শনিবার, ২৮ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

বাংলাদেশে জ্যাকল কারা

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

বাংলাদেশে জ্যাকল কারা

একটা বিখ্যাত বইয়ের নাম— ‘কনফেশনস অব অ্যান ইকোনোমিক হিটম্যান (confessions of an Economic Hitman)’। নিউইয়র্কের পেনগুইন গ্রুপ ২০০৪ সালে বইটি প্রকাশ করেছে। বইটি লিখেছেন জন পার্কিনস, যিনি নিজে একজন ইকোনোমিক হিটম্যান হিসেবে প্রায় তিন দশকের উপরে কাজ করেছেন। বইটি আত্মজীবনীমূলক নয়।  তবে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার লোক হিসেবে পার্কিনস তিন দশক ধরে পৃথিবীজুড়ে তার কাজের অভিজ্ঞতা বইটিতে তুলে ধরেছেন। বিশ্বের পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি ও করপোরেট বাণিজ্যের ভিতরের কথা অকপটে বর্ণনা করেছেন পার্কিনস। বইয়ের শুরুতে ইকোনোমিক হিটম্যানের একটা সংজ্ঞা দিয়েছেন  ‘Economic Hitman (EHMs) are highly paid professionals who cheat countries around the globe out of trillions of dollars. They funnel money from the World Bank, the U.S. Agency for International Development (USAID), and other foreign aid organizations into the coffers of huge corporations and the pockets of a few wealthy families who control the planet’s natural resources. Their tools include fraudulent financial reports, rigged elections, payoffs, extortion, sex and murder. They play game as old as empire, but one that has taken on new and terrifying dimensions during this time of globalization.’ ইরানের এযাবৎকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মুহম্মদ মোসাদ্দেককে সিআইএ কর্তৃক ১৯৫৩ সালে উত্খাতের অভিজ্ঞতায় বিশ্বব্যাপী নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক, সামরিক ও করপোরেট স্বার্থরক্ষার নতুন চিন্তা ও কৌশল হিসেবে ইকোনোমিক হিটম্যান তৈরি ও নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা। পারমাণবিক ও সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল এজেন্ডা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের সর্বোত্তম পন্থা হিসেবে অনুমোদন করেন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন এবং পরবর্তীতে রিচার্ড নিক্সন। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের সাহায্যকারী সংস্থা, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে এদেরকে নিয়োগ দেওয়া হয় অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ছদ্মনাম ও ছদ্মবেশে। নিজ নিজ সংস্থা থেকে কোন দেশে কোন সেক্টরে কী পরিমাণ ঋণ দেওয়া হবে এবং তাতে কী কী শর্ত থাকবে এ ধরনের নীতিনির্ধারণী অবস্থানে কাজ করে হিটম্যানেরা। নির্দিষ্ট টার্গেটেড দেশের শাসন ও ক্ষমতাবানদের বুঝিয়ে বহুমুখী প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণে সম্মত করানো এদের অন্যতম একটি কাজ। একই সঙ্গে ঋণের টাকায় গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ যাতে পছন্দ মতো করপোরেট হাউস পায় তারও ব্যবস্থা করেন। বিশাল মেগা প্রকল্পের অর্থনৈতিক বেনিফিটের পূর্বাভাস বহুগুণ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়ে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় কে কত বাড়াতে পারে তার ওপর হিটম্যানদের সাফল্য-ব্যর্থতার মূল্যায়ন হয়। ঋণ গচাতে পারলে শাসকদের অন্দরমহলে প্রবেশ করার সুযোগ পায় ইকোনোমিক হিটম্যানেরা। আর তখনই তারা আসল রূপ ধারণ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের কার্ডটি আস্তিনের নিচে থেকে বের করে দেয়। নিয়োগদানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা সাধারণত এদের পূর্ব পরিচয় জানে না, জানলেও টপ লেভেলের দুয়েকজন জানতে পারে, অন্য কেউ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের সঙ্গে এদের কোনো প্রত্যক্ষ সংযোগ থাকে না। যাতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে গোপন পরিচয় ফাঁস হয়ে গেলে কোনোভাবেই যেন তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিব্রতকর না হয়। কোনো দেশে হিটম্যানেরা ব্যর্থ হলে লক্ষ্য অর্জনে ওই দেশে পূর্ব থেকে প্রস্তুতকৃত জ্যাকলরা এগিয়ে আসেন। দ্বিতীয় লাইনে থাকা জ্যাকলরা ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট দেশের সেনাবাহিনীকে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়। আর এগুলো কিছু কাজ না করলে সরাসরি সামরিক অভিযানে নামতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। জন পার্কিনস তার বইতে বলেছেন, সাদ্দাম হোসেনকে উত্খাত ও ইরাক দখলের সব বিকল্প ব্যর্থ হওয়ায় সর্বশেষ পন্থা হিসেবে সামরিক অভিযান চালায় যুক্তরাষ্ট্র। হিটম্যানদের কায়দায় পরিকল্পিতভাবে জ্যাকলদেরকে তৈরি করা হয় না।

আবার কেউ ইচ্ছা করলেই জ্যাকলদের তালিকায় নাম লেখাতে পারেন না। নির্দিষ্ট দেশের নাগরিকদের মধ্যে যারা স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে নিজের মেধা ও যোগ্যতায় নিজেকে একজন সম্ভাবনাময় ও প্রতিশ্রুতিশীল ব্যক্তি হিসেবে একটা স্তর পর্যন্ত উন্নীত করেছেন তাদের মধ্য থেকে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে বাছাই করে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করা হয়। তবে ইচ্ছা থাকলেও সবাইকে তারা জ্যাকল বানাতে পারে না। জ্যাকলদের অবস্থান একটা রাষ্ট্রের সব অঙ্গনেই থাকতে পারে। তবে রাজনীতিক, সরকারি প্রশাসন, ব্যবসায়ী, মিডিয়া, বড় বড় এনজিও, পেশাজীবী, সিভিল সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেই এদের বিচরণ বেশি থাকে। আবার নির্দিষ্ট দেশের যেসব নাগরিক বিশ্ব সংস্থাসমূহ ও খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করে তাদেরও নির্বাচিত করা হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের জ্যাকলদের গুরুত্ব ও পরিচিতি বৃদ্ধি ও প্রভাব প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের তদবিরে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান থেকে এদেরকে পুরস্কৃত করা হয়, সম্মানজনক উপাধি দেওয়া হয়। ন্যাটো বাহিনী কর্তৃক আফগানিস্তান দখলের পর বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা হামিদ কারজাইকে প্রেসিডেন্ট পদে বসিয়ে দেওয়া হয়। একইভাবে ২০০৩ সালে ইরাক দখল করার পর নূরী আল মালিকিকে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী করা হয়। কনফেশনস অব অ্যান ইকোনোমিক হিটম্যান গ্রন্থে জন পার্কিনস বেশ কিছু দেশে তার কাজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। তার মধ্যে ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, পানামা, ইকুয়েডর, ইরান, ইরাক, কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা ও গুয়াতেমালার নাম আছে। সঙ্গত কারণেই সব দেশের উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। তবে পানামার জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদী নেতা ওমর টোরিজোর ট্র্যাজেডি আমার কাছে হৃদয়গ্রাহী মনে হয়েছে। গত শতকের সত্তর দশকে পানামার জাতীয়তাবাদী নেতা ওমর টোরিজো কর্তৃক পানামা খালকে জাতীয়করণ করার ঘোষণার ফলে পানামা খাল চালু হওয়ার শুরু থেকে খালসহ এর উভয় পাশে এযাবৎকাল চলে আসা যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব হুমকির মুখে পড়ে। টোরিজো দেশব্যাপী জনসভা করে খাল জাতীয়করণের পক্ষে জনসমর্থন আদায় করেন। ১৯৭৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শান্তিকামী প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার পানামা খালের কর্তৃত্ব পানামাকে ফেরত দেওয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যা মাত্র এক ভোট বেশি পেয়ে মার্কিন কংগ্রেসে পাস হয়। ওমর টোরিজো হয়ে ওঠেন পানামা জনগণের প্রিয় নেতা ও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। কিন্তু ১৯৮১ সালে রোনাল্ড রিগান যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় এসে পানামা খালের কর্তৃত্ব আগের মতো যুক্তরাষ্ট্রকে ফেরত দেওয়ার দাবিতে জিমি কার্টারের সময়ে স্বাক্ষরিত চুক্তির সংস্কার দাবি করেন। কিন্তু ওমর টোরিজো তা প্রত্যাখ্যান করেন। জন পার্কিনস লিখেছেন, তখন পানামার জ্যাকলরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন, যার মধ্যে একদল বিভিন্ন ছদ্মবেশে টোরিজোর চারপাশ ঘিরে ফেলেন। তারপরই ঘটে যায় সেই ট্র্যাজেডি। ১৯৮১ সালের ৩১ জুলাই ভয়ানক বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ওমর টোরিজোর। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন সিআইয়ের পরিচালক উইলিয়াম ক্যাসের নিজস্ব বালকখ্যাত ম্যানুয়ের নোরিয়েগা। কিন্তু কয়েক বছরের মাথায় নোরিয়েগার ভাগ্যেরও বিপর্যয় ঘটে। টোরিজোর মৃত্যুর দুই মাস আগে মার্কিন তেল কোম্পানির মালিকানাধীন তেলের খনিগুলো জাতীয়করণ করার অল্প কিছু দিনের মাথায় ইকুয়েডরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জেইম রুল্ডস ১৯৮১ সালের ২৪ মে একইভাবে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। বাংলাদেশের জ্যাকলদের চিনতে হলে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট, তার পরিণতি এবং সুবিধাভোগীদের দিকে তাকাতে হবে সর্বপ্রথম। তারপর ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর এবং ৫০ বছরের গ্যাস রিজার্ভ নিশ্চিতকরণ ব্যতিরেকে তা রপ্তানি না করার পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণার পরবর্তী ঘটনাবলির নিবিড় পর্যালোচনা করা হলে অনেক জ্যাকল চরিত্র সামনে আসবে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালের নির্বাচন ও তার অব্যাবহিত পরবর্তী সাময়ে দুই বড় দলের বাইরের কিছু সুপরিচিত রাজনীতিক, এনজিও কর্মকর্তা, সুশীল সমাজের কিছু ব্যক্তিবর্গের ভূমিকার দিকে তাকালেও কিছু জ্যাকল চরিত্রকে চেনা যেতে পারে। তবে জ্যাকল চেনার সবচেয়ে ভালো সুযোগ গেছে ২০০৭-২০০৮ জরুরি আইনের সরকারের সময়। সর্বশেষ ২০০১-২০০৬ মেয়াদে নিজেদের মিত্র জোট সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ে ১৩ দফা উত্থাপন না করে হেফাজত কেন তা ২০১৩ সালের ৫ মে উত্থাপন করে জ্বালাও-পোড়াও এবং তাণ্ডব চালাল। এটা কি শুধু হেফাজতের কাজ ছিল? সম্প্রতি বাংলাদেশে আইএস আছে, আইএস নেই বিতর্ক এবং একেবারে নিরাপত্তাহীন সফট টার্গেট মানুষের ওপর কিছু টার্গেটেড কিলিংকে কেন্দ্র করে রাজনীতির বাইরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ বলা শুরু করলেন— প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন দিয়ে কী হবে, সরকার দেশের কোনো মানুষের নিরাপত্তা দিতে পারছে না।  এদের কথার সঙ্গে কিন্তু হিটম্যানদের প্রভুদের কথার অনেক মিল পাওয়া যায়।  তবে এ কথাও ঠিক যে, কে কী বলছেন এবং কেন বলছেন সেটা বক্তা নিজেই কেবল সঠিকভাবে বলতে পারবেন।

পুনশ্চ : কনফেশনস অব অ্যান ইকোনোমিক হিটম্যান গ্রন্থ থেকে এই লেখার সব তথ্যউপাত্ত নেওয়া হয়েছে।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর