রবিবার, ৮ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

বৃক্ষরূপী মায়ের মায়াময় ছায়াতলে

ড. সুলতানা মোসতাফা

মা দিবসে মাকে নিয়ে লিখতে বসে মার কোন রূপটি নিয়ে লিখব তা-ই ভাবছি। দূর শৈশবে আবছা স্মৃতিতে মা রাত জেগে বেলুচিস্তানের এক শহরে ত্রিভাষায় প্রকাশিত পত্রিকা ‘বোলানের ডাক’-এর সম্পাদনায় ব্যস্ত; নাকি মরুর দেশে বাবার উদ্যোগে বাংলা সাহিত্য সম্মিলনীর সভার আয়োজনে ব্যস্ত মা; সাধ ও সাধ্যের সংমিশ্রণ ঘটানোর লক্ষ্যে মাঝরাতে অনবদ্য ডিজাইনে আমাদের পোশাক তৈরিতে ব্যস্ত মা; কারও রোগশয্যায় নিবিষ্ট মনে সেবারত মা; রকমারি রান্নায় বা অত্যন্ত পরিপাটি সাজে অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত হাস্যোজ্জ্বল মা; নাকি অচেনা দুটো পেয়ারা চোর কিশোরকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর গাড়ি থেকে ছিনিয়ে আনার চেষ্টায় রত রণরঙ্গিনী এবং পরবর্তীতে চৌকস ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও প্রধান শিক্ষকের মধ্যস্থতায় তাদের ছুটিয়ে আনায় সফল অবিচল মা; বন্যায় ঘরহারা নবজাতকসহ সদ্য প্রসূতি অল্প বয়সী অচেনা এক মেয়েকে ফ্ল্যাটের অন্য বাসিন্দাদের প্রবল আপত্তির মুখে সিঁড়িতে আশ্রয় দেওয়া এবং গোপনে তাকে খাবার ও ওষুধ পৌঁছে দেওয়া মমতাময়ী এক মা। এত বিচিত্ররূপী মায়ের যে চিত্রটি সবসময়ই স্থির তা হলো— অত্যন্ত শৌখিন, রুচিশীল ও পরিপাটি সাজের সদ্য হাস্যোজ্জ্বল অপরূপ সুন্দর মা (আক্ষরিক অর্থেই দুধে আলতা গায়ের রং, ধারালো চেহারা), যিনি কোনো অবস্থায়ই মনোবল হারান না, যিনি ভালোবাসেন তার সন্তানদের পরিপাটি, সুসজ্জিত দেখতে। আজ ভাবতে খুব অবাক লাগে একজন অসাধারণ সৎ সরকারি প্রকৌশলীর সীমিত আয়ের সংসারে আমাদের ওই স্বাচ্ছন্দ্যে রাখার জন্য মাকে কি পরিমাণ মেধা ও পরিশ্রমের সংমিশ্রণ ঘটাতে হতো। শুধু তার সন্তানই নয়, অন্যদের ব্যাপারেও মা যেন এক বৃক্ষ, যার ছায়া অনেক দূর বিস্তৃত। আমার দাদাবাড়ির দূরতম কোনো আত্মীয়ের (বিশেষত দরিদ্র) কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান এখনো মায়ের অনুপস্থিতিতে হয় না। একবার একজন মাকে বলেছিল, ‘বউ কখনো মেয়ের মতো হতে পারে না, এক গাছের ছাল কি অন্য গাছে লাগে?’ অথচ মা নিজে দেখিয়েছেন এবং আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে কলম গাছ অন্য গাছে মিশে গিয়ে সেই গাছকেও আরও সমৃদ্ধ করে।

আমার মা খানম শামসি আহমদ নিউ কলোনি মহিলা মাহফিলের প্রতিষ্ঠাতা সহ-সম্পাদক, যিনি এখনো সমবয়সী থেকে নিয়ে তার স্নেহভাজনদের ছায়া হয়ে আছেন। পেয়েছেন অসাধারণ কিছু বন্ধু এবং স্নেহাস্পদ, যাদের ভরসায় মা ঢাকায় একাকী থাকলেও আমরা সাহস পাই।

মা অলঙ্কার পরতে ভালোবাসেন। এ জন্য বাবার মৃত্যুর পরও তার সন্তানরা, বিশেষত তার পুত্ররা গহনা খুলতে দেয়নি। এই গহনা এবং মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও মমতাই কাল হলো। বছর দুয়েক আগে এক অচেনা ভিখারি মেয়েকে বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার পর সে মাকে বিষ খাইয়ে অচেতন করে সব গহনা নিয়ে পালিয়ে যায়। পুরো দিন অচেতন ও এক রাত আইসি ইউনিটে থাকার পর মা ফিরে আসেন। মায়ের সব সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ স্তর পার হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হলেও কয়েকটি সন্তানের প্রবাস জীবন, এক সন্তানের মৃত্যু, এক সন্তানের অসুস্থতা, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক পুত্রের বহেমিয়ান জীবনযাপন, বাবার মৃত্যু, অনিয়ম-অযত্ন মাকে ভিতরে ভিতরে নিঃশেষ করে দিচ্ছিল, তার হাসিমুখ দেখে আমরা বুঝতে পারিনি। এই ধাক্কা মা বোধহয় সামলাতে পারেননি। তারপর থেকে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এখন মা ঢাকার এক ক্লিনিকে শুয়ে আছেন, আর আমি এক সড়ক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়ে রাজশাহীতে শয্যাশায়ী। মাকে তিন ব্যাগ কেনা রক্ত দেওয়া হচ্ছে অথচ আমার রক্তের গ্রুপ এক হওয়ার পরও আমি কিছুই করতে পারছি না, এই কষ্ট বোঝানোর নয়। মায়ের সব সংকটেই আমি পাশে ছিলাম, এবার নেই।  পাঠকদের কাছে অনুরোধ, তারা যেন একবার প্রার্থনা করেন আমার অপরূপা মা যেন আবার পরিপাটি সাজে হাসিমুখে অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত হতে পারেন, তার মমতার ছায়া বিস্তৃত করে দাঁড়াতে পারেন দুঃখীদের পাশে, তাদের প্রয়োজনে।

লেখক : প্রফেসর, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর