রবিবার, ২২ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

পশ্চিমা দেশগুলোর উদ্দেশ্য কী?

মেজর জিল্লুর রহমান (অব.)

পশ্চিমা দেশগুলোর উদ্দেশ্য কী?

যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো উদ্দেশ্য নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। নয়া সাম্রাজ্যবাদের ব্যারোমিটার বাংলাদেশকে নিয়ে ইদানীং বেশ লক্ষণীয়ভাবে ওঠানামা করছে। ১৯৭১ সালে যখন এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবনবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তখন তারা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান শুধু নেয়নি আমাদের ন্যায্য দাবিকে বিচ্ছিন্নবাদিতা বলে অভিহিত করেছিল। পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। স্বাধীনতার পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তলাবিহীন ঝুড়ি বলে বাংলাদেশকে মশকারি করেছিল। আজ সেই দেশ বিশ্বে উন্নয়নের অনুকরণীয় মডেল হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। মানবাধিকার নিয়ে  তাদের বয়ান এবং গণতন্ত্রের অসিয়ত শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা। নিজেদের উত্তম আদর্শের অনুসারী দাবি করলেও মিথ্যা অভিযোগে তারা সাদ্দামের বিরুদ্ধে নিউক্লিয়ার অস্ত্রের উৎপাদন ও মজুদের অভিযোগ তুলেছিলেন। জাতিসংঘকে ঘটক সাজিয়ে কতবার যে বিয়ের মেয়ে দেখার মতো ইরাক সফর করে বিশ্বের মানুষের কাণ্ডজ্ঞানকে তারা উপহাস করেছে সে সব নাটকের কথা মনে পড়লে হাসি পায়। সিরিয়ার প্রতি নাখোশ তারা কারণ ইরাক আগ্রাসনে তারা শামিল হয়নি। সেই থেকে মানবিক সাহায্যের নামে অস্ত্র, অর্থ, প্রশিক্ষণ দিয়ে তারা সিরিয়ার রাষ্ট্রদ্রোহীদের মদদ দিচ্ছে।

আমাদের গাঁওগ্রামের হাটবাজারের ক্যানভাসাররা যেমন কণ্ঠ সরব করে অচল পণ্য সচল করার চেষ্টা চালায়। ঠিক তেমনি মধ্যপ্রাচ্যে একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রের সালসা খাওয়ানোর চাটুকদার কথা বলে তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মিসর, ইরাক, ওমান, জর্ডান, ইয়ামেন, মরক্কো, লেবানন, আলজেরিয়া, সুদান, সিরিয়ার স্বাভাবিক সরকার ব্যবস্থা ভেঙে মগের মুল্লুক বানিয়েছে। তাদের স্বার্থে তারা দুনিয়াকে অস্থির করার চেষ্টা করছে। এখন ওবামা সাহেব বলছেন, গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করা ভুল হয়েছে। লাদেনকে দুধকলা দিয়ে তারাই তাদের স্বার্থে আফগানিস্তানে ব্যবহার করেছিল সোভিয়েতকে হঠাতে। সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবিন কুক তো বলেই ফেললেন লাদেনকে সিআইএ প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সিআইএ আশির দশক ধরে আল-কায়েদাকে অস্ত্র দিয়েছে। সৌদি আরব অস্ত্র দিয়েছে। সোভিয়েত প্রস্থানের পর লাদেন তাদের চোখের কাঁটা হলো। সিআইয়ের সন্ত্রাস উৎপাদনের কারখানায় উৎপাদিত লাদেন তার আল-কায়েদা নিয়ে শান্তিপ্রিয় বিশ্বকে কী ভোগান্তিতে না ভোগাল। সাদ্দামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আইএসকে তারা তাদের প্রয়োজনে পেলে-পুষে হৃষ্টপুষ্ট করেছিল। এখন তাদের কব্জার বাইরে যাওয়ায় আইএসও জঙ্গি সন্ত্রাসী হয়ে গেল। যতদিন তারা আইএসকে অর্থ-অস্ত্র দিয়েছে তখন তারা কি ফেরেস্তা সংগঠন ছিল।

ভয়ঙ্কর যে ইস্যুটি বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলছে তা হলো, মুসলমানদের পাইকারিভাবে জঙ্গি সন্ত্রাসী ব্র্যান্ডে পরিণত করার ঘটনা। তাদের বিমানবন্দরে গেলে মুসলিম নাম দেখলে  কী ধরনের তল্লাশি হয় তা ভুক্তভোগীদের জানা। ভারতে মৌলবাদী দল দেশ শাসন করলেও মার্কিনিরা নীরব। সৌদি আরব কি গণতন্ত্রের সুবাতাসে মার্কিনিদের চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে রেখেছে। পাকিস্তানে পারভেজ মোশাররফের সামরিক সরকারের প্রতি তাদের শ্যামপ্রীতি ছিল সবার জানা।

বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা, শরণার্থী সংস্থা সবকিছু যুক্তরাষ্ট্র ডলার দিয়ে  খরিদ করে গুদামজাত করেছে। গুয়েন্তানামো কারাগারে মানুষের শরীর কুকুর দিয়ে খাওয়ানো হয়েছে, মানুষকে উলঙ্গ করে নির্যাতন করা হয়েছে তখন মানবাধিকারের প্রবক্তারা মুখে কুলুব এঁটে বসেছিল। পানামার প্রেসিডেন্ট নরেয়োগে সত্তর দশক থেকে সিআইএ-এর উচ্চ বেতনভুক্ত এজেন্ট ছিল। সিনিয়র বুশের সঙ্গে দহরম-মহরম খাতির ছিল। স্বার্থে টান পড়ায় পানামায় ঢুকে অপারেশন ট্রাস্ট নামে সামরিক অভিযান চালিয়ে তাকে ঘায়েল করা হয়, এই হলো গণতন্ত্রের নমুনা।

জাপানের বড় ডোনার জাইকা সাহায্যের হাত বাড়ায় মার্কিনিদের মুখ দেখে। জাপানের অকিনোয়ার দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি গেড়ে নানা জ্বালাতনে বাসিন্দাদের ঘৃণা কুড়িয়েছে। সেখানে একবার ১২ বছরের এক বালিকাকে ধর্ষণ করে ভদ্র-নম্র জাতির প্রতিবাদ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে কত কাণ্ড যে তারা করল। জাপানের প্রধানমন্ত্রী উকিয়ো হ্যাতয়ামা ক্ষমতায় বসার মাত্র আট মাস পর পদত্যাগ করেন। মার্কিনবিরোধী সেন্টিমেন্ট দেখে ভোটের আগে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন মার্কিন ঘাঁটি সরিয়ে দেবেন কিন্তু অফিসে বসে দেখলেন তার পক্ষে এদের সারানো সম্ভব নয়, তাই জনপ্রিয়তার ধস ঠেকাতে পদত্যাগ করেছিলেন। ভিয়েতনামের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুদ্ধ করে আজ আবার তালাক দেওয়া বউকে তারা ঘরে তুলেছে। মার্কিনিদের প্রমোদের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে ভিয়েতনাম। বাংলাদেশের উন্নয়ন গত কয়েক বছর বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। উন্নত দেশগুলোর জিডিপি যেখানে বিয়োগ অঙ্কে ঠেকেছে, যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে অনেক ব্যাংক-বীমা, শিল্প, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া ঘোষণা হচ্ছিল, পানির দামে বাড়ি বিক্রি হচ্ছিল, বেকার ভাতা হ্রাসসহ কর্মচারী ছাঁটাই করতে হচ্ছিল, ঠিক সেই সময় বাংলাদেশ ৬ শতাংশের বেশি জিডিপি অর্জন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়েছে। মহাসম্ভাবনার আমার এই দেশ।

ভিটাবাড়ি, গরু-ছাগল, হ্যাতা-খাতা বেঁচে গ্রামের যুবক সিঙ্গাপুরে যায় নিজের পরিবারের সুদিন ফিরাতে, তারা কেন জঙ্গি হতে যাবে। সিঙ্গাপুরে, জঙ্গিবাদের গান গাওয়ার সময় তাদের কোথায়। সরলীকরণ চিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে খতিয়ে দেখা উচিত বাংলাদেশকে চাপে রাখার কোনো আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ কিনা।

পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম বিবিসি, ট্রিবিউন, নিউইয়র্ক টাইমস, সিএনএন হিউম্যান রাইটওয়াচসহ যত প্রচারবিদ আছে সবখানেই তাদের প্রযোজনায় বাংলাদেশের নিন্দা ছন্দে, তালে, লয়ে উচ্চাঙ্গের ভঙ্গিতে প্রচার ও প্রসার করে যাচ্ছে। আমি শঙ্কিত খবরগুলো বিশ্লেষণ করে। কয়েকটি সংবাদ মাধ্যম শিরোনাম করেছে, বাংলাদেশে এক মাসে কয়েকটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড। সহিংস উগ্রপন্থি গ্রুপগুলোর শক্তিবৃদ্ধি ও দায়মুক্তির বিষয়টি জোরালো করেছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিবিড় পর্যবেক্ষণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, তা অব্যাহত আছে। যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, আইএসের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে। টাঙ্গাইলে দর্জি নিহতের খবর বিদেশি পত্রিকায় ছাপাতে কারা স্থান করে দিল বুঝতে অসুবিধা হয় না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদ উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন এ সত্য তার প্রতিপক্ষও অস্বীকার করেন না। এ কথা আমেরিকা কীভাবে অস্বীকার করবে মতপার্থক্য থাকলেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সব ঝুঁকি নিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদ জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদ উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন তার প্রমাণও তিনি বিশ্বকে দেখিয়েছেন। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট ঢাকঢোল পিটিয়ে ইতিমধ্যে তাকে সাধুবাদ ধন্যবাদ জানান দেওয়ার পর, কোথায় আমাদের সরকারপ্রধান তাদের পাকা ধানে মই দিলেন যে বাংলাদেশে আইএস-আইএস, আল-কায়েদা-আল-কায়েদা বলে স্লোগানের জিকির তুলতে হচ্ছে। অস্তিত্বের স্বার্থে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। সাধু সাবধান!

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর