মঙ্গলবার, ২৪ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিপ্লবী কবির জন্মদিন ও নারায়ণগঞ্জ প্রসঙ্গ

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

বিপ্লবী কবির জন্মদিন ও নারায়ণগঞ্জ প্রসঙ্গ

কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬, ইংরেজি ২৪ মে ১৮৯৮ সালে আসানসোলের জামুরিয়া থানার চুরুলিয়ার এক মাটির ঘরে জন্ম নেন। পিতা ফকির আহমেদ, মাতা জাহেদা খাতুন। কবিরা ছিলেন ৩ ভাই, ১ বোন। কাজী সাহেবজান ও ছোট জন কাজী আলী হোসেন এবং বোন উম্মে কুলসুম। পিতা ফকির আহমেদ মারা গেলে কবিকে মাত্র ৯ সাড়ে ৯ বছর বয়সে পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়। যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তেন, সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিদ্যালয় বা মক্তবে শিক্ষকতা করেছেন। পাশে হাজী পালোয়ানের মাজারের সেবক এবং মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবে আজান দিয়েছেন। পিতার অকালমৃত্যুতে পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে পড়ায় তিনি আর তেমন লেখাপড়ায় মন দিতে পারেননি। আসানসোলের রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজ স্কুলে এবং পরে মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুল বা নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু তেমন লেখাপড়া হয়নি। একসময় বাসুদেবের কবিদলে, তারপর খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ড সাহেবের খানসামা বা চাকর হিসেবে, আরও পরে এক রুটির দোকানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। চা এবং রুটির দোকানে কাজ করার সময় ময়মনসিংহের ত্রিশালে রফিজউল্লা দারোগার সঙ্গে তার দেখা হয় এবং তিনি আকৃষ্ট হয়ে কবিকে ১৯১৪ সালে ত্রিশালের দরিরামপুর এনে স্কুলে ভর্তি করেন। সেখানে তার মন বসেনি। আবার ফিরে যান আসানসোলে। ভর্তি হন নিউ স্কুল বা অ্যালবার্ট ভিক্টর ইনস্টিটিউশন, পরে আবার রানীগঞ্জ সিয়ারসোল স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে। সেখানে দশম শ্রেণিতে উঠে প্রিটেস্ট পরীক্ষার সময় ১৯১৭ সালের শেষের দিকে ব্রিটিশ সেনা দলের বাঙালি পল্টনে যোগ দেন। ৪৯ বাঙালি পল্টনে থাকার সময় তিনি নিয়মিত কলকাতায় লেখা পাঠাতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে ১৯২০ সালের মার্চে ৪৯ বাঙালি পল্টন ভেঙে দিলে তিনি কলকাতায় আসেন। কমরেড মুজফ্ফর আহমদের সান্নিধ্যে তার কলকাতার জীবন। তরুণ কবি কলকাতার সাহিত্যজগেক বিরাট নাড়া দেন। সেই সময় কুমিল্লার এক পুস্তক ব্যবসায়ী আলী আকবর খানের সঙ্গে কুমিল্লায় আসেন। সেখানে বিরজাসুন্দরী দেবীর কন্যা প্রমীলার সঙ্গে তার পরিচয়। কুমিল্লার দৌলতপুরে আকবর আলী খানের বাড়িতে কিছুদিন থাকার সময় তার ভাগ্নি নার্গিসের সঙ্গে পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। আকবর আলী খানের উদ্দেশ্যই ছিল ভাগ্নির সঙ্গে বিয়ে দিয়ে কবিকে কব্জা করা। বিয়ের আসরে মনোমালিন্য হলে কবি সেখান থেকে চলে আসেন। আর কোনো দিন নার্গিসের সঙ্গে কবির দেখা বা যোগাযোগ হয়নি। কিন্তু তবুও কবির অনেকটা হৃদয়জুড়ে ছিলেন দৌলতপুরের সেই নার্গিস।

সেই ছেলেবেলা থেকে কবির গানে, কবিতায়, গদ্যে-পদ্যে মুগ্ধ ছিলাম। কবির কবিতা, গান দেশবাসীকে আলোড়িত করত। সেই সঙ্গে আমাকেও। মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে দেখেছি কবি কাজী নজরুলের কবিতার এক একটি শব্দ কীভাবে শত্রুর বুকে কামানের গোলার মতো আঘাত হানত। ১৯২৯ সালে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে কবিকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। সেই সংবর্ধনার সভাপতি ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। সেখানে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যথার্থই বলেছিলেন, ‘আমরা যখন যুদ্ধে যাব তখন নজরুলের গান গাইব। যখন জেলে থাকব তখনো নজরুলের গান গাইব। গলা ফাটিয়ে তার কবিতা আবৃত্তি করব।’ নেতাজির কথা চরম সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল আমাদের ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে।

বঙ্গবন্ধুর কারণে নীরব কবিকে পেয়েছিলাম বাংলাদেশে। আমারও ভাগ্য হয়েছিল তাকে আমার ঘরে নিতে। কিন্তু আমাদের জাগরণের কবিকে কি আমরা যথাযথ গুরুত্ব বা মর্যাদা দিই বা দিতে পারি?

হঠাৎই উল্কা পতনের মতো নাসিম ওসমানের মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিলাম। কল্পনাও করতে পারিনি ওভাবে নাসিমের মৃত্যুসংবাদ পাব। ত্বকী হত্যা নিয়ে ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে সারা নারায়ণগঞ্জ তখন ফুঁসে উঠেছিল। ড. কামাল হোসেন, অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্নাদের এক সভায় সেখানে গিয়েছিলাম। সবার আগে পৌঁছে ছিলাম বলে দর্শক-শ্রোতার সারিতে বসে ছিলাম। বড় মানুষ বড় মানুষের মতোই জনাব এস এম আকরাম মঞ্চে ছিলেন। তার লোকজন শামীম ওসমান এবং ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে মুখে যা আসছিল তাই বলছিল।

নেতারা এলে সভা জমে ওঠে, একপর্যায়ে আমার সময় এলে বলেছিলাম, ‘কোনো ব্যক্তির ভুল-ত্রুটির জন্য সমস্ত পরিবারকে দায়ী করা যায় না। ওসমান পরিবারের অতীত আছে, ঐতিহ্য আছে, মুক্তিযুদ্ধে তাদের ত্যাগ আছে, সর্বোপরি ঘাতকের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হলে তার প্রতিবাদ-প্রতিরোধে নাসিম ওসমান নববধূ পারভীনকে ফেলে আমার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল।’ আমি সে কথা ভুলতে পারিনি, তাই জোরের সঙ্গে তা তুলে ধরেছিলাম। ত্বকী হত্যার বিচার দাবিতে নারায়ণগঞ্জের সবাই তখন এক। ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে সবাই রাস্তায়। এ সময় তাদের সঙ্গে সুর মেলাতে না পারায় ড. কামাল হোসেনসহ নেতারা যেমন ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, তেমন সাধারণ মানুষও ভুল বুঝেছিল। আমি তা গায়ে মাখিনি। নারায়ণগঞ্জের মিটিংয়ের এক বা দুই দিন পর নাসিম এসেছিল। সালাম করে বলেছিল, ‘আপনি আমার পরিবারের জন্য যে জাতীয় দায়িত্ব পালন করলেন সে ঋণ আমরা সারা জীবনে শোধ করতে পারব না।’ সত্যিই ঋণ শোধ করার সময় নাসিম পায়নি। সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় নাসিমের জানাজা শেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে ছবিটি দিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী সেদিন বলেছিলেন, ‘নাসিমও তোমার সঙ্গে পাটনায় জয় প্রকাশজির কাছে গিয়েছিল?’ হ্যাঁ, সেদিন নেতাজি সুভাষ বোসের একসময়ের ব্যক্তিগত সচিব, ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতা সমর গুহ এমপি আমাদের পাটনার কদমকুয়ায় নিয়ে না গেলে মোরারজি দেশাই জননেত্রী শেখ হাসিনাকেও সেখানে থাকতে দিতেন না। যে যাই বলুন, নানা কারণে পরিবারটির প্রতি আমার কিছুটা দুর্বলতা ছিল এবং এখনো আছে। সংসদে নাসিমকে স্মরণ করতে গিয়ে শামীম বলেছিল, ‘নাসিম ওসমানের পরিবার-পরিজন আগামী দিন কী খাবে তার কোনো ব্যবস্থা নেই।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমার প্রিয় ভগ্নি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘ওসমান পরিবারের সঙ্গে তিনি আছেন এবং তার দায়িত্ব পালন করবেন।’ নাসিম, শামীম আওয়ামী লীগের জন্য যা করেছে, দেশের জন্য যা করেছে, নাসিমের বাপ-চাচা যা করেছেন আমি এবং আমার পরিবার তার চেয়ে কম করিনি, বরং হাজার গুণ বেশি করেছি। আমার এবং আমার পরিবারের প্রতিও তার একটা দায়দায়িত্ব আছে। জননেত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই তার কথা রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। নেত্রীকে সেই ছেলেবেলা থেকে জানি, নির্বাসিত জীবনে তার যে আন্তরিকতা ও অসাধারণ দরদি মনের পরিচয় পেয়েছি তা ভোলার নয়। নিজের ওপর দোষ নিয়েও ওসমান পরিবারের প্রতি তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন। তার অর্থ এই নয় যে, তারা যা খুশি তাই করবে।

নাসিমের শূন্য আসনে সেলিম ওসমান প্রার্থী হয়। নাসিম ওসমান জামালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করলেও নানা কারণে আওয়ামী লীগ করতে পারেনি। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি করতেন। ভোটহীন নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে জাতীয় পার্টি থেকে তিনি সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। তাই সরকার সিটটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিয়েছিল। জোটবদ্ধ সরকারের এটা ছিল একটা প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে বেশি প্রার্থী ছিল না। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের শফিকুল ইসলাম দেলোয়ার ও ড. কামাল হোসেন এবং মাহমুদুর রহমান মান্নার এস এম আকরাম। একসময় বিরোধী পক্ষে শুধু এস এম আকরাম থাকুক এমনটা আলোচনা হয়েছিল। ড. কামাল হোসেন, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, আ স ম আবদুর রবকে সম্মান দেখিয়ে আমরাও আমাদের প্রার্থী প্রত্যাহারের চিন্তা করেছিলাম। বাদ সাধে নাসিমের স্ত্রী পারভীন। তার কান্না ফেলতে পারিনি। সে বলছিল, ‘আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আপনার প্রার্থী প্রত্যাহার করলে আমরা একা হয়ে যাব। আইভী তার গুণ্ডা দিয়ে ভোট লুট করে নেবে। আমাদের টিকতে দেবে না।’ ওর আগে আমার ধারণা ছিল শামীমের ক্যাডারের তাড়নায় নারায়ণগঞ্জবাসী অতিষ্ঠ। নাসিমের স্ত্রীর কাছে শুনলাম আইভীর ক্যাডারের সামনে শামীম ওসমান কিছুই না। আমার মারাত্মক দোষ, প্রবীণদের অসম্মান করতে পারি না। ড. কামাল হোসেনের কোনো কথা কখনো ফেলি না। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের উপনির্বাচনে তার অনুরোধ রাখিনি বা রাখতে পারিনি। কারণ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধযুদ্ধে নাসিমের কষ্টের কথা ভুলতে পারিনি। পারভীন তার বাচ্চাকে ভালো করে দুধ খাওয়াতে পারেনি। সেদিনের আমাদের সেই কষ্ট কাউকে বোঝানো যাবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের সঙ্গে ছিলেন, হয়তো তিনি কিছুটা বুঝতে পারেন। নির্বাচনে সেলিম জয়ী হয়। আসলে প্রকৃত ভোটে জয়ী হয়েছিল কিনা তা হলফ করে বলা যায় না। এর আগে সবাই সেলিমকে ব্যবসায়ী হিসেবে জানত। কিন্তু সংসদ সদস্য হওয়ার পর সেলিম ওসমান দানবীয় রূপে আবির্ভূত হয়। সব কিছু নিজের হাতে নিয়ে নেয়। মনে হয় সম্রাট আকবরও অত ক্ষমতাবান ছিলেন না। তার চেয়েও বেশি ক্ষমতা সেলিম ওসমানের। ধরাকে সরা জ্ঞান কাকে বলে তা ব্যবসা-বাণিজ্যে শত বছরের প্রসিদ্ধ নারায়ণগঞ্জকে দেখিয়ে বা বুঝিয়ে দিয়েছে। শুনেছি দান-ধ্যানে সরকারি নয়, নিজের টাকায় সয়লাব করে দিয়েছে। জানি না যে টাকা সে দান-ধ্যান করে তা ইনকাম ট্যাক্সের খাতায় উল্লেখ আছে কিনা, দুদক দেখে কিনা। স্বাধীনতার এক সিপাহসালার শাজাহান সিরাজের ১৬ হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিলের গরমিলে ওয়ান-ইলেভেনের সময় জেল হয়েছিল। তার স্ত্রী এক মাদ্রাসায় ৫০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। সেই টাকা কোথায় পেলেন প্রশ্ন তুলে তাকেও জেল দেওয়া হয়েছিল। নাসিমের মৃত্যুর পর তার পরিবারের যদি চলার সংগতি না থেকে থাকে, শামীম আজীবন রাজনীতি করে, তার যদি তেমন কিছু না থাকে তাহলে সেলিমের হয় কোথা থেকে? প্রশ্নগুলো সামনে আসায় না লিখে পারছি না।

এবার আসি তরতাজা নারায়ণগঞ্জের ঘটনা শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তের অপমান-অপদস্থ করা নিয়ে। আমার বাবা মৌলভী মুহাম্মদ আবদুল আলী সিদ্দিকী, শিক্ষাগুরু দুখীরাম রাজবংশী। জন্ম দিয়েছেন মৌলভী মুহাম্মদ আবদুল আলী সিদ্দিকী, মানুষ করেছেন দুখীরাম রাজবংশী। শুনেছি, প্রধান শিক্ষক মহাশয় আল্লাহ-রসুলের সমালোচনা করেছেন। সমালোচনা করলেও মসজিদে মাইক মেরে লোকজন জড়ো করে একজন শিক্ষককে মারধর করা যায় না। তার আইনানুগ বিচার করা যায়। শুক্রবার মিটিং দিয়ে হেডমাস্টারকে ডেকেছিলেন। ঘরের দরজা বন্ধ করে তার সঙ্গে অসভ্য আচরণ করেছেন। মাইকে গুজব ছড়িয়ে লোকজন জড়ো করে ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেলোয়ার পাঠান দরজা খুলে উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে দিয়ে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর দিতে বলেন। তাহলে তো আল্লাহ-রসুলকে নিয়ে কথা নয়, কথা পদত্যাগ নিয়ে। যে কোনোভাবে লোকজনকে খেপিয়ে তুলে একজন শিক্ষকের বুকে নাচানাচি করা, একজন সংসদ সদস্য কী জঘন্য ভাষায় তাকে গালাগাল করেছেন, যার রেকর্ড শুনে বিস্মিত হয়েছি। কিছু গালাগাল তো এর আগে কখনো শুনিনি। তারপর কান ধরে উঠবোস করানো এ কি বাঙালির সভ্যতা-ভব্যতা অনুমোদন করে? আল্লাহ না করুন কোনো দিন যদি সরকারের বিরুদ্ধে কোনো গণঅভ্যুত্থান হয় তখন এ সরকারের কর্ণধারদের কি ওভাবে অপমান-অপদস্থ করা হবে? এটা কোন সভ্যতা, এটা কোন মানবতা? শ্যামলকান্তি ভক্তকে ওভাবে কান ধরে উঠবোস করা বাংলাদেশকেই অপমান-অপদস্থ করা। সব শিক্ষককে কান ধরে উঠবোস করা। শ্যামলকান্তিকে হত্যা করলেও অতটা আহত হতাম না, যতটা হয়েছি একজন শিক্ষককে ওভাবে ষড়যন্ত্র করে অন্যায়ভাবে অপমান-অপদস্থ করায়। গত সপ্তাহজুড়ে সারা দেশে শিক্ষকসমাজ ও অন্যরা যেভাবে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিল তাতে অনেকটা সাহস পেয়েছি। এ প্রতিবাদ কেন শুধু শিক্ষকদের হবে, এ প্রতিবাদ কেন ছাত্রের হবে না, কেন অভিভাবকের হবে না, সর্বোপরি সমগ্র জাতি এবং সমাজের কেন হবে না? পত্রিকায় দেখে বিস্মিত হয়েছি আল্লাহ-রসুলের নামে কটূক্তির গুজব শুনে ইমানদার মুসলমানরা শ্যামলকান্তিকে শায়েস্তা করতে সেদিন নাকি অনেকেই জুমার ফরজ নামাজ আদায় করেনি। কত বড় শক্তিশালী ইমানদার! হাদিসে আছে— লক্ষ কোটি নফল আদায় করার পরও ফরজ আদায় না করলে সব নফল নিষ্ফল, মূল্যহীন। জানি না আমাদের কী হয়েছে। আমাদের যে দারুণ মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে এ থেকে তার প্রমাণ মেলে।

ধন্যবাদ জানাই শিক্ষামন্ত্রীকে। শিক্ষকের অপমান শিক্ষার অপমান, সর্বোপরি সভ্যতার অপমান তিনি সহ্য করেননি। সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছেন এজন্য অবশ্যই তিনি জাতির ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা যা শুনলাম, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে যা দেখলাম তার পরও কি কোনো তদন্তের প্রশ্ন আসে? এক এসপি বলেছেন ফৌজদারি কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে পুলিশের কিছু করার ছিল না। আইজিপি সাহেব দেখতে শুনতে বেশ সুন্দর। তিনি বলেছেন, পুলিশের কিছু করার ছিল না। আল্লাহ না করুন বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ওই একই রকম কি তিনি বলবেন— পুলিশের কিছু করার নেই!

একজন সংসদ সদস্য বা নেতা হিসেবে সেলিম ওসমান যা করেছে তা সভ্যসমাজে বলার মতো নয়। সংসদ সদস্যদের মুখে চুনকালি মেখেছে। খুনের আসামির চেয়েও তার অপরাধ জঘন্য। মানুষ মরলে তার আর কোনো মান-সম্মানের প্রশ্ন থাকে না। কিন্তু একজন শিক্ষকের অমন অপমান শত মৃত্যুর চেয়েও বেশি। সেদিন মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী শ্যামলকান্তিকে দেখতে গেলে তিনি বিছানা থেকে উঠে মন্ত্রীকে ষষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করেছেন বলে অনেকে বলতে শুরু করেছে। সংসদ সদস্য কান ধরে জাতিকে উঠবোস করালেন, মন্ত্রী কি পা ধরে মাপ চাওয়ালেন? ব্যাপারটা ওই ভাবে না ভাবলেই ভালো হয়। হিন্দুরা গুরুজন বা সম্মানী কাউকে ষষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করে। এটা তাদের রীতি। স্বাধীনতার পর ’৭২-এর এপ্রিলে আমি কলকাতা সফরে গেলে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় যখন আমায় ষষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করেন তখন আমি কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলাম। নির্বাসিত জীবনে কলকাতার সিআইটি রোডে ইউরোপীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি অনিল দাশগুপ্তের দিদি এবং জামাইবাবু তাদের বাড়ি গেলেই তারা ষষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করতেন। এটা হিন্দু সমাজের রীতি। এটার সঙ্গে সেলিম ওসমানের বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড এক করে বিচার চলে না। শিক্ষার অবক্ষয়ের জমানায় এর যথাযথ বিচার না হলে কোনো শিক্ষক সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে পারবে না। সেটা প্রাইমারি শিক্ষায় হোক, আর বিশ্ববিদ্যালয়েই হোক।

লেখক : রাজনীতিক

সর্বশেষ খবর