মঙ্গলবার, ১৭ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস

আজ জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৩৬তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। এ শুভদিনে আমি, আমার পরিবার এবং আমার দলের পক্ষ থেকে তাকে অভিনন্দন জানাই এবং তার ও তার পরিবারের মঙ্গলময় নিরাপদ জীবন কামনা করছি।

নাজির আহমেদ রঞ্জু মুক্তিযুদ্ধের সময় নাইন-টেনে পড়ত। সেই রঞ্জু এখন মস্তবড় ডাক্তার। শুধু ডাক্তার নয়, পুরোদস্তুর প্রফেসর। খুবই ভালো মানুষ। এলাকার লোকজনের সেবা করে। এলাকায় নামধামও হয়েছে অনেক। বছর কুড়ি আগে এক মেডিকেল ক্যাম্পে ডা. এইচ আর খান সখীপুরের দাড়িয়াপুর গিয়েছিলেন। তার সঙ্গে অনেক জুনিয়র ডাক্তার ছিল। তার মধ্যে এখন নাকি হৃদযন্ত্র অপারেশনে পাইনিওর ল্যাবএইডের ডাক্তার না প্রফেসর লুত্ফর ছিল। সেই ক্যাম্পে নাজির আহমেদ রঞ্জুও ছিল। আমি অবাক হচ্ছিলাম রঞ্জুর শিক্ষক এইচ আর খান রোগী দেখতে এসেছেন সে নিয়ে আলাপ বা কথা নেই। সবার মুখে রঞ্জু ডাক্তার এসেছে কিনা। গর্ব আর আনন্দে বুক ভরে গিয়েছিল। রঞ্জুর পরামর্শ ছাড়া এখন আমার স্ত্রীর চলে না। স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সব কাজে ওর পরামর্শ লাগে। সেদিন দিনাজপুরের হতদরিদ্র জয় নামে ছোট্ট একটা ছেলের হার্টের ছিদ্রের সমস্যা নিয়ে রঞ্জুর কাছে গিয়েছিলাম। দু-এক কথার পর রঞ্জু বলেছিল, ‘স্যার, আপনার চেকআপটা করে নিন। অন্ততপক্ষে বছরে এক-দুবার এ বয়সে দেখে নেওয়া ভালো।’ ওর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে হৃদরোগের পরিচালক প্রফেসর ডা. আবু আজমের ঘরে গিয়েছিলাম। বড় ভালো মানুষ। তার লেখা ‘ব্লাড প্রেসার, হার্ট অ্যাটাক, কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস ও গলগণ্ড’ বইটি আমায় উপহার দিয়েছেন। বইটির সবটুকু পড়া হয়নি। কিন্তু যতটা পড়েছি ভালো লেগেছে। এর আগে ছিলেন প্রফেসর শাফি আহমেদ মজুমদার। স্বাধীন বাংলাদেশে পল্টন ময়দানে ১৮ ডিসেম্বর ’৭১ আমার বা কাদেরিয়া বাহিনীর প্রথম জনসভায় ছাত্র হিসেবে হাজির ছিলেন। হৃদরোগ হাসপাতাল আমার বাড়ির গা ঘেঁষে। তাকে বেশ কয়েকবার আমার বাড়িতে খেতে বলেছিলাম। আমার অনুরোধের পরও পাঁচ-ছয় বছর ছিলেন সেখানে। কিন্তু আমার বাড়িতে তার খাওয়া হয়নি। রিজিক সব আল্লাহর হাতে। তাই কেউ ইচ্ছা করলেই খেতে পারে না। জনাব আবু আজমের ঘর থেকে বেরিয়ে বিদায়ের সময় রঞ্জু বলছিল, ‘স্যার, একবার সব কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নেবেন।’

দীপ-কুঁড়ি-কুশি আমার তিন ছেলেমেয়ে। ব্যারিস্টারি পড়তে কুঁড়ির লন্ডনে যাওয়ার কথা ছিল। সেজন্য চার-পাঁচ দিন ওর কথা রাখিনি। মেয়েটা আজ পাঁচ দিন বাড়িঘর অন্ধকার করে চলে গেছে। তাই গতকাল বঙ্গবন্ধু মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। খবর শুনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী, পরম সুহৃদ, প্রবীণ নেতা আ ক ম মোজাম্মেল হক ছুটে এসেছিলেন। তার এই বদান্যতার জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। বছর পাঁচ-ছয় আগে জণ্ডিসে আক্রান্ত হয়ে এক মাস এখানে ছিলাম। তখন ছিলাম ভীষণ অসুস্থ। গতকাল সুস্থ শরীরে হাসপাতালে এসেছি। কিন্তু কিছুই ভালো লাগছে না। শারীরিক কোনো অসুস্থতা নেই, কোনো কষ্ট নেই। কিন্তু কেন যেন বুকটা ভেঙে খানখান হয়ে আছে। সন্তান যে বাবা-মার কত প্রিয়, কাছে থাকলে বোঝা যায় না। কুঁড়ি আমার বাড়িঘর অন্ধকার করে বিলেতে গেছে মাত্র পাঁচ দিন। কিন্তু মনে হয় ওকে যেন কতকাল দেখি না। বুকের ভিতর অবিরাম হু হু করছে। এ কদিন ওর ঘরের দিকে তাকাতে চাইনি। তাকালেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কেন যে লিখেছিলেন— ‘শূন্য এ বুকে পাখী মোর, আয় ফিরে আয় ফিরে আয়

তোরে না হেরিয়া সকালের ফুল অকালে ঝরিয়া যায়

তুই নাই বলে ওরে উন্মাদ/পাণ্ডুর হল আকাশের চাঁদ

কেঁদে নদী-জল করুণা-বিষাদ/ডাকে আয় “তীরে আয়”!

গগনে মেলিয়া শতশত কর/খোঁজে তোরে তরু, ওরে সুন্দর!

তোর তরে বনে উঠিয়াছে ঝড়/লুটায় লতা ধুলায়।

তুই ফিরে এলে, ওরে চঞ্চল/আবার ফুটিবে বনে ফুলদল

ধূসর আকাশ হইবে সুনীল/তোর চোখের চাওয়ায়।’

আমি কবি নই। খুব একটা কবিমনেরও নই। কিন্তু বুকের ধন কুঁড়িমণি বিলেতে যাওয়ায় কবির এ গানের সঙ্গে আমার সমস্ত আকুলতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

লিখতে চেয়েছিলাম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে লাগামহীন কারচুপি, ইসরায়েলের গোয়েন্দাগিরি, মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি নিয়ে। কিন্তু লিখতে গিয়ে সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই তো মেয়েটাকে বিমানে তুলে দিয়ে এলাম। সেদিন ছিল ১৩ মে শুক্রবার। একদিকে কুঁড়ির লন্ডন যাত্রা, অন্যদিকে বাবার ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। এমিরেট, গলফ আরও কোনো এয়ারলাইনসের কথা শুনেছিলাম। ভাগিনা শাকিলের সঙ্গে কদিন আগে কথা হয়েছিল। ওই বলছিল ঢাকা-লন্ডন বিমানের জাহাজ আছে। পরে ভালোভাবে খোঁজ নিয়ে দেখলাম, সত্যিই সরাসরি ঢাকা-লন্ডন বিমান আছে। দেশের সংস্থা দেশের সম্পদ তাতেই মেয়েকে পাঠাতে মনস্থির করেছিলাম। মেয়েটা আমার এর আগে কখনো একা বিমান ভ্রমণ করেনি। তাই পিতা হিসেবে কিছুটা অস্বস্তি ছিল। সেজন্য বিমানবন্দরে ওকে বিড়ম্বনায় পড়তে না হয়, আর হিথরোতে কেউ যদি একটু রাস্তা দেখিয়ে দেয়, যাতে অসহায় বোধ না করে তাই বলাকা ভবনে গিয়েছিলাম। কাকে বলতে হয় বা হবে কিছুই জানা ছিল না। তাই এমডির সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম। বিমানের এমডি ছিল না। দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন ছিলেন। ভাইস মার্শাল, না মার্শাল জামাল উদ্দিনের বিদায়ের পর বিমানের কোনো চেয়ারম্যান আছেন জানা ছিল না। যখন কথা হলো তখন জানলাম এয়ার মার্শাল মোহাম্মদ এনামুল বারী বিমানের বর্তমান চেয়ারম্যান। ভদ্রলোককে আর কখনো দেখেছি বলে মনে হলো না। কাপাসিয়ার লোক শুনে ভীষণ ভালো লেগেছিল। কারণ আমাদের নেতা বঙ্গতাজ তাজউদ্দীনের বাড়িও সেখানে। তিনি আমাদের মতোই বলেছিলেন, ‘চিন্তা করবেন না। আপনার মেয়ে আমাদের বিমানে আমাদের মেয়ের মতোই ভ্রমণ করবে। হিথরোতে তার যা সাহায্য দরকার তা সে পাবে।’ মনে হয় ভদ্রলোক কথা রেখেছিলেন। ছোট ভাই শামীম আল মামুন সিদ্দিকী বেল্লাল প্রায় ৩০ বছর ছেলেমেয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে লন্ডন আছে। সেই আমার বুকের ধন কুঁড়িমণিকে তার বাড়ি নিয়ে গেছে।

শুক্রবার কুঁড়িকে লন্ডনের পথে বিদায় করে জয়দেবপুর-রাজেন্দ্রপুর-সিডস্টোর-সখীপুর হয়ে ছাতিহাটি বাবার কবর জিয়ারতে গিয়েছিলাম। ফাতিহা পাঠ ও মিলাদ শরিফ পড়ে রাতে ফিরেছিলাম টাঙ্গাইলে। পরদিন যখন রাতের দিকে ঢাকায় ফিরি, সেই প্রথম কুঁড়ি বাড়ি ছিল না। ভুল করে বড় মা, ছোট মা, কুশি মা, কুঁড়ি মা বলতে বলতে অন্য দিনের মতো সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলাম। হঠাৎই মনে হলো কুঁড়ি বাড়ি নেই। সে তো এক দিন আগে লন্ডন চলে গেছে। প্রায় ৩৬ ঘণ্টা দীপ-কুঁড়ি-কুশির মার থেকে দূরে ছিলাম। এই সময়টা সে এক নাগারে কেঁদেছে। মেয়ের জিনিসপত্র এটা ধরে ওটা ধরে আর কাঁদে। আমি কোনো দিন স্ত্রীর কান্না দেখিনি। মনে হয় স্ত্রীর কান্নার জন্য জন্মাইনি। দীর্ঘ বৈবাহিক জীবনে অনেক স্বামীর কাছে স্ত্রী হয়ে ওঠে অনেকটা মায়ের মতো, আমার স্ত্রীও আমার কাছে তেমন। মায়ের চোখের পানি আমি সহ্য করতে পারতাম না, স্ত্রীরটাও পারি না। কষ্ট আমাদের অনেক গেছে, এখনো আছে। কিন্তু চোখ থেকে পানি ঝরার কারণ হয় না। মা মারা যাওয়ার পর শূন্য বুক কুশি এসে ভরিয়ে তুলেছে। মার খালি জায়গা সত্যিই সে পুরো করেছে। আমার পরিবারে দীপ-কুঁড়িতে কোনো মিল ছিল না। পিঠাপিঠি ভাই-বোন হওয়ায় বড় বেশি ঝগড়া-ফেসাদ করত। ছোট থাকতে কিছু মনে না করলেও ওরা যখন একটু বড় হয় তখন ভাবনায় পড়েছিলাম। কিন্তু আল্লাহর দয়ায় কুশি আমার অন্ধকার ঘর আলো করে দিয়েছে। ওর এখন ১০ বছর। এই ১০ বছরে ভাই-বোনে কোনো ঝগড়া হয়নি। বাড়িতে এক দিনের জন্য কোনো কটু কথা কেউ বলেনি। মাকে নিয়ে আমরা ভাই-বোন যেমন ছিলাম রসুনের এক কোয়া, কুশি আসায় আমার পরিবার তার চেয়েও শক্তপোক্ত মায়াময় বাঁধনে অনাবিল হয়েছে। ওদের দুই বোনের বয়সের ব্যবধান প্রায় ১৫ বছর। কিন্তু দুজন যখন গলাগলি ধরে গল্প করত মনে হতো দুজন যেন সমবয়সী। কী অসাধারণ মিল। সেই জুটি ভেঙে বড় মা কুঁড়িমণি বিলেতে চলে গেছে। তাই সত্যিই কিছু ভালো লাগছে না। সাজিয়ে-গুছিয়ে কোনো কিছু ভাবতেও পারছি না।

বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর আমার বড় দুর্দিন গেছে। একসময় বিয়ের পাত্রী জোটেনি। তারপর আবার কোনো সন্তানের জন্মের সময় স্ত্রীর পাশে থাকতে পারিনি। সন্তানের প্রথম মুখ দেখার ভাগ্য হয়নি। দীপের ছয় বছর পর কুঁড়ির জন্ম। কুঁড়িকে পেটে নিয়ে ওর মা যখন দেশে ফেরে তখন বলেছিলাম, ‘আমার মেয়ে চাই। মেয়ে না হলে তোমাকে খাটে নয়, মাটিতে থাকতে হবে।’ তখন এখনকার মতো আল্ট্রাসনোগ্রাম করে জন্মের আগেই সন্তান ছেলে না মেয়ে দেখার খুব একটা সুযোগ ছিল না। আর সুযোগ থাকলেও আমি তেমন করতে রাজি হতাম না। ওর জন্মের খবরে বড় বেশি খুশি হয়েছিলাম। দীপের জন্মের পর ভারতের এমন খুব কম নেতানেত্রী ছিলেন যাদের মিষ্টি পাঠাইনি। সন্তানের মতো যিনি আমায় ভালোবাসতেন শুধু সেই ইন্দিরা গান্ধীকে ছাড়া। কারণ ইন্দিরাজি তখন পরপারে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু রাজীব গান্ধী, সোনিয়া গান্ধী, নরসিমা রাও, প্রণবদা, বিজু পট্টনায়েক, মধু লিমাই, জর্জ ফার্নান্দেজ, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, অমিতাভ গুপ্ত, অমিতাভ চৌধুরী, শোভা সেন, উত্পল দত্ত— আরও কতজনকে মিষ্টি পাঠিয়েছিলাম, দেখা করেছিলাম তার হিসাব নেই।

কুঁড়ির জন্ম ১০ ফেব্রুয়ারি ’৯০। আমি দেশে ফিরেছিলাম ১৬ ডিসেম্বর ’৯০। ওই রাতেই টাঙ্গাইল গিয়ে মেয়ের পা ধুয়ে পানি খেয়েছিলাম। আমার মার আর মেয়ের পা ধোয়া পানি পানে একই রকম অমৃতের স্বাদ পেয়েছিলাম। কুঁড়ির জন্মের বছরই দেশে ফেরায় সব সময় মনে হতো ওর ভাগ্যই আমাকে নির্বাসন থেকে দেশে এনেছে। মেয়েটা যে এতটা হৃদয়জুড়ে আছে সকাল বিকাল নিত্য দেখে দেখে অনুভব করিনি। বিদেশে পাড়ি জমানোয় শ্বাস-প্রশ্বাসে ওর আনাগোনা কেমন যেন এক আলোড়ন তুলছে। যেদিকে তাকাই সেদিকে শুধু ওর ছায়া দেখতে পাই। বাবার ইচ্ছা ছিল তার নাতি-পুতি কেউ ব্যারিস্টার হবে। সেই ইচ্ছা পূরণে কুঁড়ি বিলেত গেছে। দয়াময় আল্লাহ যেন বাবার ইচ্ছা ওকে দিয়ে পূরণ করেন। আমিন।

     লেখক : রাজনীতিক

সর্বশেষ খবর