সোমবার, ১৬ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

ধর্ম ও মতাদর্শ প্রসঙ্গে

আবুল কাসেম ফজলুল হক

ধর্ম ও মতাদর্শ প্রসঙ্গে

দুই

রেনেসাঁসের কালে, ইউরোপে চতুর্দশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত, গির্জা ও রাজতন্ত্রের সঙ্গে বিজ্ঞান ও দর্শনের বিরোধ চলে। বিভিন্ন দেশে বিগত পাঁচ-ছয়শ বছর ধরে নানাভাবে এ বিরোধ বহমান আছে, কখনো কখনো বিজ্ঞানপন্থিরা যুক্তি দিয়ে, আইন প্রয়োগ করে এবং আরও নানা উপায়ে চিন্তার ও রাজনীতির ক্ষেত্র থেকে ধর্মপন্থিদের শেষ করে দিতে চেয়েছেন; আবার কখনো কখনো ধর্মপন্থিরা একই উপায়ে বিজ্ঞানপন্থিদের শেষ করে দিতে চেয়েছেন। কখনো কখনো ধর্মপন্থিদের সঙ্গে বিজ্ঞানপন্থিদের রক্তক্ষয়ী সংঘাতও হয়েছে। এক ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে অন্য ধর্মের অনুসারীদের, এমনকি একই ধর্মের অনুসারীদের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে সংঘটিত হয়েছে রক্তক্ষয়ী সংঘাত। গণতন্ত্রীদের, সমাজতন্ত্রীদের, জাতীয়তাবাদী ও আন্তর্জাতিকতাবাদীদের ইতিহাসও মানবতাবিরোধী প্রাণঘাতী সংঘাত-সংঘর্ষের কলঙ্ক থেকে মুক্ত নয়। গত পাঁচ-ছয়শ বছরের মধ্যে কোনো দেশেই ধর্মপন্থি কিংবা বিজ্ঞানপন্থি কোনো শক্তিই একটি অপরটিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারেনি। তাছাড়া বিজ্ঞানীদের মধ্যেও কাউকে কাউকে ঈশ্বর-বিশ্বাসী দেখা যায়। ধর্ম নিয়ে কিংবা আস্তিকতা-নাস্তিকতা নিয়ে যে বিরোধ এখনো দেখা যায়, তার মীমাংসা কি একপক্ষের চিরবিলোপ ও অপরপক্ষের চিরবিজয়ের দ্বারা হবে? সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণ ধর্মের উপযোগিতা সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন, সেগুলোকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে তখনই যখন ধর্মীয়, নৈতিক আদর্শের চেয়ে উন্নততর কোনো বিজ্ঞানসম্মত কার্যকর নৈতিক আদর্শ মানবজাতির সামনে উপস্থাপন করা যাবে। বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের কোনো নৈতিক আদর্শ নেই। দুর্নীতির অভিযোগে যারা অভিযুক্ত হন তাদের অধিকাংশই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ধারার। বাংলাদেশের মধ্যে কি কার্যকর নৈতিক বিবেচনার বা সুনীতির কোনো স্থান আছে? আজকের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও গণতন্ত্রীরা প্রগতি বলে কী বুঝিয়ে থাকেন? প্রগতি মানে কি কেবল ধর্মের বিরোধিতা?

১৯৮০’র দশক থেকে বলা যায়, ‘মৌলবাদ’-বিরোধী আন্দোলনের সূচনা থেকে পৃথিবীব্যাপী রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কথিত বিজ্ঞানপন্থিরা আদর্শগত সংকটে পড়েছেন এবং কথিত ধর্মপন্থিরা পুনরুজ্জীবিত হচ্ছেন। মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন পৃথিবীর কোনো দেশেই দেশ-কালের চাহিদা অনুযায়ী দেখা দেয়নি। চাহিদা ছিল অন্যকিছু। এ আন্দোলন ছিল সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা পরিকল্পিত ও পরিচালিত।

সোভিয়েত ইউনিয়ন লোপ পেয়েছে (১৯৯১), চীন মার্কসবাদ থেকে সরে যাচ্ছে। প্রচলিত গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের ধারণা আগের মতো আবেদনশীল নেই। শ্রেণি-সংগ্রাম ও শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্বকে এখন আর বাস্তবায়নযোগ্য মনে করা হয় না। ইউরো-মার্কিন বৃহৎ শক্তিবর্গ বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে শক্তিশালী হয়ে ‘উদার গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার নামে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়ায় সামরিক আক্রমণ চালিয়ে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। সিরিয়ায় চলছে হত্যাকাণ্ড। উদার গণতন্ত্রের প্রচার দিয়ে তারা মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলো থেকে তেল, গ্যাস, সোনা, হীরা ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ লুটে নিচ্ছে। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা হরণ করেছে। তালেবান, আল-কায়েদা, আইএস-এর উদ্ভবের এসবই মূল কারণ। বিশ্বায়নবাদীরা হীন উপায়ে আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা নীতি, লগ্নিপুঁজি, কূটনীতি, গোয়েন্দানীতি, প্রচারনীতি ইত্যাদি অবলম্বন করে সব জাতির ওপর নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার এবং শোষণ-পীড়ন প্রতারণাকে দৃঢ়মূল ও স্থায়ী করার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ভালো-মন্দ অনেক কিছু করেছে, কিন্তু তাদের আগ্রাসী আধিপত্যনীতি, শোষণনীতি ও যুদ্ধ অন্য সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠেছে। কোনো সন্দেহ আছে কি যে, এসবেরই প্রতিক্রিয়ায় দেখা দিয়েছে তালেবান, হরকাতুল জিহাদ, হিজবুত তাহরির, জেএমবি, আল-কায়েদা, আইএস ইত্যাদি জঙ্গিবাদী সংগঠন। যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী সব রাষ্ট্রের শাসকরা, সেই সঙ্গে তাদের প্রচারমাধ্যম সব শক্তি দিয়ে কেবল জঙ্গিবাদীদের প্রতি ঘৃণাবর্ষণ করছে। সুফল হচ্ছে না। প্রশ্ন হলো, প্রাণঘাতী নিরাপত্তাবৈরী বাস্তবতা সৃষ্টির জন্য মূলত কারা দায়ী? জঙ্গিবাদীরা? নাকি ধর্ম? নাকি যুক্তরাষ্ট্র-প্রচারিত উদার গণতন্ত্রের কার্যক্রম ও সামরিক আক্রমণ? এর অবসান কীভাবে হবে? কোনো একপক্ষ কি চিরকালের জন্য শেষ হয়ে যাবে? নাকি উভয়পক্ষই শেষ হবে? নাকি উভয়পক্ষই কোনো না কোনোভাবে টিকে থাকবে? মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বাহিনী থাকলে, ন্যাটো বাহিনী থাকলে জঙ্গিবাদী শক্তি শেষ হবে না। জঙ্গিবাদীরা কাজ করছে প্রথমত তাদের দেশকে স্বাধীন করার জন্য; দ্বিতীয়ত জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনে তারা তাদের দেশের বাস্তবতায় তাদের সাংস্কৃতিক মান অনুযায়ী অবলম্বন করছে ইসলামকে। মূল বিষয় জাতীয় স্বাধীনতা। বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, সিএনএন, স্কাই নিউজ, আল-জাজিরা অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে বিভিন্ন মাত্রায় মিথ্যা কথা প্রচার করছে।

ছয়শ বছর আগে পশ্চিম ইউরোপে রেনেসাঁসের উন্মেষকালে ধর্মপন্থিরা বিজ্ঞানের প্রতি যে বিরূপ মনোভাব পোষণ করত এখন কিন্তু তারা তা করে না। এখন ধর্মপন্থিরা, এমনকি জঙ্গিবাদীরা তাদের কার্যক্রমে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানকে ব্যবহার করতে সর্বোচ্চ মাত্রায় তত্পর। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান গ্রহণে তারা আগ্রহী। তবে তারা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাস কিছুতেই পরিবর্তন করতে চায় না। তবলিগপন্থিরা এবং সুফিরা জ্ঞান-বিজ্ঞানবিমুখ। তারা ঐহিক স্বার্থ হাসিলে ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িত হতে চায় না। তারা বিরোধ এড়িয়ে চলে। রাজনীতিতে সক্রিয় ধর্মপন্থিরা রাজনীতিতে ধর্মকে কাজে লাগায়। প্রতিপক্ষের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শন জেনে তাকে কাজে লাগিয়ে তারা নিজেদের চিন্তাধারাকে বিকশিত করছে। তারা দুনিয়ায় জয়ী হতে চায়। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী নীতি দ্বারা পরিচালিত, নৈতিক বিবেচনা বর্জিত বিজ্ঞানপন্থিরা ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা দিশাহারা হয়ে পাল্টা অবস্থান গ্রহণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনের নামে যুদ্ধ চালাচ্ছে। বিশ্বায়নবাদীদের তথা যুক্তরাষ্ট্র-অনুসারীদের উদার গণতন্ত্র, অবাধ-প্রতিযোগিতাবাদ, মুক্ত বাজার অর্থনীতি, বহুত্ববাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদ মানুষকে একটুও আশ্বস্ত ও আশাবাদী করছে না। আফগানিস্তানে, ইরাকে, লিবিয়ায় যে গণতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে তা গণতন্ত্র নয়, তা সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য ও লুটতরাজ।

ধর্ম, ধর্মপন্থি ও মৌলবাদীদের দুনিয়া থেকে কীভাবে নিশ্চিহ্ন করা যাবে? যুক্তরাষ্ট্র ও তার অনুগামীরা তাদের সমস্ত বুদ্ধি ও সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে জঙ্গিবাদীদেরই তো শেষ করতে পারছে না। বাংলাদেশে র‌্যাব, ক্লিনহার্ট অপারেশন, এনকাউন্টার, ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে শরিক থাকার চুক্তি— এসব কি বাংলাদেশের সমস্যার কোনো সমাধান? পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমের মিথ্যা দ্বারা পরিচালিত হয়ে কোন গন্তব্যের দিকে চলছি আমরা? বাস্তবে বাংলাদেশে প্রধান সব ধারার রাজনীতিতেই ধর্মের ব্যবহার বাড়ছে। এখন ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীরাও তো আর নিজেদের রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার না করে পারছে না। ভারতে কট্টর মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, উগ্রপন্থি ইত্যাদি বলে নিন্দিত ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং ক্ষমতায় এসেছে। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ, গান্ধী, অরবিন্দ প্রমুখের চিন্তাধারাকে জনপ্রিয় করে তোলা হচ্ছে।

ইতিহাসের দিক থেকে দেখতে গেলে দেখা যায়, যে কারণে ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ, সে কারণেই সময়ের ব্যবধানে ভিন্ন বাস্তবতায় মানবতাবাদ (humanism ), উপযোগবাদ (utilitarianism), গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদি আদর্শেরও উদ্ভব ও বিকাশ।

সর্বৈব নিখুঁত, সর্বাঙ্গ সুন্দর রাষ্ট্র, আর সম্পূর্ণ সমস্যামুক্ত সমৃদ্ধ সুন্দর জীবন মানুষ কামনা করে বটে, কিন্তু বাস্তবে সেরকমটা হয় না। বাস্তবে ব্যক্তি ও সমষ্টিকে সমস্যার পর সমস্যার সমাধান করেই চলতে হয়। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ— এগুলো কল্পিত, অভিপ্রেত, অভীষ্ট, কাম্য। এগুলো বাস্তব নয়। মানুষ এগুলোকে বাস্তবায়িত করতে চায়। আদর্শ মাত্রই মানুষের দ্বারা কল্পিত, মানুষের কাম্য বাস্তব। আদর্শ হলো অস্তিমান বাস্তবের ঊর্ধ্বতন এক কল্পিত বাস্তব— যে বাস্তবে মানুষ উত্তীর্ণ হতে চায়। অস্তিমান বাস্তবের ওপর ভিত্তি করেই মানুষ আদর্শ কল্পনা করে। বহুজনের চিন্তা ও কল্পনাকে সমন্বিত করে কোনো ব্যক্তি কোনো যুগের আদর্শকে রূপদান করেন। তিনি পরিচিত হন সেই আদর্শের প্রবর্তক বলে। প্রকৃত বাস্তবে অবস্থান করে যে উন্নত বাস্তবে পৌঁছার জন্য মানুষ ব্যক্তিগত ও সম্মিলিতভাবে সাধনা করে, সংগ্রাম করে, আদর্শ হলো সেই বাস্তব। জীবনযাপনে ও রাজনীতিতে আদর্শ অপরিহার্য। আদর্শ ও আদর্শানুগ কর্মসূচি ছাড়া রাজনীতি হীন-স্বার্থান্বেষীদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার এবং জবরদস্তিপরায়ণ লোকদের হীন উপায়ে স্বার্থ সাধনের কার্যকলাপে পরিণত হয়। হীন-স্বার্থান্বেষীরা স্বার্থসাধনের জন্য আদর্শের নামে শক্তি প্রয়োগ করে।

আদর্শ যখন সংঘশক্তির অবলম্বন হয়ে বাস্তবায়নে যায় তখন তাকে বলা হয় মতাদর্শ (creed)। আদর্শের বাস্তবায়নের জন্য আদর্শানুসারীদের অবলম্বন করতে হয় আদর্শানুগ, পর্যায়ক্রমিক কর্মসূচি, কর্মনীতি ও কার্যক্রম। কর্মসূচি সফল করার জন্য কখনো কখনো আপসহীন সংগ্রামের যেমন দরকার হয়, তেমনি কখনো কখনো নমনীয়তা ও আপসেরও দরকার হয়। আদর্শ বিকাশশীল। দুনিয়ায় সব কিছুই পরিবর্তনশীল। যারা আদর্শ অবলম্বন করে তাদেরই কর্তব্য আদর্শকে বিকশিত করে বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ও কার্যকর রাখা। তা করা না হলে আদর্শ সেকেলে, বিভ্রান্তিকর ও অকার্যকর হয়ে পড়ে। আজকের পৃথিবীতে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের তাই হয়েছে।

অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তির বিস্তার ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলয়ের পর সব আদর্শের চিন্তাধারারই নবমূল্যায়ন অপরিহার্য। দেশকালের ভিন্নতা অনুযায়ী প্রত্যেক আদর্শেরই রূপ ও প্রকৃতিতে কম-বেশি ভিন্নতা দেখা যায়। সময়ে সময়ে আদর্শের সংস্কার করতে হয়। কোনো কোনো ঐতিহাসিক পর্যায়ে প্রচলিত আদর্শকে অতীতের বিষয়ে পরিণত করে নতুন আদর্শ উদ্ভাবন করতে হয়। প্রতিটি আদর্শের সামনেই বিরুদ্ধশক্তি থাকে। কায়েমি স্বার্থবাদীরা থাকে। আদর্শের উপলব্ধি ও অনুশীলন কঠিন, কঠোর, দুরূহ, দুঃসাধ্য ব্যাপার; কিন্তু অসম্ভব ব্যাপার নয়। ধর্ম অবলম্বন করে অনেক কল্যাণকর ও গৌরবজনক ঘটনা যেমন ঘটেছে তেমনি ধর্মের নামে অনেক অকল্যাণকর ও কলঙ্কজনক ঘটনাও ঘটেছে। তেমনি আদর্শ অবলম্বন করেও ঘটেছে অনেক কল্যাণকর ও গৌরবজনক ঘটনা, আবার আদর্শের নামেও ঘটেছে অনেক অকল্যাণকর ও কলঙ্কজনক ঘটনা। মানুষের নৈতিক চেতনার শক্তি ও দুর্বলতার কারণেই এমন ঘটছে। মানুষ কি কোনো কালে পারবে পর্যাপ্ত নৈতিক শক্তি অর্জন করতে? সভ্যতা বা সংস্কৃতি অবলম্বন করে চললে অবশ্যই পারবে।

ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, ধর্ম ও আদর্শ— দুটো অবলম্বন করেই সমাজে অকল্যাণকর ও কলঙ্কজনক ঘটনার তুলনায় কল্যাণকর ও গৌরবজনক ঘটনা অনেক বেশি ঘটেছে। সেজন্য সভ্যতার বিকাশ সম্ভব হয়েছে। সামাজিক ও জাতীয় জীবনে ধর্মহীন, আদর্শহীন, লক্ষ্যহীন, পরিকল্পনাহীন, কর্মসূচিহীন, নীতিহীন অবস্থায় দেখা দিয়েছে অনাচার, বিশৃঙ্খলা, অপব্যবস্থা, দুর্নীতি, রক্তপাত, মাত্স্যন্যায়, Hobbsiah State of Nature, Malthusiah State of Nature রাষ্ট্রে অপশক্তির কর্তৃত্ব কায়েম হলে ধর্ম ও আদর্শ অবহেলিত ও বিকারপ্রাপ্ত হয়। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের স্বাভাবিক বিকাশে রাজতন্ত্র, জমিদারতন্ত্র, গির্জাতন্ত্র, পুরোহিততন্ত্র, ঔপনিবেশিক শাসন ইত্যাদির অবসান ঘটে; ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বাধাগ্রস্ত হয় এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বা আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের বাস্তবতা তৈরি হয়। গণতন্ত্রের প্রকারভেদ আছে। সব ধরনের গণতন্ত্রের জন্যই প্রস্তুতি ও প্রচেষ্টা দরকার হয়। ব্যক্তি স্বতন্ত্রের সৃষ্টিশীলতার ও অপশক্তিকে দমন করার ব্যবস্থাও অপরিহার্য। গণতন্ত্র কোনো সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। উপনিবেশবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ হলো জাতীয়তাবাদের বিকৃত বিকাশ— স্বাভাবিক বিকাশ নয়। আজকের বাস্তবতায় জাতীয়তাবাদের দাবি হলো জনগণের গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিক ফেডারেল বিশ্ব সরকার প্রতিষ্ঠা করা। আন্তর্জাতিকতাবাদ জাতীয়তাবাদের সম্পূরক। আন্তর্জাতিকতাবাদ জাতীয়তবাদের বিরোধী নয়। জাতিরাষ্ট্র ও বিশ্বরাষ্ট্র একসঙ্গে দুটোরই দরকার আছে। ইতিহাসের ধারায় ঠিকমতো বুঝতে হবে ব্যাপারগুলোকে।

১৯৮০-র দশকের একেবারে শুরু থেকে সাম্রাজ্যবাদীরা ও তাদের অনুসারী যুক্তিবাদী বিজ্ঞানপন্থিরা যে রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করে আসছেন তার প্রতিক্রিয়ায় পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রের রাজনীতিতেই ক্ষীয়মান ধর্মীয় শক্তি সজীব আছে এবং পুনরুজ্জীবিত ও বর্ধিষ্ণু হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে মার্কসবাদীরা ও গণতন্ত্রীরা যুক্তরাষ্ট্রের অভিপ্রায় অনুযায়ী মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনে লিপ্ত হয়ে সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত হয়েছেন এবং দেশবাসীকেও বিভ্রান্ত করেছেন। তাদের কর্তব্য ছিল গণতন্ত্রকে কিংবা সমাজতন্ত্রকে বোঝার ও সফল করার জন্য কাজ করা। তারা কোনো বিষয়েরই গভীরে না গিয়ে স্লোগানসর্বস্ব চিন্তা ও বক্তব্য নিয়ে কাজ করেছেন। তারা এমনসব কাজ করেছেন যেগুলোর প্রতিক্রিয়ায় পরাজিত পরিত্যক্ত, পুরাতন সব প্রথা-পদ্ধতি, রীতি-নীতি ও চিন্তাধারা পুনরুজ্জীবিত হয়েছে এবং গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৮০-র দশকের শুরু থেকে মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনে লিপ্ত গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে নিজেদের আদর্শগত ও সংগঠনগত পুনর্গঠনের কোনো কাজই দেখা যাচ্ছে না। আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মসমালোচনা ও আত্মোৎকর্ষের চেষ্টা তাদের মধ্যে দুর্লভ। যুক্তরাষ্ট্র প্রচারিত ‘উদার গণতন্ত্র’ ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’ ‘অবাধ প্রতিযোগিতাবাদ’, ‘বহুত্ববাদ’ ও ‘বিশ্বায়ন’ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের অবলম্বন। কথিত উদার গণতন্ত্র কেবল মধ্যপ্রাচ্যে নয়, বাংলাদেশেও দেখা যাচ্ছে। উদার গণতন্ত্রের জন্য মোল্লা ওমরকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হয়েছে, সাদ্দাম হোসেনকে, গাদ্দাফিকে হত্যা করতে হয়েছে, সামরিক আক্রমণ চালিয়ে লাখ লাখ লোককে হত্যা করতে হয়েছে। বাংলাদেশে পশ্চিমা সামরিক আক্রমণ দরকার হয়নি, টাকা ছড়িয়ে, সুযোগ-সুবিধা বিলিয়েই তা করা গেছে।

যে অবস্থা চলছে তাতে প্রগতির লক্ষ্যে যারা রাজনীতি করবেন তাদের প্রতিপক্ষের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্মানজনক সহাবস্থানের, সেই সঙ্গে আদর্শগত প্রতিযোগিতার কর্মপন্থা অবলম্বন করা ছাড়া উপায়ান্তর নেই। সংঘাত ও যুদ্ধের পরিণতি কী হবে? জঙ্গিবাদীদের সঙ্গে ‘মুসলমান’দের এক করে দেখা সমীচীন নয়; সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে গণতন্ত্রকে এক করে দেখাও সমীচীন নয়। উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদকে জাতীয়তাবাদের অনিবার্য বিকাশ মনে করা ভুল। জঙ্গিবাদীদের অস্তিত্ব সাম্রাজ্যবাদীদের অস্তিত্ব পরস্পর-নির্ভরশীল। সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে মৌলবাদীদের ও জঙ্গিবাদীদের সৃষ্টি করেছে এবং লালন করেছে। জঙ্গিবাদীদের অস্তিত্ব না থাকলে সাম্রাজ্যবাদীরা বিপদে পড়বে। সে অবস্থায় সারা দুনিয়ার জনগণ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সক্রিয় হবে। অবশ্য সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে জঙ্গিবাদীদের বিরোধও আছে। বাংলাদেশকে চলতে হবে জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ অবলম্বন করে।

সরকারের কাজ সরকার করছে। প্রগতিবাদীদের কর্তব্য হলো মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের উত্থানের কারণ, যতটা পারা যায়, অনুসন্ধান করা। অনুশোচনাহীন অপরাধীদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে। তবে কেবল দমননীতি দিয়ে হবে না, আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সংস্কৃতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন লাগবে। ন্যায় বাড়াতে হবে, অন্যায় কমাতে হবে। মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করে, মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদীদের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন ও যুদ্ধ অবলম্বন করে, সাম্রাজ্যবাদীরা ও সাম্রাজ্যবাদের দালালেরা দুনিয়ায় কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চাইছে। প্রগতিবাদীদের ‘উদার গণতন্ত্র’ পরিহার করে ‘সর্বজনীন গণতন্ত্র’ অবলম্বন করতে হবে এবং সেই গণতন্ত্রকে সফল করতে হবে। জঙ্গিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদকে একসঙ্গে ধরে নিয়ে দুটির বিরুদ্ধেই একসঙ্গে সংগ্রাম চালাতে হবে। সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কোনো সুফল অর্জন করা যাবে না। মানবসমাজের এও এক নিয়ম যে, ভালো লোকেরা যদি রাষ্ট্রীয় ও সাংগঠনিক কাজের দায়িত্ব গ্রহণ না করেন তাহলে তার প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ খারাপ লোকদের দ্বারা তাদের শাসিত হতে হয়। বাংলাদেশে এখন এমন এক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যে, যার ক্ষতি করার শক্তি যত বেশি, তার প্রভাব প্রতিপত্তি তত বেশি; এ সমাজে কল্যাণ করার শক্তিকে কোনো শক্তি বলেই স্বীকার করা হয় না। প্রগতিবাদীদের সংঘশক্তি গঠন করে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে হবে। অন্যথায় অবস্থা এমনই চলবে।

বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা কম-বেশি বিভিন্ন রকম। ফলে উন্নতির কর্মপন্থাও কম-বেশি বিভিন্নরকম হবে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরাই হোক আর ধর্মপন্থিরাই হোক, কপটতা, ভাঁওতা প্রতারণা, মিথ্যাচার, দুর্নীতি ও হিংসা-প্রতিহিংসা পরিহার করে সর্বজনীন কল্যাণের কর্মসূচি নিয়ে যে ধারা এগোবে, শেষ পর্যন্ত সেই ধারাই জয়ী হবে। মিথ্যার জয় স্থায়ী হবে না। মানবজাতিকে সত্য ও ন্যায়ের পথে চলতে হবে। সত্য কেবল তথ্য নয়, তথ্যের সঙ্গে তথ্যের অতিরিক্ত আরও অনেক কিছু। পরম ন্যায়, পরম কল্যাণ ও পরম সুন্দরের সমন্বিত সত্তা হলো সত্য। আদর্শের অন্তিম লক্ষ্য সত্য প্রতিষ্ঠা— জীবন ও জগেক পরম পূর্ণতায় উন্নীত করা। এ অর্থে সত্য পরম অভিপ্রেত, বাঞ্ছিত, কাম্য, কল্পিত পরম সত্তা। মানবসমাজে আবার হয়তো একদিন সর্বজনীন বিশ্বাস দেখা দেবে— সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী, Truth shall prevail.

লেখক : বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর