শুক্রবার, ১৩ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

বাগানের মতো পরিচর্যা করুন শিশুদের

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

বাগানের মতো পরিচর্যা করুন শিশুদের

একেকটি শিশু একেকটি সুবাসিত বাগানের মতো। বাগানের পরিচর্যায় যেমন আত্মা বিমোহিত হয়, তেমনি শিশুর পরিচর্যায়ও মানব বাগান সুখ-শান্তিতে ভরে ওঠে। হায় আজ কেমন সময় এলো? মানুষ শিশুদের মেরে নিজের বাগান নিজেই ধ্বংস করে দিচ্ছে!

এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে মানব সভ্যতা। সভ্য মানুষের মুখোশে একদল অসভ্য মানুষে ভারী হয়ে উঠছে আমাদের পৃথিবী। নিজেদের স্বার্থ কিংবা শুধু পৈশাচিক তৃপ্তি লাভের জন্য মানব সভ্যতার বীজরূপ কোমলমতি শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে অবলীলায়। আয়লান কুর্দির নিথর দেহ জানান দিয়েছে সভ্যতার মুখোশে অসভ্যদের দুনিয়ায় শিশুরা কত অসহায়। অপহরণ ও ধর্ষণের পর হত্যা এবং পারিবারিক কলহের জের ধরে শিশু হত্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। এক জরিপ মতে, ২০১২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ৮৭৬টি শিশু বিভিন্নভাবে হত্যার শিকার হয়। এ বছরের মার্চ পর্যন্ত মোট ৭৫টি শিশু খুনির আক্রোশে প্রাণ হারায়। এভাবে শিশু হত্যা চলতে থাকলে মানবসভ্যতা নিশ্চিত হুমকির মুখে পড়বে।

ইতিহাস সাক্ষী সর্বপ্রথম ফেরাউন নির্বিচারে শিশুহত্যা শুরু করে। সুতরাং যারাই শিশুহত্যার সঙ্গে জড়িত তারা নিঃসন্দেহে ফেরাউনের উত্তরসূরি। সম্প্রতি আমাদের দেশেও শিশুহত্যা ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে। সিলেটের রাজন ও খুলনার রাকিব হত্যার ক্ষত মুছতে না মুছতেই ঝিনাইদহের শৈলকুপায় ও হবিগঞ্জে চার শিশুকে নির্যাতনের পর হত্যার ঘটনা সুস্থ বিবেককে স্তব্ধ করে দিয়েছে। সামাজিক অবক্ষয় ও নৈতিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয়ই নির্মমভাবে শিশুহত্যার প্রধান কারণ। জাহেলি যুগের মতো বর্তমানেও শিশুহত্যা চলছে। তখন শুধু কন্যাশিশু হত্যা করা হতো। আর এখন কন্যার পাশাপাশি ছেলেশিশুও হত্যা করা হচ্ছে। শিশুহত্যার ভয়াবহতা সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যখন জীবন্ত পুঁতে ফেলা কন্যাশিশুকে জিজ্ঞাসা করা হবে, কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছে?’ (সূরা তাকভীর : ৮-৯।) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসির সাইয়্যেদ আবুল আ’লা (র.) বলেন, ‘আয়াতের বর্ণনাভঙ্গিতে চরম ক্ষোভ ও ক্রোধের প্রকাশ লক্ষণীয়। যে নিষ্ঠুর পিতা-মাতা নিষ্পাপ শিশুকে জীবন্ত পুঁতে ফেলেছে তাদের প্রতি আল্লাহর ঘৃণা ও অসন্তুষ্টি এত বেশি হবে যে, তাদের কিছুই জিজ্ঞাসা করা হবে না। বরং ছোট্ট শিশুকে জিজ্ঞাসা করবে তাকে মাটিচাপা দেওয়ার কারণ কী। আল্লামা ইবনে কাসীর (র.) লেখেন, ‘বিচারক যখন অত্যাচারীকে প্রশ্ন না করে অত্যাচারিতকে প্রশ্ন করে তখন স্বাভাবিকভাবেই অত্যাচারী অপ্রীতিকর ও চরম লজ্জার মুখে পড়ে। মূলত শিশু হত্যাকারীদের অপরাধ ও শাস্তির তীব্রতা বুঝানোর জন্যই এমনটি বলা হয়েছে।’

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। শিশুর সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। শিশুদের ভালোবাসা এবং তাদের প্রতি আমাদের কর্তব্য সম্পর্কে ইসলাম যে দিকনির্দেশনা দিয়েছে তা মেনে চললে শিশু নির্যাতন ও হত্যা শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। শিশুর প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ এবং তার সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার ব্যাপারে পবিত্র কোরআন এবং রসুল (সা.)-এর পবিত্র হাদিস শরিফে অনেক জোর নির্দেশ রয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আমের এবং আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে আমাদের ছোটদের প্রতি রহম/দয়া করবে না এবং আমাদের বড়দের সম্মান করবে না সে আমার উম্মত নয়। (তিরমিজি ও আবু দাউদ।) শিশু নির্যাতন রোধে রসুল (সা.)-এর আদর্শ অব্যর্থ। আট বছরের শিশু আনাস (রা.) ১০ বছর রসুল (সা.)-এর খাদেম ছিলেন। সেই আনাস (রা.) বলেন, ‘আমি দীর্ঘ ১০ বছর রসুলের (সা.) খাদেম ছিলাম। তিনি কখনো বিরক্ত হয়ে আমাকে ‘উহ’ বলেননি। কোনো করণীয় কাজ না করলে অথবা অপ্রয়োজনীয় কাজ করে ফেললে ধমক তো দূরের কথা ‘এমনটি কেন করলে’- একথাও জিজ্ঞাসা করেননি। (মুত্তাফাকুন আলাইহি।) আট বছরের শিশু ভুল করবে এটাই স্বাভাবিক। রসুল (সা.) চরম ধৈর্য এবং  কৌশলের সঙ্গে এগুলো সংশোধন করতেন। শিশুদের প্রতি রসুল (সা.)-এর ভালোবাসা এবং সুন্দর ব্যবহারের কারণেই ছোট্ট বালক জায়েদ (রা.) আপন বাবা-মার ভুলে রসুলের আশ্রয়ে চিরদিনের জন্য থেকে গেছেন।

অভিভাবক এবং শুভানুধ্যায়ীরা শিশুদের আচরণে বিরক্ত হয়ে তাদের কঠোর শাস্তি দেন। অনেক সময় ক্লাসের ফার্স্ট হতে না পারলে বা পরিচিত কারও বাচ্চার চেয়ে বেশি নম্বর না পেলে শিশু ওপর অমানবিক আচরণ করা হয়। পারিবারিক কলহ এবং জেদবশতও অভিভাবকরা শিশুদের ওপর নির্যাতন করেন। এ ব্যাপারে মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) বলেন, ‘রাগ ও ক্ষোভের সময় কখনোই শিশুকে প্রহার করবে না। বাবা-মা ও শিক্ষক সবার জন্য এ কথা প্রযোজ্য। রাগ কমে গেলে ভেবেচিন্তে শিশুকে শাস্তি দিতে হবে।’ মুফতি শফি (র.) বলেন, ‘শিশুদের প্রহার করা ভয়াবহ ধরনের গুনাহ। যেহেতু এটি বান্দার হক, তাই ওই শিশু ক্ষমা করা ছাড়া এর মাপ পাওয়া যাবে না। ভেবে দেখুন যারা অন্যায়ভাবে শিশু নির্যাতন ও হত্যা করেছেন তারা কত বড় অমার্জনীয় অপরাধ করেছেন।

আমরা কী পারি না শিশুদের ফুল বাগানের মতো পরিচর্যা করতে? এ বাগান যেমন ফুলের সৌরভ দিবে, তেমনি বৃদ্ধ বয়সে ফল দিয়েও সাহায্য করবে।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর