তচাপ এবং হৃৎকম্পন বেড়ে যাওয়া, ঘুম না হওয়া, স্ট্রোকসহ নানাবিধ সমস্যা। বিশেষ করে অ্যাম্বুলেন্সগুলো যেভাবে হর্ন বাজায়, সেই হর্ন যদি ভিতরে অবস্থানরত রোগীর কর্ণকুহরে প্রবেশ করত তাহলে জান বাঁচলেও কান বাঁচত না। অপ্রয়োজনে শব্দ সৃষ্টির জন্য দেশে আইন বলবৎ থাকলে, তার প্রয়োগ আমরা লক্ষ করছি না। বায়ুদূষণ এবং পানিদূষণের মতো শব্দদূষণ ও পরিবেশদূষণের জন্য সমানভাবে দায়ী। শব্দদূষণের ফলে কানের যে শুনানি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সে সম্পর্কে আমরা ছাত্রদের 4P সূত্র ধরে বলি— Painless, Progressive, Preventable and Permanent অর্থাৎ শব্দদূষণজনিত কারণে, কানের শুনানি ক্ষতিগ্রস্ত প্রক্রিয়ায় কখনো ব্যথা হয় না, আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। শুরুতে শনাক্ত করা গেলে শ্রুতিহীনতা প্রতিরোধ করা যায় এবং দেরিতে এলে শ্রুতিহীনতা স্থায়ী হয়ে যায়। তখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হন অসহায়।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর